ধারদেনায় চলছেন স্বল্প আয়ের মানুষ
>তাঁরা কেউ ফুটপাতের ফল বিক্রেতা, দরজি, রেস্তোরাঁকর্মী, সেলুনকর্মী, কেউবা ঝালমুড়ি বিক্রেতা। তাঁদের রাজধানীতে কারও কেটেছে ৪ বছর, কারও ৪৫ বছর। তবে করোনাভাইরাসের এই সময়ে সবার কাছেই ঢাকা হয়ে উঠেছে অচেনা। গত ২৮ থেকে ৩০ জুন রাজধানীর ১০টি থানা এলাকার নিম্ন আয়ের বিভিন্ন বয়সী ৩০ জন নারী-পুরুষের সঙ্গে কথা বলে করোনাকালে তাঁদের জীবন ও জীবিকা সম্পর্কে জানা যায়।
করোনার সংক্রমণ শুরু হলে রাজধানীর স্বল্প বা নিম্ন আয়ের অনেকে বাড়ি চলে গিয়েছিলেন। প্রায় তিন মাস কাটিয়েছেন গ্রামেই। ঘরবন্দী সময়ে সঞ্চয়ের সবটুকু শেষ হলে প্রায় সবাই নিকটজনদের কাছ থেকে ধার করে চলেছেন। ক্ষুদ্রঋণ সংস্থার ঋণও নিয়েছেন কেউ কেউ।
জুন মাসের শুরুতে সরকার সীমিত পরিসরে গণপরিবহন চালু ও অফিস খুলে দিলে তাঁরা ফিরেছেন নিয়মিত পেশায়। কিন্তু ‘নতুন স্বাভাবিক’ জীবন তাঁরা ফিরে পাননি। যাঁরা স্বল্প পুঁজিতে রাজধানীর ফুটপাতে ব্যবসা করেন, তাঁরা বলছেন, আগের মতো আয় হচ্ছে না। যাঁরা দৈনিক মজুরিতে কাজ করতেন, তাঁদের অনেকে কাজ হারিয়ে বিকল্প পথ বেছে নিয়েছেন। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের হয়ে সাইকেলে করে যাঁরা খাবার ও পণ্য সরবরাহ করেন, তাঁরা বলছেন, ঝুঁকি থাকলেও খেয়ে-পরে ভালো আছেন। একই কথা বলেছেন সবজি বিক্রেতারাও।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান কিমেকারস কনসালটিংয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক খন্দকার স্বনন শাহরিয়ার বলেন, ‘এসইসি বা আর্থসামাজিক শ্রেণিবিভাগে ব্যক্তির শিক্ষাগত যোগ্যতা, পেশা বিবেচনা করে পুরো সমাজের রোজগেরে মানুষদের পাঁচ ভাগে ভাগ করা হয়। এসইসি গ্রিডের ‘ডি’ শ্রেণিভুক্ত নিম্ন আয়ের এই মানুষেরা আমাদের সমাজের প্রায় ৩০ শতাংশ। যাঁরা পেশায় শিক্ষিত কৃষক, হাতের কাজে দক্ষ, খুচরা ব্যবসায়ী, অশিক্ষিত পেশাজীবী বা স্বল্পশিক্ষিত বিক্রয়কর্মী। করোনার সময়ে বেশি ভুগছেন এই শ্রেণির মানুষ।’
জীবনকেও শাণ দিতে চান সেলিম
পায়ের চাপে পাথরের চাকতি বনবন করে ঘুরছে। কাঁচিটা সেখানে লাগাতেই আগুনের ফুলকি বেরোচ্ছে। মিনিটখানেক আগের ভোঁতা কাঁচিতে ধার ফিরে এল। মালিকের কাঁচি হাতে তুলে দিয়ে মো. সেলিম মনোযোগ দেন এই প্রতিবেদকের দিকে।
: ‘কত আয় হলো আজ?’
