পরীক্ষার কারণে বাড়ি যাওয়া হয়নি, পাহাড়ের বৈসাবী আয়োজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে

পাহাড়ি জাতিগোষ্ঠীর বর্ষ বিদায় ও বরণের অনুষ্ঠানে আজ জগন্নাথ হলের পুকুরে ফুল ভাসান এসব জাতিসত্তার শিক্ষার্থীরা
ছবি: আসিফ হাওলাদার

‘বৈচিত্র্যের শক্তিতে বিকশিত হোক জুম্ম ভাষা ও সংস্কৃতি’ এই স্লোগানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথমবারের মতো উদ্‌যাপিত হলো ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর চৈত্রসংক্রান্তি ও নতুন বছরকে স্বাগত জানানোর উৎসব বিজু-সংগ্রাই-বৈসু-বিষু-চাংক্রান। প্রথমবারের মতো ক্যাম্পাসে এই আয়োজন করে সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জুম সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সংসদ’। এই আনন্দের দিনে ‘আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি’ দাবি করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীরা।

আজ মঙ্গলবার সকালে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের পুকুরে ফুল ভাসিয়ে বিজু-সংগ্রাই-বৈসু-বিষু-চাংক্রান উৎসবের উদ্বোধন করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামান। চৈত্রসংক্রান্তি ও নববর্ষ বরণের এই উৎসবকে চাকমা জনগোষ্ঠী বিজু, মারমা জনগোষ্ঠী সাংগ্রাই, ত্রিপুরারা বৈসু, তঞ্চঙ্গ্যারা বিষু ও ম্রো জনগোষ্ঠী চাংক্রান নামে উদ্‌যাপন করে থাকে। পরীক্ষার কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামের বাড়িতে যেতে না পারা ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীরা জগন্নাথ হলে আজ সম্মিলিতভাবে শুধু ফুল বিজু উদ্‌যাপন করলেন।

উৎসবের উদ্বোধনের পরই উপাচার্য চলে যান। তবে অন্য অতিথি ও শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে পুকুরপাড়েই একটি সংক্ষিপ্ত সমাবেশ হয়। সেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক মেসবাহ কামাল বলেন, ‘পরীক্ষা থাকার কারণে আদিবাসী শিক্ষার্থীরা এবার বাড়িতে যেতে পারেনি। কিন্তু এই জগন্নাথ হলে যে নবযাত্রা শুরু হলো, সেটাও সুন্দর। আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, সংবিধান তো রাষ্ট্রের প্রধান পলিসি ডকুমেন্ট। বাংলাদেশে বাঙালি ছাড়াও যে আরও বহু জাতির বসবাস, আমাদের যে বৈচিত্র্যের সমাহার, তার সাংবিধানিক স্বীকৃতির দাবির সঙ্গে আমি পরিপূর্ণ একাত্মতা ঘোষণা করছি। চৈত্রসংক্রান্তি ও নববর্ষে আদিবাসী সমাজের উৎসবের তিনটি দিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ছুটি থাকতে পারে। এ ক্ষেত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গোটা দেশকে পথ দেখাতে পারে। আগামী বছর থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ে এই ছুটি কার্যকর হোক, সেটাই চাই।’

উৎসব উপলক্ষে পাহাড়ের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীদের সমাবেশ টিএসসির মোড়ে
ছবি: আসিফ হাওলাদার

জগন্নাথ হলের প্রাধ্যক্ষ মিহির লাল সাহা বলেন, ‘জগন্নাথ হল সব সময় ঐতিহ্যকে ধারণ ও লালন করে। আজকে যেটা হলো তাতে একটি নতুন যাত্রা শুরু হলো। এই শুভসূচনার প্রতি অনেক অনেক শুভকামনা জানাই। আমি অন্তর্ভুক্তিতে বিশ্বাস করি, একই সঙ্গে বহু সংস্কৃতির চর্চাকে উৎসাহিত করি। আমরা সবাই মিলে ভালো থাকতে চাই।

এই সমাবেশের পর জগন্নাথ হলের প্রাধ্যক্ষের নেতৃত্বে হল থেকে বিজু-সংগ্রাই-বৈসু-বিষু-চাংক্রান ২০২২ উপলক্ষে শোভাযাত্রা বের করা হয়। এ সময় মাইকে বাজছিল বিজুর গান ‘তুরু তুরু তুরু রু’। শোভাযাত্রাটি টিএসসির রাজু ভাস্কর্যের সামনে গিয়ে শেষ হয়। সেখানে দিবসটি উপলক্ষে সমাবেশ হয়। সমাবেশে মূল বক্তব্য পাঠ করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের ছাত্রী হেমা চাকমা।

এতে ছয় দফা দাবি জানানো হয়। এগুলো হলো ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি নিশ্চিত করা; সংবিধান অনুযায়ী বিভিন্ন ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও বিকাশে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া; পয়লা বৈশাখের মতো বিজু-সাংগ্রাই-বৈসু-বিষ্ণু-চাংক্রান উৎসবের সময়ও সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অন্তত তিন দিন সরকারিভাবে ছুটি ঘোষণা করা; সব ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করা; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে পাহাড়ের আদিবাসীদের সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জুম সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সংসদ এর কার্যক্রম পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া; এবং আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটে আদিবাসীদের ভাষা নিয়ে গবেষণা ও ভাষাশিক্ষা কোর্স চালু করা।

জগন্নাথ হলের প্রাধ্যক্ষ মিহির লাল সাহা পাহাড়ি শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে বক্তব্য দেন
ছবি: আসিফ হাওলাদার

সমাবেশে অংশ নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক জোবাইদা নাসরীন বলেন, ‘প্রথমবারের মতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্ষুদ্র জাতিসত্তার নববর্ষের উৎসবের সূচনা হলো। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক বলে আমি মনে করি। এসব জাতিসত্তার মানুষেরা খুব ভালো নেই। কিছুদিন আগে উত্তরবঙ্গে দুজন সাঁওতাল কৃষক সেচের পানি না পেয়ে আত্মহত্যা করেছেন। উৎসবের মতো করেই এই নির্যাতন-নিপীড়নের জায়গাগুলোকে সম্মিলিতভাবে প্রতিরোধ করতে হবে। উৎসব যেমন মানুষকে একত্র করে, নির্যাতন-নিপীড়নও তা করে।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জুম সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সংসদ সহসভাপতি সতেজ চাকমা বলেন, ‘চৈত্রসংক্রান্তি ও নববর্ষের এই আয়োজন ঘিরে পাহাড়ের পরতে পরতে যে হর্ষধ্বনি, তা ঢাকা শহরের বুকে নতুন দিনের জয়গান গাক—এই আমাদের প্রত্যাশা। আমাদের ছয় দফা দাবি বাস্তবায়ন করা হোক।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জুম সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সংসদের সাংগঠনিক সম্পাদক ঐতিহ্য চাকমার সঞ্চালনায় সমাবেশে অন্যদের মধ্যে সংগঠনের সভাপতি রাতুল তঞ্চঙ্গ্যা, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাংস্কৃতিক সম্পাদক হিরণ মিত্র চাকমা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক আদনান আজিজ চৌধুরী বক্তব্য দেন।