উত্তরা তৃতীয় পর্ব
রাজউকের জমিতে অবৈধ বাজার
১৯৯৯ সালে উত্তরা তৃতীয় পর্ব প্রকল্প শুরু করে রাজউক। এখনো বাণিজ্যিক প্লটগুলো বরাদ্দ দিতে পারেনি।
বাজারটি তিনবার উচ্ছেদ করা হয়েছে। প্রতিবারই বসিয়েছেন প্রভাবশালীরা।
রাজধানীর উত্তরায় রাজউকের জমি দখল করে বাজার গড়ে তুলেছেন শ্রমিক লীগের এক নেতা। ওই বাজার থেকে প্রতি মাসে চার লাখ টাকার বেশি চাঁদা তোলা হয়। অভিযোগ আছে, এই টাকা ভাগাভাগি করেন ক্ষমতাসীন দলের নেতারা। রাজউকের অসাধু কর্মীরাও ভাগ পান।
উত্তরা তৃতীয় পর্বের উত্তরা-১৮ নম্বর সেক্টরে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) ‘অ্যাপার্টমেন্ট প্রজেক্ট’ এলাকার পশ্চিম পাশে এই অবৈধ বাজার গড়ে উঠেছে। বাজারটি পরিচালনা করেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৫২ নম্বর ওয়ার্ড শ্রমিক লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রুস্তম আলী ও তাঁর সহযোগী শ্রমিক লীগ নেতা আনোয়ার হোসেন।
জানতে চাইলে রুস্তম আলী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা কারও অনুমতি নিইনি। দোকানদারদের সঙ্গে নিয়ে নিজেরাই করছি, নিজেরাই চালাচ্ছি।’ তিনি দাবি করেন, বাজারে নিয়োগ করা তিনজন নিরাপত্তাপ্রহরী এবং পানি ও বিদ্যুতের বিল বাবদ দোকানদারদের কাছ থেকে টাকা নেওয়া হয়। আদায় করা টাকা কোথায় জমা রাখা হয়, জানতে চাইলে তিনি কোনো উত্তর দেননি।
বাজারটি থেকে মাসে ৪ লাখ টাকা চাঁদা তোলা হয়, যা ভাগাভাগি করেন ক্ষমতাসীন দলের নেতারা।
সরেজমিনে দেখা যায়, উত্তরার ১৮ নম্বর সেক্টরে রাজউকের অ্যাপার্টমেন্ট প্রজেক্ট প্রকল্পের পরিচালকের অস্থায়ী কার্যালয় ঘেঁষে অবৈধ বাজারটি গড়ে উঠেছে। রাজউক সূত্র জানায়, জায়গাটি উত্তরা তৃতীয় পর্বের আওতায় বাণিজ্যিক প্লট হিসেবে নির্ধারিত। বাজারটিতে ছোট-বড় মিলিয়ে দোকান আছে প্রায় ৭০টি। বেশির ভাগই শাকসবজি ও মাছের দোকান এবং খাবার হোটেল, সেলুন ও দরজির দোকান, ডেকোরেটর ও চায়ের দোকান। একাধিক দোকানদারের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাঁদের ব্যবসার ধরন অনুযায়ী দৈনিক ১০০ থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা দিতে হয়।
দোকানদারেরা আরও বলেন, বাজার পরিচালনা করতে অনেক জায়গায় টাকা দিতে হয়—এ কথা বলে তাঁদের কাছ থেকে চাঁদা নেওয়া হয়। টাকা আদায় করেন রুস্তম ও আনোয়ার। মাঝেমধ্যে তাঁদের নিয়োজিত কর্মীরা চাঁদা আদায়ের কাজটি করেন। ৭০টি দোকানে দৈনিক গড়ে ২০০ টাকা হিসাবে প্রতিদিন ১৪ হাজার টাকা চাঁদা ওঠে। প্রতি মাসে চাঁদার পরিমাণ দাঁড়ায় ৪ লাখ ২০ হাজার টাকা।