: ‘আর আয়, পোষে না, ভাই। সারা দিন ঘুরে ৫০০ টাকা পকেটে উঠছে। খাইতে আর ঘরভাড়া দিয়ে আর কিছু থাকব না।’
২৮ জুন রাজধানীর বাংলামোটর এলাকায় কথা হচ্ছিল মো. সেলিমের সঙ্গে। বিভিন্ন এলাকায় কাজ করে তিনি ফিরছিলেন তেজগাঁওয়ে। সেখানে একটি বাসায় আটজন মিলে ভাড়া থাকেন। প্রত্যেকের বাড়ি হবিগঞ্জের বানিয়াচং উপজেলায়। পেশাও এক—ছুরি-কাঁচি শাণ দেওয়া।
মার্চের শেষে সবাই বাড়ি গিয়েছিলেন, সপ্তাহখানেক আগে ঢাকায় ফিরে এসেছেন। মো. সেলিম বলেন, ‘তিন মাস খুব কষ্টে ছিলাম। বাড়ি থেকে বের হওয়া যায় না। আশপাশে ধান কাটছি কিছুদিন। কিন্তু গ্রামে কেউ কাজেও নিতে চায় না। ৩০ হাজার টাকা হাওলাত (ধার) হয়ে গেছে।’
সেলিমের আয়ে চলে তাঁর সাত সদস্যের সংসার। করোনাকালের আগে দৈনিক প্রায় এক হাজার টাকা আয় হতো। জমানো টাকা নিয়ে গ্রামের বাড়ি গিয়েছিলেন। পরিবার সেখানেই থাকে। ওই টাকায় মাসখানেক চলেছেন। পরের মাসেই ধার করতে হয়েছে নিকটজনদের কাছ থেকে। এখন ঢাকায় এসেছেন, আয় নেই বলে ধারের টাকাও শোধ করতে পারছেন না।
সেলিম বলেন, ‘কী করব, এখন একজনের কাছ থেকে ধার নিয়ে অন্যজনকে দেই। এখন ভাই জীবনডাকেও শাণ দিতে হবে।’
সামনে পবিত্র ঈদুল আজহা। কোরবানির সময়টায় দা-ছুরি শাণ করানোর পরিমাণ বেড়ে যায়। সেলিম আশা করছেন, তখন আয়ও ভালো হবে।
ফুলের বদলে ফিরোজার হাতে চায়ের ফ্লাস্ক
ফুল বিক্রি করে কেটেছে ফিরোজা খাতুনের ২০ বছর। অন্য কোনো কাজের কথা কখনো ভাবতে হয়নি ৫০ বছর বয়সী এই নারীর। বছর পনেরো আগে সড়ক দুর্ঘটনায় স্বামীকে হারিয়ে একাই সংসারের হাল ধরেছিলেন। বড় মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। বড় ছেলেও বিয়ে করে আলাদা সংসার গড়েছেন। দুই ছেলের মধ্যে মেজজন তাঁর কাজে সহযোগিতা করেন, ছোটজন অটিস্টিক বলে ঘরবন্দী।
করোনার প্রকোপ বাড়তে থাকলে ফুল বিক্রি বন্ধ করতে হয় ফিরোজা বেগমের। তাঁর ভাষায়, ‘মানুষ তো কাছেই যেতে দেয় না।’ তিনিও তখন ঘরবন্দী সময় কাটালেন।
তিন মাস কীভাবে চললেন? ফিরোজা বললেন, ‘জমানো টাকা শেষ, দেনা করতে হয়েছে ৩০ হাজার, চাল-ডাল কিছু পাইছিলাম। কয়দিন চলছি। আর তো বসে থাকা যায় না।’
তাই সীমিত পরিসরে গণপরিবহন চলাচল আর অফিস-আদালত শুরু হলে ফিরোজা বেগমও পথে নেমেছেন। কিন্তু তাঁর ফুলের ক্রেতা নেই। তাই বাধ্য হয়ে ফ্লাস্কে করে চা আর পান-সিগারেট নিয়ে গত সপ্তাহে বসেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের (টিএসসি) সামনে। তিনি বলেন, ফুল বিক্রি করে খেয়ে-পরে আগে প্রতিদিন ৫০০ টাকা থাকত। এখন চা বিক্রি করে কোনো দিন ২০০, কোনো দিন ২৫০ টাকা লাভ হয়।
