রাষ্ট্রদূতদের কড়া সমালোচনায় বিদেশফেরত শ্রমিক
বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ পাওয়া ব্যক্তিরা দায়িত্বে 'চরম অবহেলা' করছেন বলে অভিযোগ করেছেন মালয়েশিয়াফেরত শ্রমিক জাহাঙ্গীর মোল্লা। তাঁর অভিযোগ, বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে বেতন নিলেও রাষ্ট্রদূতেরা অবৈধ আদম ব্যবসায়ীদের দালালি করেন। তাঁদের 'জমিদারি প্রথা' থেকে বের করে আনার জন্য সরকারের কাছে আহ্বান জানিয়েছেন জাহাঙ্গীর।
আন্তর্জাতিক অভিবাসন দিবস উপলক্ষে অভিবাসী শ্রমিক ফোরামের ব্যানারে আজ শুক্রবার সকালে রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে আয়োজিত এক মানববন্ধনে কথাগুলো বললেন জাহাঙ্গীর। অভিবাসী শ্রমিকদের সুরক্ষায় ২০১৩ সালে প্রণীত আইনটির বাস্তবায়ন ও করোনা দুর্যোগ মোকাবিলায় বিদেশফেরত শ্রমিকদের আর্থিক সহায়তাসহ পুনর্বাসনের দাবিতে ছিল এই কর্মসূচি।
বাংলাদেশ অভিবাসী শ্রমিক ফোরামের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন জাহাঙ্গীর। করোনাকালে কাজ হারিয়ে মালয়েশিয়া থেকে দেশে ফিরেছেন তিনি।
জাহাঙ্গীর মোল্লা বলেন, ‘আমরা যখন দেশের বাইরে কাজ করতে চাই, আমাদের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য থাকে দেশে টাকা পাঠানো এবং আমরা দেশের উন্নয়নের জন্য বিদেশে যাই, কিন্তু আমাদের নিয়ে দেশের কোনো চিন্তাভাবনা থাকে না। আমরা দেশে যে রেমিট্যান্স পাঠাই, সেই টাকা দিয়ে দেশ সচ্ছল ও উন্নত হয়। সেই উন্নয়ন গুটিকয় মানুষ ভোগ করে। আমরা যাঁরা এই উন্নয়নের অংশীদার, তাঁরা স্বীকৃতি পর্যন্ত পাই না। অভিবাসন দিবসে আমার একটাই দাবি, বিভিন্ন দেশে সরকারের যে রাষ্ট্রদূতেরা আছেন, তাঁরা যেন তাঁদের দায়িত্ব যথাযথ পালন করেন।’
জাহাঙ্গীর অভিযোগ করেন, ‘বিভিন্ন দেশে রাষ্ট্রদূত হিসেবে যাঁরা যান, তাঁরা নিজেদের রাষ্ট্রপতির চেয়েও বেশি ক্ষমতাবান মনে করেন। তাঁরা দেশের বাইরে যান শুধু টাকাপয়সা কামাই ও আরাম-আয়েশের জন্য। অভিবাসী শ্রমিকদের খোঁজখবর নেওয়াটা তাঁদের কাজ, কিন্তু তাঁরা নিজেদের জমিদার মনে করেন। বিভিন্ন দেশে তাঁরা অবৈধ আদম ব্যবসায়ীদের দালালি করেন, অথচ বেতন নেন বাংলাদেশ সরকারের।
তাঁরা যে জনগণের চাকর ও সেবক, সেই দায়িত্ব তাঁদের পালন করতে হবে। তাঁরা তাঁদের দায়িত্বে অবহেলা করছেন। সরকারকে অনুরোধ করছি, অবিলম্বে রাষ্ট্রদূতদের দিকে দৃষ্টি দিন, জমিদারি প্রথা থেকে তাঁদের বের করে আনুন, যাতে তাঁরা নিজেদের ওপর অর্পিত দায়িত্বগুলো সঠিকভাবে পালন করেন।’
মানববন্ধনে অংশ নিয়ে সৌদিফেরত নারী শ্রমিক ইয়াসমিন বেগম বলেন, ‘সৌদি আরব গিয়েছিলাম, কিন্তু নির্যাতিত হয়ে সেখান থেকে ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছি। আমার স্বামী আমার টেনশনে কয়েক দিন আগে ব্রেন স্ট্রোক করে মারা গেছে। ছেলেমেয়ের ভবিষ্যৎ করার আশা নিয়ে বিদেশে গিয়েছিলাম, কিন্তু আমার ভাগ্যে তা জুটল না। সব হারালাম, ছেলেমেয়ে নিয়ে অনেক বিপদে আছি, আমি অসুস্থ, কোনো কাজ করতে পারছি না।
আয়রোজগার করতে পারছি না, কীভাবে বাঁচব? আত্মীয়স্বজনও এখন আমাকে চেনে না। বলে বিদেশে কেন গিয়েছিলি? দেশে ভিক্ষা করে খেতি। এখন ভাবছি, বিষ পান করে মরব, নাকি ফাঁসি দিয়ে মরব!’
