ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল বিভাগের সাবেক অধ্যাপক নজরুল ইসলাম দেশের অন্যতম নগরবিদ। শহরকেন্দ্রিক নানা গবেষণার জন্য তিনি সেন্টার ফর আরবান স্টাডিজ নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যানের দায়িত্বও পালন করেছেন। সাম্প্রতিক সময়ে আলোচিত কলাবাগানের তেঁতুলতলা মাঠ এবং রাজধানীর আবাসিক এলাকাগুলোর মাঠসহ অন্যান্য নাগরিক সুবিধা নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি ইফতেখার মাহমুদ।
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: কলাবাগানের ছোট একটি মাঠ রক্ষায় এত আন্দোলন দরকার হচ্ছে কেন?
অধ্যাপক নজরুল ইসলাম: ঢাকার প্রতিটি আবাসিক এলাকায় মাঠ থাকতে হবে, এটা এই শহরের প্রতিটি মহাপরিকল্পনায় বলা আছে। আর যেকোনো শহরের জন্য এটা মৌলিক একটি বিষয়। এর জন্য আন্দোলন কেন করতে হবে? আর পুলিশের জন্য কেন একটি এলাকার একমাত্র মাঠটি নিতে হবে? তাদের জন্য তো অন্য কোনো জায়গা খুঁজে পাওয়া কঠিন কিছু না। ঢাকার বিভিন্ন স্থানে প্রচুর সরকারি ভবন আছে। সেগুলো নানা ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। বেশ কটি মাঠ প্রভাবশালীরা দখল করে আছেন। কলাবাগানে খুঁজেও এমন মাঠ অবশ্যই পাওয়া যাবে। সেগুলো দখলমুক্ত করে সেখানে থানা করা হোক। শিশুদের খেলার মাঠে কেন তা করতে হবে।
পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর কাজ নাগরিকদের সুরক্ষা দেওয়া। মাঠের ক্ষেত্রে যদি বলি, তাদের উচিত কেউ যাতে প্রভাব খাটিয়ে এলাকার কোনো মাঠ দখল করতে না পারে, তা নিশ্চিত করা। কিন্তু তারা তা না করে নিজেরা একটি এলাকার একমাত্র মাঠ নিজেদের নামে বরাদ্দ নিয়ে নিল। এটা কোনোভাবে যৌক্তিক হতে পারে না। এলাকাবাসীর পক্ষে একজন নারী ও তাঁর সন্তান আন্দোলন শুরু করেছেন। এটা তো তাঁরা নিজেদের কোনো ব্যক্তিগত স্বার্থে করেননি। তাঁরা সামগ্রিক স্বার্থে বছরের পর বছর এই আন্দোলন করে আসছেন। পুলিশের উচিত ছিল তাঁদের এই দাবির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে এখানে ভবন নির্মাণ থেকে সরে আসা।
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: কিন্তু পুলিশ তো আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়া সৈয়দা রত্না ও তাঁর কিশোর সন্তানকে ধরে থানায় আটকে রেখেছিল?