এখন যেমনই কাটুক, ফিরোজা খাতুন সুদিনের প্রত্যাশা করছেন। সব স্বাভাবিক হয়ে এলে আবার ফুল বিক্রি করতে পারবেন, আয় বাড়বে, সচ্ছল হবে জীবন।
পান্না বেগমের ফলে ঋণের টাকা
পান্না বেগম (৪৫) মৌসুমি ফল বিক্রেতা। রাজধানীর কারওয়ান বাজারের ফুটপাতে একেক ঋতুতে একেক ফল বিক্রি করেন তিনি। এখন যেমন বিক্রি করছেন নানা জাতের আম। তাঁর কাজে সহযোগিতা করেন ২০ বছর বয়সী ছেলে। স্বামী আরেক বিয়ে করার পর এই ছেলেকে নিয়েই থাকেন কারওয়ান বাজার মৎস্য আড়তের পাশে এক বাসায়। ঘরভাড়া বাবদ মালিককে দিতে হয় মাসে ৩ হাজার ৫০ টাকা। কিন্তু গত দুই মাসের ভাড়া তিনি দিতে পারেননি। ঘরবন্দী প্রায় দুই মাস চলেছেন জমানো টাকায়।
পান্না বেগম জানান, পেটের দায়ে মাসখানেক আগে এক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে মাসিক ২ হাজার টাকা সুদে ২০ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছেন। সে টাকায় প্রতিদিন আড়ত থেকে আম এনে বিক্রি করেন। ৫ হাজার টাকার ফল বিক্রি করতে পারলে ৮০০ থেকে ১ হাজার টাকা আয় হয়। আনুষঙ্গিক খরচসহ সে আয়েই চলছে তাঁর সংসার।
প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘ভাইরাসের কারণে মানুষ বাজারে আসতে চায় না, তাই এখন বেচাবিক্রি কম। কত দিন এভাবে চলব, আল্লাহ জানেন।’
পথের পাশে কালুর সেলুন
রাজধানীর মোহাম্মদপুরের হুমায়ুন রোডের একটি সেলুনে কাজ করতেন মো. কালু (৩৫)। নীলফামারীর সৈয়দপুর থেকে রাজধানীতে এসে জীবনের ২০ বছর কাটিয়েছেন সেলুনকর্মী হিসেবে। এই প্রথম তিনি মুখোমুখি ভিন্ন এক বাস্তবতার। পরিবার নিয়ে মোহাম্মদপুরেই থাকেন। কালুর দুই মেয়ে। বড়জন এবার এসএসসি পাস করেছে, ছোটজন স্কুলে।
কালু যে সেলুনে কাজ করতেন, করোনাভাইরাসের কারণে সরকারি ছুটির সময়ে তা বন্ধ হয়ে যায়। পবিত্র ঈদুল ফিতরের পর কাজে যোগ দিতে গেলে সেলুনমালিক তাঁকে আসতে মানা করেন।
প্রথম আলোকে কালু বলেন, ‘সেলুনে এখন লোকজন কম আসে। মালিক নিজেই তাদের কাজ করে দেন। তাই বাড়তি লোকের দরকার নেই। আমি বাধ্য হয়ে এখন রাস্তার পাশে বসছি।’
মো. কালু ক্ষুর-কাঁচি নিয়ে এখন বসেছেন শেরেবাংলা নগরের কৃষি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের সামনের সড়কের ফুটপাতে। ছোট একটা কাঠে বসানো আয়নার সামনে বসার জন্য চেয়ার পেতেছেন। সেখানেই চুল-দাড়ি কাটছেন।
কালু জানান, সেলুনে আগে যত টাকার কাজ করতেন, তার অর্ধেক পেতেন তিনি, বাকি অর্ধেক সেলুনমালিক। তাতে দৈনিক আয় হতো ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা। ২৯ জুন সকাল আটটা থেকে বেলা পাঁচটা পর্যন্ত হিসাব জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এখন পর্যন্ত কাজ করছি ২৫০ টাকার। কোনো দিন আরও কম হয়।’
