লকডাউন নিয়ে পূর্ব রাজাবাজারে আতঙ্ক-অনিশ্চয়তা
পূর্ব রাজাবাজারে ঢোকার মুখে বাঁশের বেশ শক্ত প্রতিবন্ধক। সেটি পেরিয়ে ভেতরে ঢুকতেই জায়গায় জায়গায় মানুষের জটলা। জীবন ও জীবিকা নিয়ে সবাই উদ্বিগ্ন। এই অভিজ্ঞতা তাঁদের জন্য নতুন।
করোনাভাইরাস ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ায় রাজধানীতে এলাকাভিত্তিক লকডাউন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কর্তৃপক্ষ। এর মধ্যে পূর্ব রাজাবাজার একটি। মঙ্গলবার রাত ১২ টার পর থেকেই এখানে লকডাউন কার্যকর করা হচ্ছে। প্রশাসনের সহযোগিতায় টহল জোরদার করেছে সেনাবাহিনী। প্রাথমিকভাবে ১৪ দিন লকডাউন জারি থাকবে।
রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) নির্দেশনায় পূর্বরাজাবাজারে লকডাউন নিশ্চিত করবে সরকারি সংস্থাগুলো। প্রতিষ্ঠানটির উপদেষ্টা মুশতাক হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, শুধু এই অঞ্চলটির জন্য একজন রোগতত্ত্ববিদকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। উপসর্গ আছে এমন ব্যক্তিদের দ্রুততার সঙ্গে পরীক্ষা করা ও যাদের বাসায় আইসোলেশনের ব্যবস্থা নেই তাদের এলাকাতেই আইসোলেশনের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
পূর্ব রাজাবাজারে ভোটার সংখ্যা ১৯ হাজার, তবে কাউন্সিলর ফরিদুর রহমান ইরানের হিসেবে এলাকার বাসিন্দা ৪০ হাজারের ওপর। এ এলাকায় করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী ৩১ জন।
যেভাবে প্রস্তুতি:
সকাল থেকেই স্থানীয় কাউন্সিলর অফিসের পক্ষ থেকে সাইফুল ইসলাম লকডাউনের নির্দেশনা প্রচার করছে। কি প্রচার করা হচ্ছে জানতে চাইলে সাইফুল প্রথম আলোকে বলেন, “কাল থেকে কোনো দোকান খুলবে না, রাস্তায় কোনো হকার, সবজি বিক্রেতা বসবেন না। চলাচল সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।” সবাইকে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকতে বলা হয়েছে।
বিকেলে সেনাবাহিনীর দুটো গাড়িকে এলাকায় টহল দিতে দেখা যায়। করোনাভাইরাস শনাক্তে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে কি না জানতে চাইলে একজন স্থানীয় জানান, ‘নাজনীন স্কুলে বুথ রয়েছে।’ তালাবদ্ধ স্কুলের কেঁচি গেটের ফাঁক দিয়ে একটি কিয়স্ক দেখা যায়। করোনাভাইরাসের উপসর্গ দেখা দিলে এখানে পরীক্ষা করা হবে। রোগ দেখা দিলে যাদের বাসায় থাকার আলাদা ব্যবস্থা নেই, তাদের নাজনীন স্কুলেই রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে বারবার সামাজিক দূরত্বের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হলেও, মঙ্গলবার বিকেলে পূর্ব রাজাবাজার থেকে যে পথটি গিয়ে ফার্মগেটের রাস্তায় উঠেছে, তার দু’ধারের দোকানপাটে প্রচুর মানুষের আনাগোনা দেখা গেছে। বিশেষ করে মুদি-মনোহারি দোকানে।
কালাচাঁন স্টোর নামের চাল-ডাল-আটার ছোট্ট একটি দোকানের কর্ণধার মো রাসেল প্রথম আলোকে বলেন, ঈদের পর মঙ্গলবার পর্যন্ত ১০-২০ হাজার টাকার বেশি বিক্রি হয়নি। মঙ্গলবার বিকেল পর্যন্ত বিক্রি হয়েছে ৫০ হাজার টাকার বেশি।