নজরুল ইসলাম: পুলিশ তা কোনোভাবেই পারে না। এটা তো একধরনের ঔপনিবেশিক আচরণ। নাগরিকদের কোনো আচরণ বা দাবি পছন্দ না হলে তাঁকে ধরে নিয়ে যাওয়া তো আমরা ঔপনিবেশিক আমলে দেখেছি। একটি গণতান্ত্রিক সমাজে হতে পারে না। মাঠ রক্ষার দাবি ওঠার পরপরই ওই দাবির পক্ষের যৌক্তিকতা বোঝার জন্য এলাকাবাসীর সঙ্গে মেয়র কথা বলতে পারতেন, পুলিশ বাহিনীর সঙ্গে আলাপ করে সমস্যাটির সমাধান করা যেত। তা না করে কেন এলাকাবাসীর সঙ্গে একটি সাংঘর্ষিক জায়গায় যেতে হলো তা আমি বুঝতে পারলাম না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এখন বলছেন বিকল্প জায়গা খুঁজতে। এটা আগেই করা যেত। তবে দেরিতে হলেও তিনি তা বুঝতে পেরেছেন।
আশা করি, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিকল্প কোনো জায়গা খুঁজে পাবে। কিন্তু কোনোভাবেই ওই মাঠে ভবন নির্মাণ করা ঠিক হবে না। পুলিশের উচিত নিঃশর্তভাবে মাঠে ভবন নির্মাণের কাজ বন্ধ করা। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর উচিত এক্ষুনি মাঠে ভবন নির্মাণকাজ বন্ধ করে দেওয়া। মাঠটিকে বাচ্চাদের খেলা ও এলাকাবাসীর সামাজিক কাজের জন্য ছেড়ে দেওয়া। এর মধ্যে অন্য কোনো শর্ত বা ‘তবে–কিন্তু’র সুযোগ নেই।
প্রশ্ন :
ঢাকা শহরের অন্য এলাকাগুলোতেও মাঠ নিয়ে একই ধরনের সমস্যা আছে।
নজরুল ইসলাম: আমরা যারা ধানমন্ডি এলাকায় থাকি, তারা শুরু থেকে জানি এখানকার মাঠগুলো এলাকাবাসীর জন্য রাখা হয়েছে। মূল পরিকল্পনাতেও তাই ছিল। দীর্ঘ সময় এলাকাবাসী ওই মাঠগুলোকে খেলাধুলা ও নানা সামাজিক কাজে ব্যবহার করেছেন। বিশ্বের বেশির ভাগ শহরের আবাসিক এলাকার এটাই নিয়ম। এটাই একটি আধুনিক ও নাগরিকবান্ধব শহরের চরিত্র। কিন্তু আমরা দেখেছি ধানমন্ডি খেলার মাঠ বেসরকারি মালিকানাধীন ফুটবল–ক্রিকেট দলের নামে দিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেখানে ভবন নির্মাণের পরিকল্পনার কথাও শুনেছি। আমরা একসময় এই মাঠগুলোকে এলাকাবাসীর জন্য সংরক্ষণের দাবিতে আন্দোলন করেছি। তখনো আমাদের বিরুদ্ধে পুলিশ হামলা করেছে। উত্তরাসহ অন্যান্য পরিকল্পিত আবাসিক এলাকাগুলো প্রভাবশালী মহল নানা নামে মাঠগুলো ব্যবহার করেছে; যা পরোক্ষভাবে দখলেরই নামান্তর।
প্রশ্ন :
ঢাকার ধানমন্ডি, উত্তরা বা মিরপুরের মতো পরিকল্পিত আবাসিক এলাকাগুলোর বাইরেও পুরান ঢাকাসহ অনেক এলাকায় মাঠ ছিল। সেগুলোর কী অবস্থা?
নজরুল ইসলাম: প্রভাবশালীরা সব সময় সরকারি খালি জমি ও মাঠগুলো দখলের চেষ্টা করেছে। অনেক ক্ষেত্রে তারা সফলও হয়েছে। ঢাকার দুই মেয়র রাজধানীর মাঠগুলোকে উদ্ধার করে নাগরিক ও এলাকাসীর জন্য উন্মুক্ত করার উদ্যোগ নিয়েছেন। দেশের খ্যাতনামা স্থপতি ও পরিকল্পনাবিদদের ওই কাজে যুক্ত করেছেন। এটা তো খুবই ভালো উদ্যোগ। কলাবাগানের মাঠ নিয়ে এত দিন ধরে আন্দোলন হচ্ছে, তাহলে মেয়ররা এটা নিয়ে কেন উদ্যোগ নিলেন না? তাঁরা তো এলাকাবাসী ও আন্দোলনকারী নাগরিকদের সঙ্গে কথা বলতে পারতেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তো মেয়রদের সঙ্গে কথা বলে বিষয়টির ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে পারতেন।
কলাবাগানের এই মাঠ রক্ষার আন্দোলন থেকে মেয়র, পুলিশ বাহিনীসহ সরকারি সংস্থাগুলো একটি শিক্ষা নিতে পারে। তা হচ্ছে আমাদের শহরের বাচ্চাদের জন্য মাঠ কত জরুরি। আমরা কি শিশুদের হাতে মোবাইল ফোন আর ল্যাপটপ দিয়ে ঘরে বসিয়ে রাখব? তা তো হতে পারে না। মাঠ না থাকলে তারা যাবে কোথায়। তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশে মাঠের বিকল্প নেই। আমাদের শহরের ভবনগুলো যেভাবে নির্মিত হচ্ছে, তাতে সেখানেও উন্মুক্ত জায়গা রাখা হচ্ছে না। শহরে গায়ের সঙ্গে গা মিশিয়ে বহুতল ভবন নির্মিত হচ্ছে। একটি সুষ্ঠু ও সুস্থ নগর এবং নাগরিক তৈরি করতে হলে রাজধানীর কোনো মাঠ অন্য কারও কাছে বরাদ্দ দেওয়া যাবে না। বরং আরও বেশি করে মাঠ দরকার।
প্রশ্ন :
ঢাকার মহাপরিকল্পনার মধ্যে কি যথেষ্টসংখ্যক মাঠ ও উন্মুক্ত স্থান রাখা হয়েছিল? সেগুলো কি বাস্তবায়িত হয়েছে?