এই টাকা থেকেই ফুটপাতে বসার দায়ে চাঁদা দিতে হয়। বাকি যা থাকে, তাতেই চার সদস্যের পরিবারের চলতে হয়। মো. কালু বলেন, ‘তিন মাস বাসায় বসে কাটাইলাম। বড় লোকদের চাল-ডাল সাহায্য-সহযোগিতা পাইছি বইলা কিছুটা চলতে পারছি। কিন্তু এখন নিজেই চলব কী, ধার নেওয়া ১০ হাজার টাকাই শোধ করব কীভাবে, মেয়েকে কলেজে ভর্তিই করানো না হয় বাদই দিলাম।’
আয়শার ভাত আছে, মানুষ নেই
দুপুর গড়িয়ে তখন বিকেল। ভ্যানের পাটাতনে রাখা ভাত-তরকারির হাঁড়িগুলো দেখিয়ে মোছাম্মৎ আয়শা (৪৫) বলেন, ‘মামা, আজকে ৫০০ ট্যাকা বিক্রি করছি। পাতিল এহনো ভরা, কেউ খায় না।’
মোছাম্মৎ আয়শা ভ্রাম্যমাণ ভাত-তরকারি বিক্রেতা। যে পরিমাণ খাবার পাতিলে তখন দেখা গেল, জানালেন, করোনাকালের আগে বিকেলের মধ্যেই তা শেষ হয়ে যেত। মানুষ এখন আর খেতে আসে না বলে তিনি আক্ষেপ করলেন।
আয়শার রান্না করা খাবারের দুটি প্যাকেজ, ৩০ আর ৪০ টাকা। মূলত তরকারির দামটা নেন, ভাত ভরপেট। আয়শা নিজে রান্না করেন। স্বামী মো. দুলালের সহযোগিতায় যাত্রাবাড়ীর ধলপুর থেকে ভ্যানে করে খাবারের পাতিল আনেন শাহবাগে। রিকশাচালক আর নিম্ন আয়ের মানুষ তাঁর খাবার খান। কিন্তু করোনা মহামারি শুরুর পর থেকে সবাই যখন গ্রামমুখী হলো, তখন সব গুটিয়ে বাসায় থাকতে হয়েছে আয়শাকেও।
২৮ জুন তিনি জানান, তিন দিন হলো খাবার রান্না করে আনছেন। কিন্তু প্রতিদিনই অর্ধেক অবিক্রীত থেকে যাচ্ছে। লাভের অংশ অনেকটা নষ্টই হয়ে যাচ্ছে।
দুই মেয়ে আর এক ছেলে নিয়ে ধলপুরের যে ভাড়া বাসায় থাকেন, সেটার মাসিক ভাড়া সাত হাজার টাকা। গত তিন মাসের ভাড়া দিতে পারেননি। আয়শা বলেন, ‘তিন মেয়ে বিয়া দিছি, খরচাপাতি আছে না? এবার ১৫ হাজার টাকা ধারও নিতে হইছে। আল্লাহ জানেন কত দিনে সব ঠিক হব।’
কিস্তিতে বাসাভাড়া দেন বাবুল বিশ্বাস
মোহাম্মদপুরের কলেজ গেট এলাকায় বাবুল বিশ্বাসের (৩৮) সাক্ষাৎ মিলল। পদচারী-সেতুর গোড়ায় এক পাশে চট পেতে বসেছেন। মানুষের জুতা-স্যান্ডেল সারাই আর পলিশে ঝাঁ-চকচকে করা তাঁর কাজ। তাই কালি, ব্রাশ, ক্রিম ইত্যাদি তো আছেই, সঙ্গে কয়েক পাটি জুতাও রেখেছেন বিক্রির জন্য।
আড়াই মাস বাসায় কাটিয়ে গত ঈদুল ফিতরের কয়েক দিন আগে কাজে বেরিয়েছেন বাবুল। একসময় তাঁর দৈনিক আয় যেখানে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা হতো, এখন তা কমে ২০০-২৫০ টাকা। এই সময়ে ছেলেও হারিয়েছেন তাঁর গার্মেন্টসের চাকরি। স্ত্রী আর দুই সন্তান নিয়ে গাবতলী এলাকায় যে ভাড়া বাসায় থাকেন, সেই বাসাভাড়াও দিতে পারেননি তিন মাস।