চাঁদা ভাগাভাগির বিষয়ে জানতে চাইলে শ্রমিক লীগ নেতা আনোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা তো স্থানীয়ভাবে আছি। আমাদের ওপরেও তো লোক আছে। বাজার তো আর একজনের নেতৃত্বে চলে না।’
রাজউকের অ্যাপার্টমেন্ট প্রকল্পের বাসিন্দারা বলছেন, এই প্রকল্পে ৭৯টি বহুতল ভবন নির্মাণ করে ফ্ল্যাট বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে। সেখানে এখন বাস করে প্রায় দুই হাজার মানুষ। তবে প্রকল্পটির ভেতরে কাঁচাবাজার নেই। শুধু একটি সুপারশপ আছে। তাই অবৈধভাবে গড়ে ওঠা বাজারটিতেই বেশির ভাগ মানুষ কেনাকাটা করেন। পরিকল্পিত আবাসিক এলাকায় কেন বাজার নেই, তা জানতে চাইলে রাজউকের অ্যাপার্টমেন্ট প্রকল্পের পরিচালক মুজাফফর উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, আবাসিক এলাকার ভেতরে একটি ১০ তলা বাণিজ্যিক ভবন তৈরি করা হচ্ছে। ভবনটির নির্মাণকাজ প্রায় ৭০ শতাংশ শেষ। সেখানেই বাজারের সুবিধা থাকবে।
রাজউকের উত্তরা তৃতীয় পর্ব প্রকল্পটি নেওয়া হয় ১৯৯৯ সালে। এটি ২০১০ সালে শেষ করার কথা ছিল। তবে শেষ হয়নি। মেয়াদ কয়েক দফা বাড়ানো হয়েছে। রাজউক সূত্র জানায়, প্রকল্পটির মেয়াদ আগামী জুনে শেষ হবে।
রাজউক বলছে, উত্তরা তৃতীয় পর্বে বাণিজ্যিক প্লটের জমিতে গড়ে ওঠা অবৈধ বাজারটি এখন পর্যন্ত তিনবার উচ্ছেদ করা হয়েছে। প্রতিবার উচ্ছেদের পর নতুন করে দোকান বসেছে। উত্তরা তৃতীয় পর্ব প্রকল্পের পক্ষ থেকে সংস্থাটির এস্টেট ও ভূমি-১ শাখাকে বাণিজ্যিক ওই প্লট নিলামের মাধ্যমে বরাদ্দ দেওয়ার ব্যবস্থা করতে একাধিকবার চিঠি দেওয়া হয়েছে। সর্বশেষ চিঠি দেওয়া হয় ১ ফেব্রুয়ারি।
প্রকল্পটির পরিচালক হাফিজুল ইসলামের সই করা ওই চিঠিতে বলা হয়, নকশায় চিহ্নিত বাণিজ্যিক প্লট ও সবুজায়নের নির্ধারিত জায়গায় অবৈধভাবে দোকানপাট নির্মাণ করে ব্যবসা-বাণিজ্য করা হচ্ছে। রাজউকের কর্মীরা এতে বাধা দিতে গেলে ঝগড়াবিবাদ হয়। অবৈধ দখলদার ও দখলদার নিয়ন্ত্রণে বিড়ম্বনা পোহাতে হয়।
হাফিজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা ব্যবস্থা নিতে একাধিক চিঠি দিয়েছি। বিষয়টি এখনো প্রক্রিয়াধীন।’
এর আগে উত্তরার সোনারগাঁও জনপদে রাজউকের ২০টি খালি প্লটে দোকান বসিয়ে স্থানীয় দুই কাউন্সিলরের ভাড়া তোলা এবং পুলিশের চাঁদাবাজি পুলিশ সদর দপ্তরেরই এক তদন্ত প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়; যা নিয়ে গত বুধবার প্রথম আলোতে ‘জমি রাজউকের, অবৈধ দোকান কাউন্সিলরের, চাঁদাবাজিতে পুলিশ’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।