আইন মানুষের জন্য এবং আইনকে সহজবোধ্য করে মানুষের কাছে তুলে ধরার কাজ করেছিলেন সাংবাদিক মিজানুর রহমান খান। ভয়ের কারণে যে কথা মানুষ প্রকাশ করতে পারতেন না, তিনি তা ইঙ্গিত দিয়ে প্রকাশ করতেন। আইনবিষয়ক সাংবাদিকতার একজন পথিকৃৎ মিজানুর রহমানের বিকল্প নেই।
আজ মঙ্গলবার রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবে হিউম্যানিটি ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে ‘আমাদের একজন মিজানুর রহমান খান ছিলেন’ শীর্ষক স্মরণসভায় এসব কথা উঠে আসে।
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক মিজানুর রহমান খান গত বছরের ১১ জানুয়ারি মারা যান।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ সভাটি সঞ্চালনা করেন। তিনি বলেন, আইনের পেছনে যে মানুষ থাকে, তা মিজানুর রহমান খান বুঝিয়েছেন। তিনি তথ্য–উপাত্ত দিয়ে বুঝাতেন। তাঁকে অনুসরণ করলে নতুন প্রজন্ম থেকে মিজানের মতো মানুষ বেরিয়ে আসবেন।
আইন অঙ্গনের সাহসী সাংবাদিক হিসেবে মিজানুর রহমান খানকে অভিহিত করেন সাবেক বিচারপতি মো. আব্দুল মতিন। তিনি বলেন, মিজানের আইনের ডিগ্রি থাকুক বা না থাকুক, তিনি আইনজীবীদের আইনজীবী এবং বিচারকদের বিচারক। মাথার ওপর যদি কয়েকজন মিজানুর রহমান থাকেন, বিচারকরা চিন্তা করে কলম ধরবেন।
‘যে কথা আইনের কারণে, ভয়ের কারণে প্রকাশ করতে মানুষ সাহস পান না, সে কথা মিজানুর রহমান নানাভাবে ইঙ্গিত দিয়ে প্রকাশ করতেন। কখনো তা আলোচনা করতেন।’ —এভাবেই মিজানুর রহমান খানের কাজকে তুলে ধরেন মানবাধিকারকর্মী নূর খান। তিনি বলেন, ‘গত এক বা দুই যুগে গুম ও ক্রসফায়ারের কারণে অনেক মায়ের কোল খালি হয়েছে। অনেক সাংবাদিক ক্ষণে ক্ষণে তা প্রচার করেন। তবে তা নিয়ে বেশি এগোতে গেলে কোথায় যেন একটি বাধা। কিন্তু মিজান ভাই লেখার মাধ্যমে সেই বাধা অতিক্রম করার চেষ্টা করতেন।’
মিজানুর রহমানের একেকটি লেখা কীভাবে আলোচিত এবং বিচার প্রক্রিয়ায় প্রভাব ফেলেছে, সে কথাও উঠে এসেছে তাঁর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীর স্মরণসভায়। এখনো বিচারক ও আইনজীবীরা মিজানুর রহমানকে স্মরণ করেন, তাঁর অভাব যে অনুভব করেন, তা বিভিন্নজনের কথায় উঠে আসে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, ‘মিজানের শূন্যস্থান পূরণ হবে না। কোনো কিছু মিজানের দৃষ্টি এড়াত না। তিনি ২৪ ঘণ্টার সৎ সাংবাদিক ছিলেন।’
বিচার ও আইন বিষয়ে মিজানুর রহমান বিশ্লেষণধর্মী মতামত দিতেন বলে উল্লেখ করে সাবেক বিচারক মাসদার হোসেন বলেন, ‘বিচারালয়ে প্রতিনিয়ত কিছু না কিছু ঘটছে। আজ যদি মিজান থাকত, তাহলে সেসব নিয়ে লেখা পাওয়া যেত। মিজানের বিকল্প সমাজে নেই।’
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী রিজওয়ানা হাসান বলেন, মিজানুর রহমান দায়িত্ববোধ থেকে লিখতেন। তাঁর লেখা সমৃদ্ধও করেছে। তিনি আদালত, রাজনীতি, সদাচারের অভাবকে প্রশ্ন করতেন। তিনি কোনো ব্যক্তিকে নয়, পদ্ধতিকে প্রশ্ন করতেন। পদ্ধতি ঠিক না থাকলে যে সঠিক নেতৃত্ব তৈরি হবে না, কোনো ফল আসবে না, তা মিজানুর রহমান বুঝিয়ে দিতেন।
আলোচকদের সঙ্গে মিজানুর রহমানের নিবিড় সম্পর্কের পাশাপাশি তাঁর অট্টহাসির প্রসঙ্গও উঠে আসে। সে হাসি সবাইকে আপন করে নেওয়ার। সৎ, সাহসী জীবনযাপন করলে একজন মানুষ কত ভালোবাসা পেতে পারেন, তাঁর উদাহরণ মিজানুর রহমান, সে কথাও জানান তাঁরা।
দৈনিক সমকালের উপদেষ্টা সম্পাদক আবু সাঈদ খান বলেন, মিজান যুক্তিতর্ক দিয়ে কথা বলতেন। রাগ পুষে রাখতেন না। সবার স্মৃতিপটে তাঁর হাস্যোজ্জ্বল ছবিই রয়েছে। তাঁর মলিন ছবি কখনো দেখা যায়নি।
অসুস্থ হওয়ার কিছু দিন আগেও মিজানুর রহমানের খানের সঙ্গে একটি আলোচনায় অংশ নেন—সেই স্মৃতিচারণা করেন ‘নিরাপদ সড়ক চাই’–এর প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন। ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, সড়ক দুর্ঘটনায় আইনের বিষয়ে মিজানুর রহমান সুন্দর ব্যাখ্যা দিতেন এবং কীভাবে ভুক্তভোগী বিচার পাবেন, সেসব কথা বলতেন।
দুর্নীতি দমন কমিশনের আইনজীবী খুরশীদ আলম বলেন, সংবিধান ও দুর্নীতির বিষয়ে অনেক আগ্রহ ছিল মিজানের। আইনবিষয়ক সাংবাদিকতায় তিনি নক্ষত্র। তাঁর লেখাগুলো সংরক্ষণ করে রাখা প্রয়োজন।
জাতীয় প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ইলিয়াস খান বলেন, আইনের জটিল বিষয়গুলো সহজ করে লিখতেন মিজানুর রহমান। একজন শিশুর মতো মানুষ ছিলেন তিনি।
সাংবাদিক ও কলামিস্ট ফারুক ওয়াসিফ বলেন, মিজানুর রহমান একজন সামাজিক বুদ্ধিজীবী ছিলেন। এ রকম মানুষের গুরুত্ব ও কাজকে মনে রাখতে হবে।
মিজানুর রহমান খানের বড় ছেলে শাদমান মিজানুর রহমান খান সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলেন, তিনি বাবার দেখানো পথেই হাঁটছেন।
হিউম্যানিটি ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ শফিকুর রহমানের সভাপতিত্বে স্মরণসভায় আরও উপস্থিত ছিলেন মিজানুর রহমান খানের স্ত্রী আনজিনা শিরিন, ভাই সাংবাদিক মশিউর রহমান প্রমুখ।