মেয়ের মৃত্যুতে সচ্ছলতা হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে গেল: সামিয়ার বাবা

মেয়ে সামিয়ার মৃত্যুর পর থেকে বাসাতেই আছেন জামাল উদ্দিন। ক্ষণে ক্ষণে মেয়ের ছবি দেখছেন মা হোসনে আরা
ছবি: প্রথম আলো

‘আমরা সাধারণ জীবন যাপন করি। আমাদের কষ্টের ভেতরে একটা আনন্দ-সুখ লুকিয়ে থাকে সব সময়। সংসারে স্বামী-স্ত্রীর ভালোবাসা, ছেলেমেয়ের প্রতি মহব্বত—এই জিনিসটা আমাদের ভেতরে ছিল। একটু সচ্ছল হলে সম্ভবত আরেকটু আনন্দে থাকতে পারতাম। মেয়ের মৃত্যুতে ওই সচ্ছলতা হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে গেল।’

রাজধানীর শাহজাহানপুরে গুলিতে নিহত পথযাত্রী সামিয়া আফনান জামালের (২২) বাবা মো. জামাল উদ্দিন দুঃখ করে এসব কথা বলেন। জামাল উদ্দিন মিরপুরের একটি ছোট কারখানায় অল্প বেতনে চাকরি করেন। মেয়ের মৃত্যুর পর থেকে বাসাতেই আছেন তিনি। আজ সোমবার বিকেলে রাজধানীর শান্তিবাগের বাসায় তাঁর সঙ্গে কথা হয় প্রথম আলোর।

গত বৃহস্পতিবার রাত সোয়া ১০টার দিকে রাজধানীর শাহজাহানপুরের আমতলা মসজিদ এলাকায় যানজটে থেমে থাকা যানবাহনের একটিকে লক্ষ্য করে এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়ে মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইসলাম ওরফে টিপুকে হত্যা করা হয়। এই গুলি লাগে সড়কে যানজটে আটকা পড়ে রিকশায় বসে থাকা সামিয়ার গায়েও। গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান তিনিও। এ ঘটনায় টিপুর স্ত্রী ফারহানা ইসলাম ডলি বাদী হয়ে মামলা করেছেন।

সামিয়া আফরান
ছবি: সংগৃহীত

তবে সামিয়ার পরিবারের পক্ষ থেকে মামলা করার কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। জামাল উদ্দিন বলেন, ‘মামলা করার সামর্থ্যই আমাদের নাই। এ জন্য মামলার চিন্তাভাবনাও ছিল না। টিপুর স্ত্রী যে মামলা করেছেন, ওটার বিচার হলে আমাদেরটারও বিচার হয়ে যাবে। অপরাধের শাস্তি তার পাইতেই হবে। এ দুনিয়ায় না হলে আরেক দুনিয়ায় হবে। দোষীদের বিচার হলে মনে একটু শান্তি পাব।’

সামিয়ার জন্মের ১০ দিন পর তাঁর নানা মারা যান। তারপর থেকে তাঁর নানু সামিয়াকে আগলে রেখেছিলেন। তিন বছর আগে সামিয়ার নানু মারা যান। সামিয়ার বাবা বলেন, নানুর মৃত্যুর পর সামিয়া অন্য রকম হয়ে যান। লেখাপড়াও ঠিকমতো করেননি। অন্যদিকে সংসারে অভাব–অনটন ছিল। এ অবস্থায় এসএসসি পাসের পর সামিয়া পড়াশোনায় অনিয়মিত হয়ে পড়েন।

আরও পড়ুন

আর্থিক টানাটানির কথা বলতে গিয়ে জামাল উদ্দিন বলেন, ‘লেখাপড়া সবার হয় না। দুটি শিক্ষক রাখলে ১০ হাজার টাকা দিতে হয়। আমরা খাব, বাসা ভাড়া দেব, নাকি শিক্ষকের বেতন দেব? ছেলে পড়ে সাড়ে চার হাজার টাকা দিই। ওর মামা ও খালা প্রতি মাসে সহযোগিতা করে। এ কারণে ঢাকায় টিকে আছি।’

সামিয়া গত দুই বছর কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে পরিবারের পাশে থাকার চেষ্টা করেছেন। আগামী ১ এপ্রিল একটি চাকরিতে ১৫ হাজার টাকা বেতনে যোগ দেওয়ার কথা ছিল তাঁর। জামাল উদ্দিন বলেন, ‘ও চাকরিতে যোগ দিলে একটু আর্থিক সাপোর্ট পাওয়া যেত। সেটা তো আর হলো না।’

আরও পড়ুন
সামিয়াকে ছাড়া একা কীভাবে থাকবেন ভাবেতই পারছেন না মা
ছবি: প্রথম আলো

যুব উন্নয়নে কম্পিউটার প্রশিক্ষণও নিচ্ছিলেন সামিয়া। তাঁর লক্ষ্য ছিল প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর ফ্রিল্যান্সিংয়ের মাধ্যমে আয় করার। জামাল উদ্দিন বলেন, ‘মেয়ে কম্পিউটার প্রশিক্ষণ নিচ্ছিল। আবার ছেলেও এবার এসএসসি পরীক্ষা দেবে। আমাদের চিন্তাভাবনা ছিল, তিন-চার মাস পর একটি ল্যাপটপ কিনে দেব। যাতে ওরা ভাইবোন বাসায় বসে ফ্রিল্যান্সিংয়ের মাধ্যমে আয় করতে পারে।’

জামাল উদ্দিন বলেন, ‘মেয়েকে আর ফিরে পাব না। মৃত্যুর আগপর্যন্ত মেয়ে হারানোর বেদনা থেকে যাবে। ঢাকা মেডিকেলে যাওয়ার পর প্রথম মেয়ের মৃতদেহ দেখলাম, হিমাগার থেকে বের করার পর দেখলাম, গোসলের আগে দেখলাম। দাফনের জন্য নিজে নামাইলাম কবরস্থানে। এই স্মৃতি অন্য রকম বেদনাদায়ক। এটা ভোলার না।’

সামিয়াদের বাসায় সোমবার তাঁর মামা-মামি, খালাসহ অন্য আত্মীয়স্বজন ছিলেন। সামিয়ার মা হোসনে আরা বলেন, ‘আমার ছোট বোন, ওর (সামিয়া) মামা-মামি চলে গেলে আমি তো একা হয়ে যাব। সামিয়াকে ছাড়া ওরা চলে গেলে আমি কীভাবে একা একা থাকব।’