স্থানীয় কাউন্সিলর ফরিদুর রহমান ইরান প্রথম আলোকে বলেন, “লকডাউনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরপরই হতদরিদ্রদের খাবারের ব্যবস্থা করার কথা বলেছি। অন্তত দুই মাসের খাবারের মজুদ রাখা হয়েছে। আমরা নিজেরা গিয়ে খাবার পৌঁছে দেব।” যারা বিত্তশালী তাঁদের বাড়িতেও বাজার পৌঁছে যাবে, তাঁরা টাকা দিয়ে কিনে নেবেন।
তারপরও এলাকার লোকজনকে চাল-ডাল-আটা থেকে শুরু করে সবজি, মাছ-মুরগি, এমনকি হুড়মুড়িয়ে আম-লিচু কিনতেও দেখা গেছে কোথাও কোথাও।
বাসা থেকে বর্জ্য সংগ্রহেরও ব্যবস্থা করা হয়েছে বলে জানান তিনি।
তবু আতঙ্ক ও অনিশ্চয়তা:
প্রাথমিকভাবে ১৪ দিনের লকডাউনের কথা বলা হলেও কাউন্সিলরের কথায় দুশ্চিন্তামুক্ত হতে পারছেন না অনেকে। কত দিন এ পরিস্থিতি চলবে, তারাই বা খেয়ে-পরে বাঁচবেন কি করে এমন হাজারো দুশ্চিন্তা তাঁদের মধ্যে।
অনেকেই বলেছেন, করোনাভাইরাসজনিত কারণে সাধারণ ছুটির পর থেকেই বাজার ঊর্ধ্বগামী। মঙ্গলবার সেটা আরও চড়েছে পূর্ব রাজাবাজারে। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম নাগালের বাইরে চলে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন তাঁরা।
মুদির দোকানে দাঁড়িয়ে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলছিলেন মিসেস মমতাজ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, “সরকার ভালোর জন্য করেছে বুঝলাম। কিন্তু এই সুযোগে প্রতিটা জিনিস বেশি দামে বিক্রি করছে দোকানিরা। একটা দুই টাকা দামি মিনিপ্যাক শ্যাম্পুর দামও এক টাকা বাড়িয়ে দিয়েছে আজ।”
উল্টো পাশের মুদির দোকানি বলেন, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরুর পর থেকেই তাঁর ব্যবসা খারাপ। চারটি ছোট ছোট সন্তানসহ পরিবারে ছয়জন মানুষ। দোকান ও বাসা ভাড়া মিলে ১৯ হাজার টাকা খরচা হয়। তাঁকে দোকান বন্ধ রাখতে বলা হয়েছে।
বিপদের আশঙ্কা করছিলেন দুলাল মিয়া। তিনি পেশায় ব্যক্তিগত গাড়ির চালক। পরিবারের সদস্য সংখ্যা পাঁচ। করোনাভাইরাস শুরুর পরই কাজ ছাড়িয়ে দিয়েছে মালিক। স্ত্রীর আয়ই সম্বল। তেজগাঁয়ের একটি গার্মেন্টসে কাজ করেন তিনি। আগেই গার্মেন্টস হুঁশিয়ারি দিয়ে রেখেছে, কাজে না আসলে ছাঁটাই। কি করবেন ভেবে পাচ্ছেন না দুলাল।
অন্যদিকে এলাকায় তিন পুরুষের বাস এমন এক ব্যক্তি নাম না প্রকাশ করার শর্তে বলেন, “এলাকার দোষ ছড়িয়ে পড়ল। আগামী দুই বছর এ এলাকায় আর ভাড়াটিয়া পাওয়া যাবে না।” রোগের সঙ্গে দোষের কি সম্পর্ক তা অবশ্য তিনি খুলে বলেননি।
কি করলে ভালো হয় জানতে চাইলে এলাকার লোকজন বলেছেন, এলাকায় যাঁদের সামর্থ্য নেই তাদের খাদ্য সহায়তার নিশ্চয়তা দিতে হবে। যারা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন লকডাউনের কারণে তাঁদের যেন ছাঁটাই করা না হয়। আর যত বেশি সম্ভব পরীক্ষা করে অসুস্থ যারা হয়েছেন তাঁদের আলাদা করে চিকিৎসার ব্যবস্থা নিতে হবে।
আইইডিসিআর এর উপদেষ্টা মুশতাক হোসেন বলেছেন, লাল রং চিহ্নিত এলাকায় যেন কারও চাকরি না যায়, সে ব্যাপারে সরকারের নির্দেশনা আছে। প্রয়োজনে সেই নির্দেশনার কথা মনে করিয়ে দিতে হবে।