দুঃখ করে বাবুল বিশ্বাস বললেন, ‘আড়াইটা মাস হাওলাত করে চলছি। বাবা, শাশুড়ি সবার কাছ থেকেই কিছু কিছু নিতে হইছে। বাসাভাড়া দিতে পারি নাই, এখনো সাড়ে ছয় হাজার টাকা বাকি। বাড়ির মালিকটা ভালো বলে বলছে মাসে মাসে ভাড়ার সাথে দিতে। এখন কিস্তিতে দিয়া দিতেছি।’
তাসলিমা বললেন, ‘আমার কপাল ভালো’
তিন মেয়ের বিয়ে দিতে পেরে অনেকটা নিশ্চিত জীবন তাসলিমা বেগমের (৪৫)। মগবাজারের দিলু রোডে চারটি বাসায় গৃহকর্মীর কাজ করেন তিনি। কোনো বাসায় রান্নার, কোনোটায় শুধুই ধোয়ামোছার কাজ। তাঁর মতোই এক পরিবারের সঙ্গে থাকেন ২ হাজার ৫০০ টাকা ভাড়ায়।
করোনার প্রকোপ বাড়তে থাকলে দুটি পরিবার থেকে কাজে যেতে নিষেধ করা হয়, আরেকটি বাসার সদস্যরা চলে যান গ্রামে। অনিশ্চয়তার মধ্যে তিনি চলে যান মুন্সিগঞ্জের বিক্রমপুরে বড় মেয়ের বাসায়।
৩০ জুন প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘আমি বড় মেয়ের বাসায় দুই মাস ছিলাম। আমার কপাল ভালো, চার বাসার মধ্যে দুই বাসা থেকে বেতন পেয়েছি, এক বাসা থেকে ঈদের বোনাসও দিয়েছে।’
চার বাসায় কাজ করে প্রতি মাসে তাঁর হাতে আসে সাড়ে আট হাজার টাকা। এই টাকায় নিজের খরচ মিটিয়ে কিছু সঞ্চয় করেন, স্বামী গত হয়েছেন ১৫ বছর আগে, মেয়েরা ছাড়া আর কেউ নেই, বিপদ-আপদে তাঁরাই পাশে দাঁড়ান। তবে দুই মাস বেতন অর্ধেক পাওয়ায় বাসাভাড়াটা দিতে পারেননি।
তাসলিমা বেগম বলছিলেন, সবার অবস্থা তাঁর মতো ভালো নয়। তিনি কাজগুলো ফিরে পেয়েছেন। দুই মাসের বাসাভাড়া পরিশোধ করতে পারবেন। তাঁর পরিচিত অনেকে কাজ হারিয়েছেন, বাড়িতে গিয়ে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। তাঁর ভাষায়, ‘কয়েকজন আমার কাছে কাজ চাইছে, বাসাভাড়া দিতে পারছে না, ঠিকমতো খাইতেও পারছে না।’
রুবেলের বাঁশিতে কষ্টের সুর
‘বংশীবাদক’ শব্দটা যেন তাঁর নামেরই অংশ হয়ে গেছে। তাই নিজের পরিচয় দিতে গিয়ে বললেন, ‘আমার নাম বংশীবাদক রুবেল।’ রুবেল বাঁশি বাজান, বাঁশি তৈরি করেন, বাঁশি বিক্রি করেন। বাঁশের বাঁশি ছাড়াও তাঁর কাছে পাওয়া যায় খঞ্জনিসহ বিভিন্ন লোকজ বাদ্যযন্ত্র। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের দেয়ালঘেঁষা ফুটপাতে বসেন তিনি।
কয়েক মাস পর ২৫ জুন থেকে বাঁশি নিয়ে আবার আসতে শুরু করেছেন রুবেল। ২৮ জুন প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘বইমেলা, একুশে ফেব্রুয়ারির কারণে প্রায় পুরো ফেব্রুয়ারি মাসই বন্ধ ছিল। মার্চে তো শুরু হতে হতেই বন্ধ হয়ে গেল। প্রায় চার মাস পর আমি ফিরে এলাম।’
