দোকান-কর্মচারীদের মানবেতর জীবন
পবিত্র ঈদুল ফিতর সামনে রেখে গত রোববার থেকে রাজধানীতে পোশাক, প্রসাধনী, জুতা—এসবের দোকান কিছু কিছু খুলেছে। তবে অফিস স্টেশনারি, হার্ডওয়্যার, নির্মাণসামগ্রী, ইলেকট্রিক দ্রব্য, যন্ত্রপাতিসহ অন্যান্য দোকান ও হোটেল এখনো বন্ধ রয়েছে। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধ করতে সরকারি নির্দেশে গত ২৪ মার্চ থেকে সারা দেশে সব দোকানপাট বন্ধ রাখা হয়। এর ফলে দোকান কর্মচারীরা কর্মহীন হয়ে পড়েন। টানা প্রায় দুই মাস ধরে দোকানপাট বন্ধ থাকায় দোকান কর্মচারীরা প্রবল অর্থকষ্টে মানবেতর জীবন যাপন করছেন।
তানজিল ফারাজির দুই মাসের বাসা ভাড়া বকেয়া। দুই মাস ধরে তাঁর আয়–রোজগার কিছু নেই। গত মঙ্গলবার কাজে যোগ দিয়েছেন, ঈদের আগে কিছু রোজগার হবে এই আশায়। তিনি টিকাটুলীর রাজধানী সুপার মার্কেটের মাবিয়া ফ্যাশন নামের এক পোশাকের দোকান কর্মচারী। বেতন পান সাকল্যে ৮ হাজার টাকা। মঙ্গলবার থেকেই এই বিপণিবিতান খুলেছে।
গাউছিয়া মার্কেটের থ্রিপিসের দোকান অঞ্জন-এর কর্মচারী জুয়েল মোল্লার অবস্থা আরও খারাপ। টানা দোকান বন্ধ থাকায় গত রোববার তাঁরা বিক্ষোভ করেছেন নিউমার্কেট-গাউছিয়া এলাকায়। পরিবারের সাত সদস্য নিয়ে খুবই মানবেতর জীবন যাপন করছেন তিনি। রোববার থেকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য দোকানপাট খেলার অনুমতি দেওয়া হলেও গাউছিয়া, চিশতিয়া, নূর ম্যানশনের অধিকাংশ দোকান এখনো বন্ধ। দোকান কর্মচারীরা বেতন পাচ্ছেন না।
টানা প্রায় দুই মাস ধরে দোকানপাট বন্ধ থাকায় অধিকাংশ কর্মচারীই কোনো বেতন পাননি। অল্প কিছু দোকান মালিক তাঁদের কর্মচারীদের অর্ধেক বা আংশিক বেতন দিয়েছেন। বেচাকেনা না থাকায় ছোট ও মাঝারি ধরনের দোকানমালিকেরাও অর্থসংকটে পড়েছেন। এই পরিস্থিতিতে কর্মচারীদের পুরো বা আংশিক বেতন দেওয়াও অনেকের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়েছে। এর ফলে দোকান কর্মচারীরা পরিবার–পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। তাঁরা ত্রাণ বা সাহায্যের জন্য পথে নেমে হাত পাততে পারছেন না, আবার পাড়া–মহল্লায় দুস্থদের যে সাহায্য দেওয়া হচ্ছে, তাও পাচ্ছেন না।
জুয়েল মোল্লা গাউছিয়া, চিশতিয়া, নূর ম্যানশন মার্কেট দোকান কর্মচারী ইউনিয়নের সভাপতি। আজ বুধবার দুপুরে তিনি জানালেন, কেবল এই তিন মার্কেটেই দোকান কর্মচারী তিন হাজারের বেশি। তাঁরা মালিক সমিতির নেতাদের কাছে বকেয়া বেতন পরিশোধের দাবি করছেন। অবশেষে তাঁরা পর্যায়ক্রমে দুই মাসের বকেয়া বেতন দিতে রাজি হয়েছেন। আপাতত ২৫ শতাংশ কর্মচারী বেতন পেয়েছেন, বাকিদের বেতন ঈদের আগে দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন। তিনি নিজে এখনো বেতন পাননি।