নজরুল ইসলাম: উনিশ শতকের শুরুতে পেট্রিক গেডিস নামে একজন ব্রিটিশ পরিকল্পনাবিদ ঢাকা শহর নিয়ে একটি মহাপরিকল্পনা করেছিলেন। সেটি খুবই ভালো একটি পরিকল্পনা ছিল, সেখানে ঢাকার নদী, খাল ও জলাভূমি এবং সবুজ এলাকাগুলো সুরক্ষার কথা বলা হয়েছিল। ওই পরিকল্পনায় ঢাকা শহরজুড়ে প্রচুর উন্মুক্ত স্থান ও মাঠ রাখা হয়েছিল। ১৯৫৯ সালে একটি আন্তর্জাতিক সংস্থাকে দিয়ে আরেকটি পরিকল্পনা নেওয়া হয়। সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য আজকের রাজউকের আগের প্রতিষ্ঠান ডিআইটি তৈরি করা হয়।
তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী মতিঝিলকে বাণিজ্যিক এলাকা, গুলিস্তানে স্টেডিয়াম, ফুলবাড়িয়াতে রেলস্টেশন, তেজগাঁওকে শিল্পাঞ্চল আর ধানমন্ডিকে আবাসিক এলাকা হিসেবে নির্মাণ করা হয়েছিল। এই সব কটি এলাকায় প্রচুর মাঠ রাখা হয়েছিল। মতিঝিলের মতো বাণিজ্যিক এলাকার সরকারি আবাসিক এলাকায়ও প্রচুর মাঠ রাখা হয়েছিল। পরে মিরপুর ও উত্তরা এলাকাতে সংখ্যায় কম হলেও বেশ কয়েকটি মাঠ রাখা হয়। এসব মাঠের বেশির ভাগ আর এলাকাবাসী ব্যবহার করতে পারেন না। এর বাইরে কলাবাগান, খিলগাঁও, শ্যামলী, রায়েরবাজারসহ ছোট আবাসিক এলাকাগুলোতে খাসজমি ছিল। যেগুলো এলাকাবাসী মাঠ হিসেবে ব্যবহার করত। সেই মাঠগুলো এখন একের পর এক সরকারি–বেসরকারি সংস্থাগুলো দখল করছে। এটা খুবই অন্যায়, মেনে নেওয়া যায় না।
প্রশ্ন :
ঢাকার জনসংখ্যা অনুপাতে কী যথেষ্ট পরিমাণে মাঠ আছে?
