লাঠিতে ভর দিয়ে এলেন টিসিবির পণ্য কিনতে

প্রতিবেশীর সাহায্য নিয়ে লাঠিতে ভর করে টিসিবির ট্রাক থেকে পণ্য কিনতে এসেছেন বাক্ ও শ্রবণপ্রতিবন্ধী মো. শফিক। এলাকার দুই ব্যক্তি তাঁকে পণ্য নিতে সহায়তা করছেন। গতকাল বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে রাজধানীর বাড্ডার সাতারকুল এলাকায়
ছবি: খালেদ সরকার

বয়স তাঁর আশির ওপরে। কানে শোনেন না। কথা বলতে পারেন না। এমনকি কারও সাহায্য ছাড়া হাঁটতেও পারেন না। এই শ্রবণ ও বাক্প্রতিবন্ধী মো. শফিক গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেল পাঁচটায় রাজধানীর বাড্ডার সাতারকুলে টিসিবির ট্রাক থেকে পণ্য কিনলেন লাঠিতে ভর দিয়ে এসে।

সাতারকুলের পুকুরপাড় এলাকার বাসিন্দা শফিকের স্ত্রী গত হয়েছেন। তাঁর আশ্রয় এখন বড় মেয়ের বাসায়। বড় মেয়ের শিশুসন্তান থাকায় তিনি বেরোতে পারেননি। বাধ্য হয়ে প্রতিবেশী ফিরোজা বেগমের সহায়তায় বাবাকে পাঠিয়েছেন টিসিবির পণ্য কিনতে। ফিরোজা প্রথম আলোকে বলেন, ‘রমজান আসছে। জিনিসপত্রের দাম বেশি। সাশ্রয়ী মূল্যে কিছু পণ্য পেলে উপকার হয়। শফিক সাহেবের মেয়ের কথায় তাঁকে নিয়ে এসেছি।’

আরও পড়ুন

প্রতিবন্ধী ও বয়স্ক হওয়ার কারণে শফিককে লাইনে দাঁড়াতে হয়নি।

সাতারকুলে গতকাল বেলা পৌনে দুইটায় পণ্য নিয়ে টিসিবির ট্রাক আসে। কেউ কেউ বেলা একটা থেকে ট্রাকের অপেক্ষায় ছিলেন। ট্রাক আসার পরপরই পাঁচজন কর্মী পণ্য প্যাকেট করা শুরু করেন। দুই ঘণ্টার বেশি সময় পর বিকেল চারটায় তাঁরা পণ্য বিতরণ শুরু করেন। ট্রাকের কর্মী আবু সালেহ বলেন, দুটি গুদাম থেকে ১৬০টি ট্রাকে পণ্য তোলা হয়। গুদাম থেকে পণ্য নেওয়া, আসা, তারপর প্যাকেট করে বিতরণ শুরু করতে দেরি হয়ে যায়।

২ মাস ২০ দিন বয়সী মেয়ে ফাইজাকে নিয়ে দীর্ঘক্ষণ লাইনে অপেক্ষার পর পণ্য পান রিনা বেগম। তিনি থাকেন সাতারকুলের তালতলায়। তাঁর স্বামী গুলশানে নিরাপত্তাপ্রহরীর কাজ করেন। সংসারে দুই ছেলে ও এক মেয়ে। তাদের দেখাশোনা করতে গিয়ে চাকরি বা কোনো কাজ করতে পারেন না রিনা। টানাটানির সংসারে অর্থ বাঁচানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে হয় তাঁকে। তাই ফাইজাসহ পাঁচ বছর বয়সী ছেলে আরাফাতকে নিয়ে টিসিবির পণ্য কিনতে আসেন রিনা। তাঁর প্রশ্ন, ‘বাচ্চা কার কাছে রেখে আসব?’