স্ত্রী, দুই সন্তান আর বাবাকে নিয়ে থাকেন ঢাকার নাজিমুদ্দিন রোডের ভাড়া বাসায়। বাসায় বসে থাকায় আয়ের পথ ছিল বন্ধ। জানালেন, কয়েক মাস আগে ছেলে দুর্ঘটনায় পড়েছিল, সঞ্চয়ের সব অর্থ চলে গেছে চিকিৎসায়। তাই ঘরবন্দী দিনে চলার জন্য একটি ক্ষুদ্রঋণ সংস্থা থেকে ৬০ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছেন। সাপ্তাহিক কিস্তি ১ হাজার ৭৫০ টাকা। এত দিন কিস্তি দিতে হয়নি, জুলাই থেকে কিস্তির টাকা পরিশোধ করতে হবে।
কিন্তু তিন দিনে একটি বাঁশিও বিক্রি করতে পারেননি রুবেল। তবে তিনি আশাবাদী, কয়েক দিনের মধ্যে বিক্রি শুরু হবে। জানালেন, দীর্ঘদিন বন্ধ ছিল বলে মানুষ জানে না তিনি বাঁশি নিয়ে বসছেন, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ বলেও বিক্রি নেই, কয়দিন পর হয়তো মানুষ জানবে, কিনতেও আসবে কেউ কেউ।
চাকরি ফিরে পেয়েই খুশি কাদের
রেস্তোরাঁ আড়াই মাস বন্ধ থাকলেও আবদুল কাদের (২০) বেতন পাননি তিন মাস। এ নিয়ে মনে মনে কষ্ট থাকলেও কাজ ফিরে পাওয়ায় আক্ষেপটা আর নেই। বললেন, ‘আটজনের তো চাকরিই চলে গেছে, আমারটা তাও আছে!’
বড় মগবাজারের একটি রেস্তোরাঁর কর্মী আবদুল কাদের। থাকা-খাওয়া রেস্তোরাঁয়। মাসিক বেতন ছয় হাজার টাকা। তবে আগের মতোই বেতন পাবেন কি না, এ নিয়ে সংশয় আছে। বললেন, ‘আগের মতো মানুষ খেতে আসে না, মালিকেরও তিন মাসের ভাড়াসহ অনেক টাকা প্রয়োজন, জানি না আগের বেতনই পাব কি না।’
মার্চে রাজধানীর রেস্তোরাঁ বন্ধ করার সরকারি নির্দেশনা জারি হলে চাঁদপুর জেলার শাহরাস্তি উপজেলার গ্রামের বাড়িতে চলে যান আবদুল কাদের। তাঁর বাবাও ঢাকায় একটি রেস্তোরাঁর পাচক। চার সদস্যের পরিবারে উপার্জনক্ষম দুজন মানুষই বেকার হয়ে পড়েন। কিছুদিন বাড়িতে বসে কাটিয়ে বাধ্য হয়েছিলেন খেতখামারে কাজ নিতে। কিন্তু তাতেও সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হয়, ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ে কাদেরের পরিবার। তিন মাসের জন্য ১০ হাজার টাকা ধার করেছেন তাঁর বাবা।
কাদের বলেন, ‘আস্তেধীরে টাকাটা শোধ করতে হবে।’
কিছুদিন দেখবেন কাবুল মিয়া
গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী উপজেলায় কাবুল মিয়ার (৫৫) বাড়ি। রাজধানীতে ঝালমুড়ি বিক্রি করেন। ৩ হাজার ৯০০ টাকায় একটা ঘর ভাড়া নিয়ে একা থাকেন তেজগাঁওয়ের বেগুনবাড়ি বস্তিতে। গত তিন মাসের ভাড়া বকেয়া পড়েছে। এই তিন মাস পরিবারের সঙ্গে গ্রামের বাড়িতে ছিলেন। বাড়িতে থাকার সময় এর-ওর কাছ থেকে ধার করে চলেছেন। তিনি বলেন, ‘৩০-৪০ হাজার টাকা ধার করে ফেলছি। আস্তে আস্তে দেনা শোধ দিতে হবে। কিন্তু যা আয় হয়, তাতে তো আমিই চলতে পারতেছি না।’
