শাহজালাল বিমানবন্দর
বিমানবন্দরে অব্যবস্থাপনার শেষ নেই, ‘দায়’ বিমানের
মন্ত্রণালয় চিঠি দিয়ে বিমানকে বলেছে, তাদের লোকবল, তদারকি ও পরিকল্পনার অভাবে বিমানবন্দরে গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং ব্যবস্থাপনা স্থবির হয়ে পড়েছে।
হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অব্যবস্থাপনার কারণে ব্যাপক ভোগান্তির মুখে পড়ছেন যাত্রীরা। রাতে আট ঘণ্টা ফ্লাইট চলাচল বন্ধ করার পর এ ভোগান্তি অনেক বেড়েছে। একই কারণে বিলম্বে ফ্লাইট ছাড়ার ঘটনাও ঘটছে। এ জন্য বিমানবন্দরের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের দায়িত্বে থাকা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসকে দায়ী করেছেন অংশীজনেরা।
এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বেসামরিক বিমান পরিবহন মন্ত্রণলায় ১৩ ডিসেম্বর বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে (এমডি) চিঠি দিয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং ব্যবস্থাপনায় লোকবল ও সরঞ্জাম (ইকুইপমেন্ট) সংকট চলছে। এর কার্যক্রম তদারকি ও সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার অভাবও দেখা গেছে। সুষ্ঠু পরিকল্পনা না থাকায় বিমানবন্দরে গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং ব্যবস্থাপনা স্থবির হয়ে পড়েছে।
এখন প্রতিদিন ২৭টি এয়ারলাইনসের ১১০ থেকে ১২৮টি ফ্লাইট শাহজালাল বিমানবন্দরে ওঠানামা করে। এসব ফ্লাইটে দৈনিক প্রায় ২০ হাজার যাত্রী যাতায়াত করেন। এই বিপুলসংখ্যক যাত্রী এবং এয়ারলাইনগুলোকে প্রয়োজনীয় সেবা দেওয়ার জন্য বিমানের পর্যাপ্তসংখ্যক জনবল ও সরঞ্জাম নেই।
শাহজালাল বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ ও বিভিন্ন এয়ারলাইনসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের আওতায় প্রতিটি এয়ারলাইনের যাত্রীদের চেক-ইন কাউন্টার সামলানো, বোর্ডিং, উড়োজাহাজে মালামাল ওঠানো–নামানো, যাত্রীসেবা, প্রকৌশল সেবা এবং জিএসই (গ্রাউন্ড সার্ভিস ইকুইপমেন্ট) সেবা দেওয়ার দায়িত্ব বিমানের। নির্দিষ্ট হারে ফি দেওয়া হয়। আর এটা তদারকির দায়িত্বে থাকেন বিমানের একজন মহাব্যবস্থাপক (এয়ারপোর্ট সার্ভিস)। কিন্তু বিমান পর্যাপ্ত জনবল, যন্ত্রপাতি বা সরঞ্জাম ও তদারকির অভাবে এসব কার্যক্রম সম্প্রতি ব্যাপকভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে। ফলে যাত্রী দুর্ভোগ এবং ফ্লাইট বিলম্বের ঘটনা বাড়ছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, বিমানবন্দরে একসঙ্গে তিনটি আন্তর্জাতিক ফ্লাইট এসে নামলে যাত্রীসেবা এলোমেলো হয়ে পড়ে। একটি মাত্র স্ক্যানিং যন্ত্র থাকার কারণে বিদেশফেরত যাত্রীদের লাগেজ স্ক্যানিংয়ে সময় লাগে। সেখানে যাত্রীদের দীর্ঘ সারিতে পড়তে হয়। উড়োজাহাজ থেকে বেল্টে মালামাল আসতে বেশি সময় লেগে যায়। মধ্যপ্রাচ্য ও কলকাতা থেকে আসা যাত্রীদের তল্লাশির মুখে পড়তে হয় বেশি। গত বৃহস্পতিবার দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে বেলা ১টা ২৫ পর্যন্ত সময়ে নয়টি আন্তর্জাতিক ফ্লাইট বিমানবন্দরে এসে নামে। এর মধ্যে ছয়টি ফ্লাইট মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে আসা। এ সময় যাত্রী ও লাগেজের চাপ সামাল দিতে হিমশিম খান বিমানবন্দরের কর্মীরা।