নজরুল ইসলাম: আমরা ধরে নিতে পারি ঢাকার জনসংখ্যা প্রায় দেড় কোটি। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতে প্রতি এক হাজার মানুষের জন্য কমপক্ষে এক একর খোলা জায়গা থাকার নিয়ম রয়েছে। সেটি খেলাধুলা ও নানা নাগরিক কাজে ব্যবহৃত হবে। বিশ্বের অন্যতম জনবহুল দেশ হওয়ায় আমাদের পক্ষে তা সম্ভব না। কিন্তু তারপরও একটি শহরে ন্যূনতম ১০ হাজার মানুষের জন্য এক একর জায়গা ফাঁকা রাখা উচিত। সেটি মাঠ হিসেবে ব্যবহৃত হওয়া দরকার। শহরের প্রতিটি পাড়া–মহল্লায় অবশ্যই একটি করে মাঠ থাকা দরকার। আর কলাবাগানের যে এলাকাটিতে তেঁতুলতলা মাঠটি রয়েছে, সেখানকার জনসংখ্যা প্রায় তিন লাখ। তার মানে যে মাঠটি সেখানে আছে, তা মোটেও যথেষ্ট নয়। সরকারের উচিত সেখানে আরও বেশি মাঠ তৈরি করা। তা না করে উল্টো একমাত্র মাঠটি এলাকাবাসীর কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হচ্ছে।
প্রশ্ন :
শহরে প্রয়োজনীয় মাঠ নিশ্চিত করা এবং তা দখলমুক্ত রাখার দায়িত্ব কার?
নজরুল ইসলাম: অবশ্যই এটা সিটি করপোরেশনের দায়িত্ব। এই মাঠ নিয়ে যে আন্দোলন চলছে, তা দুই মেয়রের কারও চোখে কেন পড়ল না। এটা তো আমি বুঝতে পারলাম না। এমনকি তাঁরা এখনো মাঠগুলোর ব্যাপারে তেমন কিছু বলছেন না। শহরের অধিবাসীরা তাঁদের নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করার জন্য তাঁদের নির্বাচিত করেছেন। মাঠ তো একটি অন্যতম নাগরিক অধিকার। সেটা নিশ্চিত করার কাজে তাঁদের কেন পাওয়া যাচ্ছে না, সেটা আমার কাছেও বড় প্রশ্ন।
আমরা যখন ধানমন্ডির মাঠ রক্ষার আন্দোলন করেছি, তখনো আমরা মেয়রদের তেমন কোনো ভূমিকা পাইনি। আমাদের অনেক আন্দোলনকারীর বিরুদ্ধে মামলা পর্যন্ত হয়েছে। অনেককে নানাভাবে হয়রানির শিকার হতে হয়েছে। জামিলুর রেজা চৌধুরীসহ আমি নিজে সে সময় মাঠে নেমেছিলাম, মানববন্ধন করেছি। অনেক প্রভাবশালী চক্র আমাদের আন্দোলনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল। তখন বোঝা গেছে মাঠ দখলের সঙ্গে এসব চক্রের ব্যক্তিগত লাভের প্রশ্নটি জড়িত। এরা অনেক শক্তিশালী। তাই শেষ পর্যন্ত আমরাও ব্যর্থ হয়েছি। ধানমন্ডির মাঠগুলো এখন নানা নামে ব্যক্তিগত এবং করপোরেট মালিকানায় চলে গেছে।
প্রশ্ন :
মাঠ দখলের ধরনের কোনো পরিবর্তন দেখেছেন?
নজরুল ইসলাম: মাঠ দখলের জন্য প্রভাবশালীরা প্রথমে মাঠের কোণে কোনো একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে। অনেক ক্ষেত্রে ওয়ার্ড কাউন্সিলরের কার্যালয় স্থাপন করা হয়। এলাকাভিত্তিক প্রভাবশালীদের সঙ্গে অন্য প্রভাবশালীরা পরে যোগ দিয়ে নানা কূটকৌশলে মাঠগুলো আংশিক ও পুরোপুরি দখল করে। তবে এত দিন আমরা এসব বেসরকারি খাতের মাধ্যমে মাঠ দখলের চেষ্টা দেখেছি। এখন সরকারি সংস্থাগুলো মাঠ বরাদ্দ নিয়ে দখল করছে। আমি দখল বলছি এ কারণে যে জনগণের সম্পত্তি সরকার চাইলেই জোর করে কারও নামে বরাদ্দ দিতে পারে না। এ ব্যাপারে নাগরিকদের মতামত থাকতে পারে। সেটিকেও আমলে নিতে হবে। আমরা তো ধরে নিই সরকার জনস্বার্থে কাজ করবে। আর আমরা নাগরিকেরাও জনস্বার্থে মাঠ রক্ষার কথা বলছি। ফলে কোনটি আসল জনস্বার্থ, তা দেশের মানুষ বিচার করবে।