সংহতি বক্তব্যে জাতীয় গার্হস্থ্য নারী শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মুর্শিদা আখতার বলেন, ‘আমাদের প্রবাসী শ্রমিকের সংখ্যা ১ কোটি ৩০ লাখ শ্রমিক। করোনায় ১০ লাখ শ্রমিক কর্মসংস্থান হারাচ্ছেন। এ বছরের এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১ লাখ ২৭ হাজার প্রবাসী দেশে ফিরেছেন, যাঁদের মধ্যে প্রায় ১০ হাজার নারী আছেন।
নির্যাতনের শিকার হয়ে নারী শ্রমিকেরা দেশে ফিরে আসছেন। ২০১৯-২০ সালে প্রবাসীরা দেশের অর্থনীতিতে ব্যাপক অবদান রেখেছেন, কিন্তু সরকার তাঁদের যথাযথ মূল্যায়ন করছে না। সরকারকে আহ্বান জানাব, যাঁরা কর্মসংস্থান হারিয়েছেন, তাঁদের পাশে দাঁড়ান, দেশে কর্মসংস্থান থাকলে এই শ্রমিকেরা বিদেশে পাড়ি জমাতেন না।’
অভিবাসী শ্রমিক ফোরামের সভাপতি সাবিনা চৌধুরীর সভাপতিত্ব করেন।
বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির ঢাকা মহানগর শাখার সভাপতি আবুল হোসাইন অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন। মানববন্ধনে অন্যদের মধ্যে ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সুমাইয়া ইসলাম, জর্ডানফেরত শ্রমিক হোসনে আরা বেগম, কাতারফেরত সালমা চৌধুরী প্রমুখ বক্তব্য দেন।
আন্তর্জাতিক অভিবাসন দিবস উপলক্ষে আজ সকালে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে এ ছাড়া যৌথ মানববন্ধন করেছে ওয়্যারবী ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন ও বাংলাদেশ অভিবাসী অধিকার ফোরাম নামের দুটি সংগঠন। এই মানববন্ধনে ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ সাইফুল হক ও পরিচালক জেসিয়া খাতুন, ফোরামের চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান প্রমুখ বক্তব্য দেন। এই মানববন্ধন থেকে বাংলাদেশের নাগরিকদের জন্য নিরাপদ অভিবাসন নিশ্চিত করতে সরকারের কাছে দাবি জানানো হয়। বক্তারা বলেন, দুই লাখ অভিবাসী শ্রমিক করোনার সময় দেশে ফেরত এসেছেন, কিন্তু তাঁদের পুনর্বাসন সঠিকভাবে হয়নি। অনতিবিলম্বে তাঁদের পুনর্বাসন নিশ্চিত করা হোক।
একজন নারী শ্রমিকও যাতে কোনো দেশে নির্যাতনের শিকার না হন, সেটি যেকোনো মূল্যে নিশ্চিত করতে হবে। অভিবাসন দিবসে এটিই আমাদের একমাত্র দাবি।