ভাষাসৈনিকদের নামে পরিচিতি পেল না সড়কগুলো
ঢাকার উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ১৫টি সড়কের নাম করা হয়েছে ভাষাশহীদদের নামে। কিন্তু সড়কগুলো সেসব নামে পরিচিতি পায়নি।
অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশন ভাষাসৈনিকদের নামে ১৫টি সড়কের নামকরণ করে। ১৪ বছরেও সেসব সড়ক তাঁদের নামে পরিচিতি পায়নি। সড়কগুলো এখনো নম্বর দিয়েই চেনে লোকে। সেসব সড়কের বাসাবাড়ি, দোকানপাট সবই নম্বর দিয়ে পরিচিত। ভাষাসৈনিকদের নামের ফলক ও ম্যুরালগুলোও বেহাল। কোথাও কোথাও পোস্টারে ঢাকা পড়েছে, ময়লা–আবর্জনায় ভরে গেছে। কোথাও মুছে গেছে ম্যুরালের লেখা।
ভাষাসৈনিকদের নামে সড়কগুলো উদ্বোধন করা হয় ২০০৬ থেকে ২০০৭ সালের মধ্যে। ঢাকা সিটি করপোরেশন উত্তর ও দক্ষিণে ভাগ করার বিল জাতীয় সংসদে পাস হয় ২০১১ সালের নভেম্বরে। ১৫টি সড়কের মধ্যে ১৪টিই পড়েছে দক্ষিণ সিটিতে। সড়কগুলো রয়েছে ধানমন্ডির বিভিন্ন এলাকায়। অপর সড়কটি রয়েছে টেকনিক্যাল মোড়ে। এটি ঢাকা উত্তর সিটির মধ্যে পড়েছে। ধানমন্ডির চারটি সড়কে চারজন ভাষাসৈনিকের নামে বিভিন্ন বেসরকারি ব্যাংকের উদ্যোগে চারটি ম্যুরাল তৈরি করা হয়। সেগুলোর অবস্থাও এখন সঙিন।
ধানমন্ডি ১ নম্বর এলাকার সড়কের নামকরণ করা হয়েছিল ভাষাসৈনিক ডা. গোলাম মাওলার নামে। সায়েন্স ল্যাবরেটরি মোড়ে পদচারী–সেতুর নিচে রয়েছে তাঁর একটি ম্যুরাল। সেখানে এখন হকার বসেন, ভ্রাম্যমাণ মানুষজন ঘুমান। ম্যুরালটির আশপাশে রিকশার অনেক ভিড় থাকে। সহজে ম্যুরালটি চোখে পড়ে না। এ সড়কে নিয়মিত রিকশা চালান জসিম মিয়া। তিনি বলেন, ‘কোনো মানুষের নামে এই রাস্তার নাম, তা শুনি নাই। আমরা ১ নাম্বার রাস্তাই কই।’
ধানমন্ডিতে আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ দ্য ঢাকার দেয়ালের সঙ্গে রয়েছে একটি নামফলক। তাতে লেখা ‘ভাষাসৈনিক মোহাম্মদ সুলতান সড়ক’। উদ্বোধনের সময়কাল ও উদ্বোধকের নাম ছাড়া ফলকে আর কোনো তথ্য নেই। এই সড়ক পড়েছে ধানমন্ডি ৩ নম্বর এলাকায়। স্থানীয় লোকজন বলেছেন, এখন সড়কটিকে ৩ নম্বর সড়ক নামেই চেনেন। ভাষাসৈনিকের নামে সড়কটির নামকরণের কথা তাঁরা ভুলেই গেছেন।
ধানমন্ডি ৪ নম্বর এলাকায় ভাষাসৈনিক অলি আহাদ সড়ক, ৫ নম্বর এলাকায় ভাষাসৈনিক আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশ সড়ক এবং ৬ নম্বর সড়ক ভাষাসৈনিক আবুল কালাম শামসুদ্দিন সড়কের অবস্থান। তিনটি সড়কেই নামফলকে শুধু সড়কের নাম, উদ্বোধনের সময়কাল ও উদ্বোধকের তথ্য আছে। এর বাইরে সংশ্লিষ্ট ভাষাসৈনিকদের সম্পর্কে কোনো তথ্য নেই। ৬ নম্বর এলাকায় রয়েছে ভাষাসৈনিক আবুল কালাম শামসুদ্দিন সড়ক। নামফলকটা পোস্টার ও ময়লায় ঢাকা। ভাষাসৈনিকের নামের অর্ধেকটা বোঝা যায় না। এই অংশটা কালচে হয়ে গেছে।
ধানমন্ডি ১ নম্বর এলাকায় ভাষাসৈনিক ডা. গোলাম মাওলা ছাড়াও ধানমন্ডি ৭ নম্বরে ভাষাসৈনিক আবদুল মতিন সড়কে তাঁর নামে একটি ম্যুরাল আছে। তাতে এই ভাষাসৈনিকের ছবি, পরিচিতি এবং ভাষা আন্দোলনের সময়ে তাঁর ভূমিকার কথা উল্লেখ আছে। ধানমন্ডি ৮ নম্বরকে ভাষাসৈনিক গাজীউল হক সড়ক করা হয়েছে। তাঁর একটি ছবি দিয়ে ম্যুরালও রয়েছে। তবে ম্যুরালের লেখা প্রায় মুছে গেছে। লেখাগুলো পড়া যায় না।