দোকান কর্মচারীদের বেতন দেওয়া সম্পর্কে আজ দুপুরে কথা হয় ঢাকা সিটি করপোরেশন মার্কেট ফেডারেশনের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জহিরুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি জানালেন, অভিন্ন ঢাকা সিটি করপোরেশনের নিজস্ব মার্কেট ও কাঁচাবাজার ছিল ১৩৯টি। সিটি করপোরেশন ভাগ হওয়ার পর তাঁরা দক্ষিণ সিটির অংশের ৭৮টি মার্কেট ও বাজারের দোকানমালিকদের নিয়ে এই ফেডারেশন করেছেন। এই ফেডারেশনভুক্ত মার্কেট ও কাঁচাবাজারে কর্মচারীর সংখ্যা প্রায় ১ লাখ। উত্তরের এমন কোনো কমিটি এখনো হয়নি। তাঁরা দক্ষিণের দোকানমালিকদের বলেছেন কর্মচারীদের বকেয়া বেতন সম্পূর্ণ পরিশোধ আর ঈদের বোনাস অর্ধেক দিতে হবে। কারণ, কর্মচারীরা কোনো সরকারি প্রণোদনা পাচ্ছেন না। মালিকেরই প্রণোদনা পাবেন, তা ছাড়া দোকান বন্ধ রাখার ক্ষেত্রে কর্মচারীদের কোনো দোষ নেই। তিনি ফেডারেশনের বাইরের দোকান মালিকদেরও মানবিক দিক বিবেচনা করে কর্মচারীদের বকেয়া বেতন পরিশোধের আহ্বান জানিয়েছেন।
দোকান কর্মচারীদের অবস্থা নিয়ে আজ কথা হলো বাংলাদেশ শ্রমিক-কর্মচারী ঐক্য পরিষদের (স্কপ) কেন্দ্রীয় যুগ্ম আহ্বায়ক নাইমুল আহসান এবং জাতীয় শ্রমিক জোটের কেন্দ্রীয় সদস্য এ বি এম জাকিরুল হকের সঙ্গে। তাঁর জানালেন, দোকান কর্মচারীরা খুবই অসংগঠিত। তাঁদের কেন্দ্রীয় কমিটি বা জাতীয় পর্যায়ের কোনো ফেডারেশন নেই। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মার্কেটভিত্তিক কমিটি আছে, কোথাও তাও নেই। এই শ্রমিকনেতাদের হিসাবে দেশে দোকান কর্মচারীর সংখ্যা ৪০ লাখের মতো। এঁদের মধ্যে সারা দেশের সড়কের পাশের দোকানপাটেই কাজ করেন ৭৫ শতাংশ। বাকি ২৫ শতাংশ শ্রমিক-কর্মচারী ছোট-বড় শহরের দোকানগুলোতে কাজ করেন।
শ্রমিকনেতাদের মতে, এই দোকান কর্মচারীদের অবস্থা খুবই খারাপ। তাঁদের কোনো নিয়োগপত্র নেই। শ্রমঘণ্টা নির্ধারিত নেই। গ্রামে মফস্বলে তাঁরা সকাল নয়টা থেকে রাত নয়টা–দশটা পর্যন্ত টানা কাজ করেন। তাঁদের সাপ্তাহিক ছুটিও নেই। আবার বেতনও খুবই সামান্য। ঢাকা শহরেই দোকান কর্মচারীদের বেতন ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকা। এমন কর্মচারীর সংখ্যা ২০ শতাংশ। অধিকাংশ কর্মচারীই ১০ হাজার টাকার কম বেতন পান। কাজেই এই নিম্ন বেতনও যখন বকেয়া পড়ে যায়, তখন তাঁদের সংসার চালানো অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়ে। কারণ, তাঁদের হাতে জমানো টাকা বলতে বিশেষ কিছু থাকে না। বরং অনেককেই প্রতি মাসে নিয়মিত ধারদেনা করে চলতে হয়।
বেতন পেলে ধার শোধ, আবার মাস শেষে ধারকর্জ—এভাবেই তাঁদের সংসার চলে। দোকান কর্মচারীদের জন্য কোনো মজুরি বোর্ড নেই, সে কারণে তাঁদের ন্যূনতম মজুরিও নির্ধারিত নেই। বহুদিন ধরে তাঁরা এসব নিয়ে আন্দোলন করছেন বলে জানালেন। এই আন্দোলনের ফলে ১৯৯৭ সাল থেকে দোকান কর্মচারীদের সাপ্তাহিক ছুটি দেওয়ার আইন করা হয়েছে। এখন তারা নিম্ন মজুরি নির্ধারণ এবং মজুরি বোর্ড গঠনের আন্দোলন করছেন। তবে করোনাকালের এই ভয়াবহ সংকটে সার্বিক দিক বিবেচনা করে অন্তত দোকান কর্মচারীদের ঈদের বোনাস না হলেও বকেয়া বেতন পরিশোধের জন্য তাঁরা মালিকদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।