ওমানের মাসকাট থেকে আসা নোয়াখালীর মো. ইব্রাহিম প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর ফ্লাইটটি অবতরণ করে বৃহস্পতিবার বেলা ১টা ১০ মিনিটে। বিমানবন্দরের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে তাঁর বের হতে বেলা সোয়া তিনটা বেজে যায়। ইব্রাহিম বলেন, ‘বিমানবন্দরের ভেতরে খুব বাজে অবস্থা। আমরা প্রবাসীরা এত কষ্ট করে দেশে টাকা পাঠাই। অথচ দেশে এলেই ভোগান্তিতে পড়তে হয়।’
বিমানবন্দরে যাত্রীসেবার এ অব্যবস্থাপনা ব্যাপকভাবে দেখা দিয়েছে ১০ ডিসেম্বর থেকে। তৃতীয় টার্মিনালের সংস্কারকাজের জন্য ওই দিন থেকে শাহজালাল বিমানবন্দরে ছয় মাসের জন্য রাতে আট ঘণ্টা (রাত ১২টা–সকাল ৮টা) ফ্লাইট ওঠানামা বন্ধ রাখা হয়েছে। ২৪ ঘণ্টার ফ্লাইটসূচি পরিবর্তিত হয়ে ১৬ ঘণ্টায় এসেছে। এখন প্রতি ঘণ্টায় ৯ থেকে ১২টি ফ্লাইট ওঠানামা করছে। ফলে বিমানবন্দরে যাত্রীর চাপ বেড়ে গেছে। চেক–ইন কাউন্টার, ইমিগ্রেশন, বোর্ডিং, লাগেজ বেল্ট—সর্বত্র লম্বা লাইন। কোনো ক্ষেত্রে বিশৃঙ্খল অবস্থা চলছে। প্রায় প্রতিদিনই ফ্লাইট বিলম্ব হচ্ছে।
বিমানবন্দর সূত্র জানায়, এখন প্রতিদিন ২৭টি এয়ারলাইনসের ১১০ থেকে ১২৮টি ফ্লাইট শাহজালাল বিমানবন্দরে ওঠানামা করে। এসব ফ্লাইটে দৈনিক প্রায় ২০ হাজার যাত্রী যাতায়াত করেন। এই বিপুলসংখ্যক যাত্রী এবং এয়ারলাইনগুলোকে প্রয়োজনীয় সেবা দেওয়ার জন্য বিমানের পর্যাপ্তসংখ্যক জনবল ও সরঞ্জাম নেই। সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মী প্রথম আলোকে বলেন, অল্প জনবল দিয়ে বিশাল কর্মযজ্ঞ সামাল দিতে গিয়ে কর্মীদের নাভিশ্বাস ওঠার দশা। অতিরিক্ত চাপ নিয়ে কাজ করতে গিয়ে গত বৃহস্পতিবার এক কর্মী অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।
হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নির্বাহী পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ এইচ এম তৌহিদ-উল আহসান প্রথম আলোকে জানান, এই ব্যবস্থাপনা ঠিক করতে বিমানবন্দরের কর্তৃপক্ষ হিসেবে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসকে কয়েকবার জানানো হয়েছে।
এদিকে বাংলাদেশে চলাচলকারী ২৭টি বিমান সংস্থার সংগঠন এয়ারলাইন অপারেটরস কমিটি (এওসি) সূত্র জানিয়েছে, হজরত শাহজালাল বিমানবন্দরের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং ব্যবস্থাপনা ঠিকভাবে সামাল দিতে পারছে না বিমান। জনবল কম থাকায় বিমান সময়মতো প্রয়োজনীয় সেবা দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। অথচ গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং ব্যবস্থাপনার জন্য এয়ারলাইনগুলোকে ফ্লাইটপ্রতি সেবাভেদে ২ হাজার ২০০ থেকে সাড়ে ৫ হাজার মার্কিন ডলার পর্যন্ত বিমানকে দিতে হয়।