ধানমন্ডি ৯ ও ১০ নম্বরে সড়কের নামকরণ করা হয়েছে ভাষাসৈনিক কাজী গোলাম মাহবুবের নামে। ৯ নম্বর সড়কে একটি ম্যুরাল থাকলেও তার সামনে একটি নার্সারির দোকান বসে। ৯ নম্বর সড়কে ভাষাসৈনিক কাজী গোলাম মাহবুবের ম্যুরালের ছবি, পরিচিতি এবং ভাষা আন্দোলনের ভূমিকার কথা লেখা আছে। এ ছাড়া ১০ নম্বর সড়কের ফলকে তাঁর বিষয়ে ছোট্ট করে লেখা রয়েছে।
ধানমন্ডি ৯/এ ভাষাসৈনিক তোয়াহা, ধানমন্ডি ১৫ নম্বরে ভাষাসৈনিক বিচারপতি আবদুর রহমান চৌধুরী, ধানমন্ডি ১২ নম্বরে ভাষাসৈনিক অধ্যাপক সুফিয়া আহমেদ, ধানমন্ডি ১৩ নম্বরে ভাষাসৈনিক অধ্যাপক সাফিয়া খাতুন, ধানমন্ডি ৫/এ ভাষাসৈনিক কামরুদ্দীন আহমদ এবং ধানমন্ডি ৪/এ ভাষাসৈনিক শওকত আলীর নামে নামকরণ করা হয়।
সড়কগুলোতে অবস্থিত বাড়ির নামফলকে নম্বর ধরে সড়কের নাম লেখা। ভাষাসৈনিকদের নামে তা করা হয়নি। এসব সড়কের দোকানগুলোতেও একই অবস্থা। ভাষাসৈনিকদের পাওয়া যাবে শুধু সড়কের মাথার ফলকে। যেগুলো প্রায় সময়েই পোস্টার, ময়লাঢাকা থাকে। অনেকগুলো হকারদের দোকানের কারণে চোখেও পড়ে না।
ধানমন্ডি ৮ নম্বর সড়কের বাসিন্দা আবু ফয়সাল ম্যুরাল দেখে জেনেছেন সড়কটির নাম কাজী গোলাম মাহবুবের নামে। কিন্তু তিনি বলেন, ‘বীরদের নামে এসব সড়ক হলেও আসলে সেভাবে পরিচিত পায়নি সড়কগুলো। বেশির ভাগ মানুষই জানে না। সবাই সড়কের নম্বর ধরেই চেনে।’ তবে এটাকে দুঃখজনক বলে উল্লেখ করেন তিনি।
ভাষাসৈনিক অলি আহাদ সড়কে অবস্থিত একটি দোকানের বিক্রয়কর্মীকে সড়কের নামের বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, তিনি কখনোই শোনেননি সড়কটি কোনো ভাষাসৈনিকের নামে। তিনি ৪ নম্বর সড়ক হিসেবেই জানেন।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের অধীনে টেকনিক্যাল মোড় থেকে মিরপুর ১ নম্বর পর্যন্ত সড়কের নামকরণ করা হয়েছে ভাষাসৈনিক প্রিন্সিপাল আবুল কাসেমের নামে। টেকনিক্যাল মোড় থেকে মিরপুর সড়কে যেতে শুরুতে এই ভাষাসৈনিকের নামে একটি ফলক আছে। যদিও সড়কটি পরিচিত দারুস সালাম সড়ক হিসেবে।
গুগলের ইনস্ট্যান্ট স্ট্রিট ভিউতে দেখা যায়, ভাষাসৈনিকদের নামে এই ১৫টি সড়কের কোনোটিই তাঁদের নামে চিহ্নিত নয়। ১৪টিই নম্বর ধরে লেখা এবং উত্তর সিটির সড়কটি দারুস সালাম সড়ক হিসেবে লেখা।
কথাসাহিত্যিক ও বাংলাদেশ ইতিহাস অলিম্পিয়াড জাতীয় কমিটির সভাপতি সেলিনা হোসেন এ বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘সিটি করপোরেশনকে তো নাম বানিয়ে ছেড়ে দিলে হবে না। তদারকি করতে হবে। মানুষেরও চেতনা থাকতে হবে। যাঁরা বাস করেন, তাঁদেরও দায়িত্ব রয়েছে। ভাষাসৈনিকদের সম্মানজনক জায়গা তৈরি করতে হবে।’
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এ বি এম আমিন উল্লাহ নুরী প্রথম আলোকে বলেন, ভাষাসৈনিকদের নামফলকের মর্যাদা সমুন্নত রাখার দায়িত্ব সবার। সড়কের নামফলক সংরক্ষণে নিজ নিজ অবস্থান থেকে দায়িত্ব পালনের জন্য নাগরিকদের প্রতি অনুরোধ জানান তিনি। কোনো সড়কের নামফলক ক্ষতিগ্রস্ত হলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন তা জরুরি ভিত্তিতে সংস্কার করবে বলে জানান তিনি।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সেলিম রেজা প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের অধীনে যে সড়ক আছে, সেগুলোর পরিচিতি বাড়াতে তাঁরা উদ্যোগ নেবেন। পাশাপাশি আরও সড়ক ভাষাসৈনিকদের নামে করারও উদ্যোগ নেবেন।