কাবুল মিয়ার সঙ্গে কথা হয় ২৭ জুন। গত ২২ মার্চ ঢাকা ছেড়েছিলেন, ফিরেছেন ২৩ জুন। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ফিরে এখন দিনে তাঁর আয় ২০০-২৫০ টাকা। এর মধ্যে দৈনিক ১২০ টাকা জমা করেন ঘরভাড়ার জন্য, তিন বেলা খাবার খেতে প্রয়োজন ১০০ টাকা। আরও আনুষঙ্গিক কিছু খরচ তো আছেই। তাই কীভাবে নিজে চলবেন, বাড়িতে পরিবারের কাছেই পাঠাবেন কী, এ নিয়ে দুশ্চিন্তায় দিন কাটছে কাবুল মিয়ার।
তিন সন্তানের বাবা কাবুল। বড় মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। দুই ছেলেকে পড়াশোনা করাচ্ছেন। বড় ছেলে একাদশ শ্রেণির ছাত্র, ছোটজন এসএসসি পরীক্ষার্থী। কাবুল মিয়া জানালেন, এভাবে আর কিছুদিন দেখবেন, আয় বাড়লে ঢাকায় থেকে যাবেন, না হলে চলে যাবেন গ্রামে।
কাপড়ে ঢাকা খুকু রানীর সেলাই মেশিন
রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের পাশ ঘেঁষে যে পথটা চলে গেছে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে, সে পথের এক জায়গায় সেলাই মেশিন নিয়ে বসেন খুকু রানী রায় (৫৫)। একসময় পাঁচ হাজার টাকা বেতনে টেইলার্সে কাজ করলেও স্বাধীন জীবনযাপনের জন্য নিজেই মেশিন নিয়ে পথের পাশে বসেন। তাতে দৈনিক আয় ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা।
একা মানুষ খুকু রানী রায়। স্বামী-সন্তান নেই। দুবেলা খাবারের চিন্তা না থাকলেও বাসাভাড়া নিয়ে পড়েছেন সংকটে। দীর্ঘদিন বিশ্ববিদ্যালয়শিক্ষার্থীদের কাপড় সেলাইয়ের কারণে অনেকে তাঁর চেনা। সন্তানসম এই মানুষদের সহযোগিতা পেয়েছেন। সে অর্থে খেয়ে-পরে কাটিয়েছেন ঘরবন্দী সময়।
এখন পেটের দায়ে কাজে বেরিয়েছেন। কিন্তু কেউ আর কাপড় সেলাই করতে আসেন না। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘আজ (২৯ জুন) কাজ করছি ৪৫ টাকার। মেডিকেল বন্ধ, মেয়েরা বাড়ি চলি গেছে, আমারও কাজ নাই। ঠাকুর জানে কত দিন চলবি এভাবে।’
হাড়ভাঙা খাটুনিতেও মকলুবরের আয় কম
ঘুমানোর বন্দোবস্ত যাত্রাবাড়ীর রায়েরবাগের রিকশা গ্যারেজে। আরও কয়েকজন মিলে যে মেসে দুবেলা খান, সেখানে দিতে হয় প্রতিদিন ১০০ টাকা। মকলুবর রহমান (৪২) প্রথম আলোকে বলেন, ‘হাড়ভাঙা খাটুনির কাজ করি, এ-ই খেয়ে কি হয়? ডিম-দুধ-স্যালাইনও তো খেতে হয়, আর সকালের নাশতা হোটেলে করি, চলে যায় আরও শ খানেক।’ নিজের আয়-ব্যয়ের হিসাব দিলেন এভাবেই।
রিকশাচালক মকলুবর ৩০ জুন যাত্রাবাড়ী থেকে যাত্রী নিয়ে এসেছিলেন মালিবাগ, সেখানেই তাঁর সঙ্গে আলাপ। জানালেন, রিকশার জমা খরচ আর খাওয়াদাওয়া বাদে এখন তাঁর কোনো দিন থাকছে ৩০০ টাকা, কোনো দিন ৫০০ টাকা। করোনাকালের আগে যা ছিল ৮০০-১০০০ টাকা। তাঁর ভাষায়, ‘সারা বেলা রিকশা চালায়া যা পাই, আগে অর্ধেক বেলা চালায়া দ্বিগুণ পাইতাম।’
