ওসমানী উদ্যান
দুর্গতিতে ‘রাগ কমানোর’ পার্ক
উন্নয়নকাজের নামে সাড়ে তিন বছর ধরে বন্ধ উদ্যানটি। আশ্বাস ছিল, ১০ মাসে কাজ শেষ হবে। এখন পর্যন্ত অগ্রগতি ৬৫%।
চারদিকে সবুজ; তার মধ্যে লেকের পানিতে পা ভিজিয়ে শোনা যাবে পুরোনো দিনের গান। তা–ও রাজধানীর ব্যস্ততম এলাকায়।
সাড়ে তিন বছর আগে এই স্বপ্ন দেখিয়ে ঢাকার ওসমানী উদ্যানের অবকাঠামো উন্নয়নের কাজ শুরু করেছিলেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) সাবেক মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন। তিনি বলেছিলেন, ১০ মাসেই সব কাজ শেষ হবে। নগরবাসী এই উদ্যানে গিয়ে রাগ কমাবেন। তাই তিনি এর নাম দিয়েছিলেন ‘গোস্বা নিবারণী পার্ক’।
এত দিন পর পার্কটির চিত্র হলো এই, অবকাঠামোর নির্মাণকাজ চলছে একেবারেই ধীরগতিতে। উদ্যানে বসার জায়গা, হাঁটার পথ, লেকের সিঁড়ি, ব্যায়ামাগার ইত্যাদি অবকাঠামো অর্ধনির্মিত অবস্থায় পড়ে আছে। গত বুধবার সরেজমিন দেখা যায়, কিছু কিছু জায়গায় নির্মাণসামগ্রী পড়ে আছে। কাউকে নির্মাণকাজ করতে দেখা যায়নি। উত্তর পাশের বন্ধ ফটকের সামনে ঝুলছে একটি সাইনবোর্ড, ‘সর্বসাধারণের প্রবেশ নিষেধ।’ উল্লেখ্য, সাঈদ খোকন পার্কের উন্নয়নকাজ শুরুর পর আড়াই বছর দায়িত্ব পালন করেন।
ওসমানী উদ্যানটি পুরান ঢাকার ফুসফুস নামে পরিচিত। এতে অবকাঠামো উন্নয়নকাজ শুরুর আগে ভোরে সেখানে নিয়মিত হাঁটতে যেতেন পুরান ঢাকার সিদ্দিকবাজারের বাসিন্দা জাবেদ জাহান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, উন্নয়নকাজ করতে গিয়ে মানুষের হাঁটার সুযোগ গেল, আবার জনগণের টাকাও ব্যয় হলো।
রাজধানীর গুলিস্তানে ঢাকা দক্ষিণ সিটির (ডিএসসিসি) প্রধান কার্যালয় নগর ভবনের উল্টো দিকে ওসমানী উদ্যান। এর আয়তন প্রায় ২৪ একর। এই উদ্যানে অসংখ্য গাছপালা ও দুটি জলাশয় রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল মোহাম্মদ আতাউল গনি ওসমানীর নামে এই
পার্কের নামকরণ। সম্রাট আওরঙ্গজেবের প্রধান সেনাপতি মীর জুমলা আসাম যুদ্ধে ব্যবহার করেছিলেন—এমন একটি ঐতিহাসিক কামান এই পার্কে রাখা আছে।
দক্ষিণ সিটির প্রকৌশলীরা জানান, একটি অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় উদ্যানটির দুটি জলাশয় সংস্কার করে সারা বছর পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা করা এবং সার্বিক পরিবেশ উন্নয়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়। প্রকল্পে উদ্যানের ভেতর স্বাধীনতা চত্বর, পাঠাগার, নগর জাদুঘর ও শিশু কর্নার নির্মাণ এবং সাউন্ড সিস্টেম, ওয়াই–ফাই জোন প্রতিষ্ঠা, টেবিল টেনিস, বিলিয়ার্ডসহ বিভিন্ন খেলার ব্যবস্থা রাখা, ফুড কর্নার, ওষুধের দোকান, এটিএম বুথ বসানোর বিষয়টিও ছিল পরিকল্পনায়। প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৯০ কোটি টাকা।
এই প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ যাঁরা নিয়েছেন, যাঁরা বাস্তবায়ন করছেন—সবাই উদ্যানটির দুর্গতির জন্য দায়ী।ইকবাল হাবিব, স্থপতি
২০১৭ সালের ডিসেম্বরে প্রকল্পটির কাজ শুরু হয়। ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে নির্মাণকাজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন সাবেক মেয়র সাঈদ খোকন। দক্ষিণ সিটি জানায়, সর্বশেষ গত মে মাসের হিসাবে কাজের সার্বিক অগ্রগতি ৬৫ শতাংশ।
ডিএসসিসির সংশ্লিষ্ট অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক মুন্সি মো. আবুল হাসেম প্রথম আলোকে বলেন, একাধিকবার তাগাদা দেওয়ার পরও ঠিকাদারের কাজের গতি সন্তোষজনক নয়। এ জন্য তাঁদের কার্যাদেশ বাতিলের প্রাথমিক সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ–বিষয়ক নথি এখন মেয়রের দপ্তরে। তিনি বলেন, কার্যাদেশ বাতিল হলে নতুন ঠিকাদার নিয়োগ দিয়ে বাকি কাজ দ্রুত শেষ করা হবে।
দক্ষিণ সিটির প্রকৌশলীরা বলছেন, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে জরিমানাও করা হতে পারে। বাকি কাজ শেষ করতে যত টাকা ব্যয় হবে, তা হিসাব করে সেই টাকার ১০ থেকে ২০ শতাংশ পর্যন্ত ঠিকাদারের বিল থেকে কেটে রাখা হতে পারে।
উদ্যানটির উন্নয়নকাজের দায়িত্ব পেয়েছিল দ্য বিল্ডার্স ইঞ্জিনিয়ার্স নামের একটি প্রতিষ্ঠান। যথাসময়ে কাজ শেষ না করার কারণ জানতে চাইলে এই প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফজলুল করিম চৌধুরী গত রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘পুরো কাজের কার্যাদেশ আমাদের দেওয়া হয়নি। যেটুকু দেওয়া হয়েছে, তা প্রায় শেষ। বিল না পাওয়ায় দেরি হয়েছে।’
বর্তমান ঠিকাদারের কার্যাদেশ বাতিল করে নতুন ঠিকাদার নিয়োগ দিয়ে উদ্যানের বাকি কাজ শেষ করতে কত দিন লাগবে, তা এখনো নিশ্চিত নয়। দক্ষিণ সিটির প্রকৌশলীরা বলছেন, বাকি কাজের দরপত্র ডাকা, নতুন ঠিকাদার চূড়ান্ত করা, কার্যাদেশ দেওয়া এবং নির্মাণকাজ শেষ করা—সব মিলিয়ে এক বছরের বেশি সময় লাগতে পারে। ফলে শিগগিরই সাধারণ মানুষের জন্য উদ্যানটি উন্মুক্ত হচ্ছে না।
ওসমানী উদ্যানের চলমান উন্নয়নকাজে শুরুতেই আপত্তি জানিয়েছিলেন স্থপতি ইকবাল হাবিব। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এই উদ্যানে প্রকল্পের নামে ১৭৩টির বেশি গাছ কাটা হয়েছে। সবুজ লোপাট করা হয়েছে। এর বাইরে সেখানে কিছুই হয়নি। তিনি বলেন, এই প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ যাঁরা নিয়েছেন, যাঁরা বাস্তবায়ন করছেন—সবাই উদ্যানটির দুর্গতির জন্য দায়ী।