নানা ছুতোয় প্লট বাতিল

রাজউকের পূর্বাচল প্লট প্রকল্প
ফাইল ছবি

ছুতো ধরে এক প্রবাসীর প্লট বাতিল করে তা জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেনকে বরাদ্দ দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) বিরুদ্ধে। ঢাকার পূর্বাচলে এই প্লটের আকার ১০ কাঠা।

রাজউক আবাসন প্রকল্পগুলোতে প্লট আর খালি নেই। তবে প্লটের জন্য মন্ত্রী, সাংসদ, সচিব এবং গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি দপ্তরের কর্মচারীদেরও আবেদন ছিল। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, কিছু ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের প্লট বাতিল করে নতুন আবেদনকারীদের বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

এমন ঘটনার শিকার হয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী আবুল কাশেম মোহাম্মাদ সাইফুল্লাহ। ২০০৩ সালে প্রবাসী কোটায় আবেদন করে পূর্বাচলে তিনি ১০ কাঠার একটি প্লট (কোড ২৯২৫, সেক্টর নম্বর ০৫, রোড নম্বর ১০৩ প্লট নম্বর ০৩৫) বরাদ্দ পান। ২০১৩ সালের মধ্যে তিনি কিস্তির সব টাকা শোধ করেন। কিন্তু দ্বিতীয় কিস্তির টাকা সময়মতো পরিশোধ করা হয়নি, এমন অজুহাতে তাঁর প্লটটি বাতিল করে দেয় রাজউক। তিনি দাবি করেন, পরে সেই প্লট প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেনকে বরাদ্দ দেওয়া হয়।

এক প্রবাসীর প্লট বাতিল করে দেওয়া হয়েছে এক প্রতিমন্ত্রীকে। তালিকায় রয়েছেন আমলাদের অনেকে। রাজউকে চেয়ারম্যান হলেই প্লট পাওয়া যায়।

এ বিষয়ে প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ প্রথম আলোকে বলেন, তিনি অনেক দিন আগে একটি আবেদন করেছিলেন। সেটির বিপরীতে রাজউক একটি প্লট দিয়েছে। তবে সেটা কারও প্লট বাতিল করে দেওয়া হয়েছে কি না, তা তাঁর জানার কথা নয়।

মোহাম্মাদ সাইফুল্লাহর তথ্য ও এ-সংক্রান্ত নথি অনুযায়ী, তিনি নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই, অর্থাৎ ২০০৫ সালে দ্বিতীয় ও ২০০৬ সালে যুক্তরাষ্ট্র থেকে তৃতীয় কিস্তির টাকা দিয়েছিলেন। ২০০৭ সালে তিনি দেশে এসে জানতে পারেন, রাজউক দ্বিতীয় কিস্তির টাকা পায়নি, তৃতীয় কিস্তির টাকা পেয়েছে। এরপর তিনি দ্বিতীয় কিস্তির পে-অর্ডারের ফটোকপি ও অন্যান্য প্রমাণ দেখান।

সাইফুল্লাহ বলেন, রাজউক কেন দ্বিতীয় কিস্তির টাকা পায়নি, তার সদুত্তর দেয়নি। রাজউকের দায়িত্বশীল কর্মকর্তা তাঁকে আশ্বস্ত করেন যে ২০০৬ সালে দেওয়া টাকা দ্বিতীয় কিস্তি হিসেবে গ্রহণ করা হবে। এরপর ২০১৩ সালে প্লটের বাকি টাকা তিনি শোধ করেন। ২০২০ সালে এসে রাজউক বলছে, ২০০৬ সালে সাইফুল্লাহ তৃতীয় কিস্তির টাকা দিয়েছেন, ২০১৩ সালে দিয়েছেন দ্বিতীয় কিস্তির টাকা। দ্বিতীয় কিস্তির টাকা নির্ধারিত সময়ে দেওয়া হয়নি—এই অজুহাতে সাইফুল্লাহর প্লটটি বাতিল করা হয়।

আমি অনেক দিন আগে একটি আবেদন করেছিলাম। সেটির বিপরীতে রাজউক একটি প্লট দিয়েছে। তবে সেটা কারও প্লট বাতিল করে দেওয়া হয়েছে কি না, তা আমার জানার কথা নয়।
ফরহাদ হোসেন, জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী

দ্বিতীয় কিস্তির টাকা না দিয়ে একজন কীভাবে তৃতীয় কিস্তির টাকা দিলেন, আর রাজউক সেটি কীভাবে গ্রহণ করল, এ বিষয়ে রাজউকের ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি। সাইফুল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, রাজউক সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে প্লটটি বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

২০২০ সালে কিস্তির কারণে অন্তত আটটি প্লট বাতিলের তথ্য পাওয়া গেছে। ওদিকে কিস্তি না দেওয়ায় বাতিল করা প্লট পরে ফেরতের নজিরও আছে। রাজউকের ০৬/২০২০তম বোর্ড সভার নথি অনুযায়ী, এই সভায় দ্বিতীয় কিস্তির টাকা সময়মতো পরিশোধ না করায় একজনের প্লট বরাদ্দ বাতিলের আদেশটি প্রত্যাহার করা হয়।