মকলুবর রহমানের বাড়ি রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলায়। প্রায় ২৫ বছর ধরে রাজধানীতে রিকশা চালান তিনি। কিন্তু এমন কঠিন সংকটে কখনো পড়েননি। মার্চের শেষ দিকে বাধ্য হয়ে গ্রামে চলে যেতে হয়েছিল। ঘরবন্দী কর্মহীন জীবন কাটিয়ে ৪ জুন ফিরেছেন ঢাকায়।
মকলুবর জানালেন, রোজগারের পথ বন্ধ থাকায় পাঁচজনের সংসার চালাতে সুদের ওপর ৩০ হাজার টাকা ধার করতে হয়েছে তাঁকে। পরিচিত এক ব্যক্তির কাছে নেওয়া ধারের জন্য প্রতি মাসে সুদ দিতে হয় ১ হাজার ৫০০ টাকা। কবে নাগাদ এই ঋণের টাকা শোধ করতে পারবেন, তা নিয়ে সংশয়ে পড়েছেন তিনি। ‘খেয়ে-পরে ঋণ সুদ দিতে ছয় মাসও লাগতে পারে, কমও লাগতে পারে।’ যোগ করেন মকলুবর রহমান।
সুদিনের প্রত্যাশা সবার
‘কর্ম করে খাই, ভাই। ভাইরাসের ভয়ে ঘরে থাকলে চলব?’ স্বাস্থ্যবিধি না মেনেই যে পথে পথে চশমা বিক্রি করছেন, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ভয় নেই? ঢাকা নিউমার্কেটের ফেরিওয়ালা মো. হারুনের (৩৪) কাছে জানতে চাওয়া হলে এভাবেই উত্তর দেন তিনি।
তাঁর মতো মানুষদের ঘরে থাকলে চলবে না বলেই পেশাগত কাজে ন্যূনতম সুরক্ষাসামগ্রী ছাড়াই পথে নেমেছেন। পেটের দায়ে বাধ্য হয়েছেন কাজে বেরোতে। যে ৩০ জনের সঙ্গে এই প্রতিবেদক কথা বলেছেন, তাঁরা এবং তাঁদের নিকটাত্মীয় কেউই এখন পর্যন্ত করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হননি। তাঁরা ভাইরাস নিয়ে শুরুতে যেমন আতঙ্ক বোধ করতেন, এখন ততটা আতঙ্কিত নন বলেও জানান। তবে নিজে আতঙ্কিত না হলেও যাঁরা পরিবার নিয়ে বসবাস করেন, তাঁরা পরিবারের সদস্যদের সুরক্ষার ব্যাপারে যথাসম্ভব সচেতন।
প্রায় সবাই রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্যব্যবস্থা ও করোনাকালীন সরকারি উদ্যোগ সম্পর্কে অবগত। এলাকার সচ্ছল মানুষের সহযোগিতা কেউ কেউ পেলেও সরকারি অনুদান পাননি কেউই। বাবুল বিশ্বাস তাই আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘সরকাররে ভাই দোষ দেই না, সরকার তো ঠিকই গরিব মানুষের জন্য দেয়, মেরে খায় তো এলাকার নেতারা।’
খেটে খাওয়া এই মানুষেরা ক্রান্তিকালে কষ্ট করে দিন কাটিয়েছেন, এখনো ঠিকমতো আয় করতে পারছেন না, কবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে, সে নিয়েও রয়েছে অনিশ্চয়তা। তবু প্রত্যেকেই মনে করেন, এই অসময় কেটে যাবে, তাঁরাও স্বাভাবিক জীবন ফিরে পাবেন, আয়ও বাড়বে, পরিশোধ করতে পারবেন ধারদেনা।
অল্পে তুষ্ট এই মানুষদের কথায় তাই দুঃসময়ের দুঃখগাথার সঙ্গে ফুটে ওঠে সুদিনের প্রত্যাশা।