আরও পড়ুন

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও রমজান সামনে রেখে সরকার টিসিবির পণ্য বিক্রির পরিমাণ বাড়িয়েছে। তারই অংশ হিসেবে সাতারকুলে বিক্রি হচ্ছিল টিসিবির পণ্য। গতকাল সাতারকুলের টিসিবির ট্রাকে আড়াই শ প্যাকেটের ব্যবস্থা ছিল। প্রতিটি প্যাকেটে দুই কেজি মসুর ডাল, দুই কেজি চিনি, দুই লিটার তেল, ৩ কেজি ৮০০ গ্রাম ছোলা, দুই কেজি খেজুর ও দুই কেজি পেঁয়াজ দেওয়া হচ্ছে। প্রতি প্যাকেট সাড়ে আট শ টাকায় বিক্রি করা হয়।

সাতারকুলের রহমতুল্লা গার্মেন্টস এলাকার পারভিন আক্তার সাত–আট দিন খালি হাতে ফেরার পর গতকাল পণ্য পেয়েছেন। টিসিবির পণ্যের জন্য গতকাল চারবার আসেন তিনি। প্রথমে সকাল ১০টায়, তারপর দুপুর ১২টায় ও বেলা দেড়টার দিকে। একবারও টিসিবির ট্রাক দেখতে না পেয়ে ফিরে যান তিনি। তারপর বেলা তিনটার দিকে এসে টিসিবির ট্রাকের দেখা পান। ৫০ নম্বর সিরিয়ালধারী পারভিন আক্তার বলেন, ‘আতঅ (হাতে) যদি মাল লইতে হারি, তাইলে বিশ্বাস করমু।’

সাতারকুলে টিসিবির এই কেন্দ্রে স্থানীয় কাউন্সিলরের তত্ত্বাবধানে লাইনে দাঁড়ানো ব্যক্তিদের সিরিয়াল নম্বর দেওয়া হয়। যমুনা রানী মন্ডলের ধারণা, টাকা ছাড়াই কার্ড (সিরিয়াল নম্বর) পেলে টিসিবির পণ্য পাওয়া যায়। এই প্রতিবেদক যখন টিসিবির পণ্য নিতে আসা ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলছিলেন, তখন যমুনা রানী প্রশ্ন করেন, ‘আমারে একটা কার্ড দিবেন?’

যমুনা রানী সাতারকুলের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে শাক তুলে বাজারে বিক্রি করেন। তা দিয়ে খেয়ে–না খেয়ে দিন চলে তাঁদের। তিনি থাকেন সাতারকুলের মেরুলে রাস্তার পাশে পলিথিন দিয়ে তৈরি একটি ঘরে। তাঁর সঙ্গে আরও থাকেন বৃদ্ধ মা এবং ১০ বছর বয়সী এক মেয়ে। তাঁর স্বামীর বাড়ি বিক্রমপুর। স্বামী আরেকটা বিয়ে করেছেন। মেয়ের বয়স যখন কয়েক দিন, তখন তিনি সাতারকুলে বাবার বাড়ি চলে আসেন। বাবার বাড়িতে সম্পত্তি না থাকায় রাস্তাতেই থাকেন তাঁরা।

যমুনা রানী গতকাল ১০০ টাকার শাক তুলে বিক্রি করেছেন। তাঁর পক্ষে সাড়ে আট শ টাকা দিয়ে টিসিবির পণ্য কেনা সম্ভব নয়। তিনি বলেন, ‘পণ্য পেলে ভালো হয়। খেতে পারতাম।’ তবে তাঁকে খালি হাতেই ফিরতে হয়।

সাতারকুলের এই কেন্দ্র থেকে টিসিবির পণ্য কিনতে আসা মানুষের বেশির ভাগ নারী। পণ্য কিনবেন দেখে গতকাল কাজে যাননি পুষ্প আক্তার। বাড্ডার মুন্সিবাড়ি থেকে আসা পুষ্প আক্তারের স্বামী করোনা শুরুর সময় মারা গেছেন। পড়াশোনা বন্ধ হওয়ার পর মেয়ে এখন পোশাক কারখানায় কাজ করে। পুষ্প যখন যে কাজ পান, তাই করেন। পুষ্প বলেন, ‘আজকে কাজে যাইনি। এখানে তেলের দাম কম। রোজা আসতেছে। তাই নিতে আসলাম।’

টিসিবির পণ্যের মধ্যে পেঁয়াজের মান ছিল যথেষ্ট খারাপ। আবু কালাম নামের একজন বললেন, ‘পেঁয়াজ পচা। অর্ধেকও খাওয়া যাবে না।’