ছুতো ধরে সাধারণ মানুষের প্লট বাতিলের অভিযোগ সম্পর্কে জানতে গত রোববার যোগাযোগ করা হলে রাজউকের তখনকার চেয়ারম্যান (ভারপ্রাপ্ত) মো. শফি উল হক প্রথম আলোকে বলেন, প্লট বাতিলের বিষয়ে সংস্থাটির সদস্য (এস্টেট ও ভূমি) ভালো বলতে পারবেন। তবে বিনা কারণে কারও প্লট বাতিল করার কথা নয়। চেয়ারম্যানের পরামর্শমতো এ ব্যাপারে আরও জানতে সংস্থাটির সদস্য মো. মুনির হোসেন খানের (এস্টেট ও ভূমি) সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করে তাঁকে পাওয়া যায়নি।

প্লট পাওয়া ব্যক্তিদের তালিকায় যাঁরা
প্লট খালি না থাকলেও গত তিন বছরে (২০১৮-২০) সংরক্ষিত কোটায় অন্তত ২৮৫ জনকে প্লট দিয়েছে রাজউক। তাঁদের মধ্যে ১৪৮ জন সাংসদ। এ ছাড়া তালিকায় রয়েছেন সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের আমলা, বঙ্গভবন ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কর্মকর্তা ও কর্মচারী, কয়েকজন অভিনেতা এবং অন্যান্য পেশার মানুষ।

যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী আবুল কাশেম মোহাম্মাদ সাইফুল্লাহ। ২০০৩ সালে প্রবাসী কোটায় আবেদন করে পূর্বাচলে তিনি ১০ কাঠার একটি প্লট (কোড ২৯২৫, সেক্টর নম্বর ০৫, রোড নম্বর ১০৩ প্লট নম্বর ০৩৫) বরাদ্দ পান। ২০১৩ সালের মধ্যে তিনি কিস্তির সব টাকা শোধ করেন। কিন্তু দ্বিতীয় কিস্তির টাকা সময়মতো পরিশোধ করা হয়নি, এমন অজুহাতে তাঁর প্লটটি বাতিল করে দেয় রাজউক। তিনি দাবি করেন, পরে সেই প্লট প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেনকে বরাদ্দ দেওয়া হয়।

তিন বছরে প্লট পাওয়া আমলাদের মধ্যে (বরাদ্দ পাওয়ার সময়কার পদ) বিদ্যুৎ-সচিব আহমদ কায়কাউস (বর্তমানে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব), জননিরাপত্তা বিভাগের সচিব মোস্তফা কামাল মহিউদ্দিন, নির্বাচন কমিশনের সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সমন্বয়ক (এসডিজি) জুয়েনা আজিজ, জনপ্রশাসনসচিব শেখ ইউসুফ হারুন, ভূমি আপিল বোর্ডের চেয়ারম্যান আবদুল হান্নান, পাটসচিব মিজানুর রহমান, জনপ্রশাসনসচিব ফয়েজ আহমেদ, জনপ্রশাসনের অতিরিক্ত সচিব সাবিহা পারভীন, গণপূর্তের অতিরিক্ত সচিব ইমরুল চৌধুরী, নির্বাচন কমিশনের যুগ্ম সচিব মো. আবুল কাসেম, জনপ্রশাসনমন্ত্রীর একান্ত সচিব এ কে এম সাজ্জাদ হোসেনসহ অনেকে রয়েছেন।

চেয়ারম্যান হলেই প্লট
রাজউকের চেয়ারম্যান হিসেবে ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর দায়িত্ব নিয়েছিলেন সাঈদ নূর আলম। তিনি ৪ ফেব্রুয়ারি বিদায় নেন। এর আগে তিনি উত্তরা আবাসিক এলাকায় পাঁচ কাঠার একটি প্লট নিয়েছেন। তাঁর ঠিক আগে এই পদে ছিলেন সুলতান আহমেদ। তিনিও রাজউক ছাড়ার আগে পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পে ১০ কাঠার একটি প্লট নিয়েছেন। দুজনই প্লট নিয়েছেন সংরক্ষিত কোটায়।

প্লট নেওয়ার আবেদনে সাঈদ নূর আলম বলেছেন, এর আগে রাজউকে চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করা প্রায় সবাই প্লট বরাদ্দ পেয়েছেন। চেয়ারম্যানদের প্লট পাওয়ার ব্যাপারে কোনো অগ্রাধিকার আছে কি না, জানতে চাইলে সংস্থাটির চেয়ারম্যান (ভারপ্রাপ্ত) মো. শফি উল হক শনিবার প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, কোনো অগ্রাধিকার নেই।

সংরক্ষিত কোটায় প্লট বরাদ্দের জন্য আবেদনে সাঈদ নূর আলম দাবি করেছেন, তিনি রাজউকের ‘সেবা প্রদান প্রক্রিয়াকে অধিকতর জনবান্ধব’ করেছেন। অবশ্য রাজউকের অন্তত ১০ জন সেবাগ্রহীতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কারও সময়ই রাজউক জনবান্ধব হয়নি। ভুক্তভোগীদের একজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, রাজউকে কোনো কাজই তদবির ছাড়া হয় না।