মানবতায় ঈদের আনন্দ
রিকশাচালক রমজান আলীর পরিবারে বৃদ্ধ মা-বাবা, স্ত্রী ও তিন সন্তান। সবাই থাকেন চুয়াডাঙ্গায়। নিজের সীমিত সামর্থ্যে পরিবারের সবার জন্যই ঈদের নতুন পোশাক কেনার চেষ্টা করেছেন রমজান। এত সব কেনাকাটার পর আর নিজের পোশাক কেনার টাকা নেই তাঁর কাছে।
ভেবেছিলেন পুরোনো যা আছে, তাতেই ঈদটা কাটিয়ে দেবেন। গত শুক্রবার দুপুরে রিকশা নিয়ে উত্তরা হাউস বিল্ডিং এলাকা দিয়ে যেতে যেতে হুট করে তাঁর নজরে পড়ল রাস্তার পাশের দেয়ালে কিছু পোশাক ঝুলছে। একেবারে নতুন নয়, তবে পুরোনো কিংবা ব্যবহারের অনুপযোগীও নয়।
রিকশাটি দাঁড় করিয়ে সেদিকে তাকিয়ে ছিলেন কিছুক্ষণ। পাশ থেকে একজন বললেন, ‘যান, কাছে গিয়ে দেখেন, কী নেবেন?’ রমজান কাছে গিয়ে কিছুক্ষণ বেছে একটি সাদা শার্ট নিলেন। পাশে দাঁড়ানো অন্য রিকশাচালক বলছিলেন, ‘লুঙ্গি বা প্যান্টও নেন একটা।’ রমজানের উত্তর, ‘থাক, এই সাদা শার্টই চলব, এইটা গায়ে দিয়েই এবার ঈদের নামাজে যামু।’
হাউস বিল্ডিং এলাকায় উত্তরা ইউনিভার্সিটির তৈরি মানবতার দেয়াল থেকে নিজের জন্য একটি পোশাক নিয়ে সন্তুষ্ট রমজান আলী। কারণ, তাঁর মতো স্বল্প আয়ের ও অভাবী মানুষেরাও এভাবেই নিজেদের প্রয়োজনীয় চাহিদা মেটাবেন।
রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার পাড়া-মহল্লায় তৈরি ‘মানবতার দেয়াল’ ঈদকে ঘিরে ভরে উঠেছে নানান পোশাকে। কাপড়গুলো পুরোনো নয়। হয়তো কোনো কারণে ওই কাপড় ব্যবহার করা হচ্ছিল না। আশপাশের বাসিন্দাদের এমন উদারতায় রঙিন হচ্ছে মানবতার দেয়াল। উদ্যোক্তা আর এলাকাবাসীরা বলছেন, ঈদকে ঘিরে অনেকেই নিজেদের অপ্রয়োজনীয় কাপড় বেশি করে রেখে যাচ্ছেন। স্বল্প আয়ের লোকজনও অন্য সময়ের চাইতে বেশি করে আসছেন কাপড় নিতে।
সামাজিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, মহল্লার যুবসমাজ, পঞ্চায়েত কমিটি, বাড়ি কিংবা ফ্ল্যাট মালিক সমিতি প্রভৃতি সংগঠনের উদ্যোগে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় মানবতার দেয়াল প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। উত্তরার একাধিক সেক্টর, কাকলী বাসস্ট্যান্ড, বনানী, মহাখালী, বাড্ডা, নতুনবাজার, লালবাগ, গ্রিন রোড, ফার্মগেট ও ধানমন্ডিতে থাকা এমন দেয়ালের সামনে দেখা যায়, স্থানীয় বিত্তশালী ও মধ্যবিত্ত অনেকেই এই দেয়ালে নিজেদের এবং পরিবারের সদস্যদের অপ্রয়োজনীয় কিন্তু ব্যবহার করার মতো পোশাক রেখে যাচ্ছেন। এর পাশাপাশি ওই দেয়ালে আবার এমন অনেকেই আসছেন, যাঁদের প্রয়োজন। তাঁরা নিজেদের পছন্দমতো পোশাক বাছাই করে নিয়ে যাচ্ছেন।
>ঈদের আগে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় মানবতার দেয়ালে পোশাক রাখা বেড়েছে
এতে উপকৃত হচ্ছেন স্বল্প আয়ের মানুষ
বাড্ডা উচ্চবিদ্যালয় সড়কে থাকা মানবতার দেয়ালে পরিবারের সদস্যদের অপ্রয়োজনীয় কাপড়গুলো রেখে যাচ্ছিলেন ইলোরা জামান। তিনি বলেন, ‘বাচ্চাদের কিছু কাপড় আর কিছু শাড়ি, প্যান্ট রেখে যাচ্ছি। এগুলো যে কেউ ভালোভাবে ব্যবহার করতে পারবে। আমার দুই ছেলের বয়স এখন সাত আর পাঁচ বছর। তাদেরই বেশি কাপড় এখানে আছে।’
উত্তরার সোনারগাঁও জনপথ সড়কে মানবতার দেয়াল থেকে একটি পাঞ্জাবি নিতে দেখা যায় নিরাপত্তা প্রহরী সেলিম মিয়াকে। তিনি বলেন, ‘এই ঈদে একটি নতুন পাঞ্জাবি কিনলেই পাঁচ শ-এক হাজার টাকা লাগবে। আমি এমনিতেই পেয়ে গেলাম। এতেই আমার উপকার হলো।’
লালবাগ স্পোর্টিং ক্লাবের উদ্যোগে তৈরি মানবতার দেয়াল থেকে নিজের জন্য কাপড় নেন এক মধ্যবয়সী নারী। তিনি বলেন, ‘মানুষের বাড়িতে কাজ করে সংসার চালাই। এই জায়গা থেকে একটা জামা নিলাম। জামাটা নতুনই আছে।’ ঈদের দিন বাইরেও পরা যাবে বলে তিনি জানান।
উত্তরা ১২ নম্বর সেক্টর কল্যাণ সমিতির তত্ত্বাবধানে পার্কসংলগ্ন এলাকায় গতকাল শনিবার মানবতার দেয়ালের আদলে চালু করা হয় ‘সহানুভূতির দেয়াল’। শুরুর পর থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সহায়তায় দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এই খবর। বিকেলের মধ্যেই জমে যায় বেশ কিছু পোশাক। দরিদ্র অনেক মানুষ সেখানে এসে পছন্দমাফিক নিজের প্রয়োজনীয় পোশাক নিয়ে যেতে থাকেন।
মানবতার দেয়াল একটি মানবিক উদ্যোগ। যাঁদের অতিরিক্ত কিংবা অব্যবহৃত পোশাক আছে, সেগুলো একটি নির্দিষ্ট দেয়ালে লাগানো হুকে ঝুলিয়ে রাখা হয়। আর যাঁদের প্রয়োজন, তাঁরা এসে এই দেয়াল থেকে পছন্দমতো প্রয়োজনীয় কাপড়টি নেন।