এওসির সদস্য ও একটি বিদেশি বিমান সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, ‘গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ে দেরির কারণে প্রতিদিন আন্তর্জাতিক ফ্লাইটগুলো এক থেকে দুই ঘণ্টা দেরি হচ্ছে। কোনো কোনোটি তিন থেকে সাড়ে তিন ঘণ্টা দেরি হচ্ছে। অথচ বিমানকে আমরা টাকা দিয়ে থাকি সময়মতো এগুলো করতে।’
গত বৃহস্পতিবার ফ্লাইটসূচি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, এদিন এক ঘণ্টার বেশি বিলম্বিত হয়েছে ১৬টি ফ্লাইট, দুই ও তিন ঘণ্টা বিলম্ব হয়েছে দুটি ফ্লাইট এবং চার ঘণ্টার বেশি বিলম্বিত হয়েছে সাতটি ফ্লাইট। দেরি হওয়া এসব ফ্লাইট কুয়েত, দোহা, সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন গন্তব্যের।
গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ে অব্যবস্থাপনা ও বিশৃঙ্খলার বিষয়ে জানতে চাইলে বিমানের মহাব্যবস্থাপক (এয়ারপোর্ট সার্ভিস) আজিজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিমানবন্দরের পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা চলছে। আমরা দম নেওয়ার সুযোগও পাচ্ছি না।’
যদিও সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, বিমানের এই মহাব্যবস্থাপক এর আগে প্রতিটি প্রস্তুতি বৈঠকে বলেছিলেন, আট ঘণ্টা ফ্লাইট বন্ধের কারণে বাকি সময়ে যে চাপ বাড়বে, সেটা সামাল দেওয়ার সব প্রস্তুতি তাঁদের আছে।
বর্তমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য বিমানকে জরুরি ভিত্তিতে তিনটি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে বলা হয়েছে গত ডিসেম্বরে দেওয়া বেসামরিক বিমান পরিবহন মন্ত্রণালয়ের চিঠিতে। এগুলো হলো: গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের জন্য পর্যাপ্ত জনবল নিয়োগ দেওয়া; প্রয়োজনে অন্য কোনো দক্ষ সরকারি সংস্থা থেকে সাময়িকভাবে তাৎক্ষণিক জনবল নিয়োগ দেওয়া, জরুরি সরঞ্জাম সংগ্রহ ও মেরামত এবং পর্যাপ্ত সরঞ্জাম সংগৃহীত না হওয়া পর্যন্ত ফ্লাইট টু ফ্লাইট তদারকির জন্য দক্ষ কর্মকর্তা নিয়োগ ও তদরকি কর্মকর্তাকে বিমানের প্রধান কার্যালয়ে অবস্থান না করে সার্বক্ষণিক বিমানবন্দরে অবস্থান করা।
১২ ডিসেম্বর বিমানবন্দরের পরিস্থিতি সরেজমিনে দেখতে আসেন বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুব আলী। তিনি অব্যবস্থাপনার দায় স্বীকার করে ক্ষমা চান এবং গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ে বিমানের সক্ষমতা কম থাকার বিষয়ে ক্ষোভ জানান।
হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সাবেক পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন (অব.) এম কে জাকির হাসান প্রথম আলোকে বলেন, বিমানবন্দরের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং ব্যবস্থাপনার সমস্যাগুলো পুরোনো। এ ব্যবস্থাপনার পুরো দায়িত্ব বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের। আপাতত ব্যবস্থাপনার পরিস্থিতি উন্নয়ন করতে ভালোভাবে তদারকি করতে হবে। এর জন্য যথাযথ দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের আরও উদ্যোগ ও সদিচ্ছা প্রয়োজন।