দুই হাসপাতালে দুই মা, সঙ্গী শুধুই যন্ত্রণা
রাজধানীতে জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতালের (পঙ্গু হাসপাতাল) অদূরে ট্রমা সেন্টার। দূরত্ব মাত্র ৫০০ মিটার। সরকারি ও বেসরকারি এই দুই হাসপাতালের মাঝখানে মিরপুর সড়ক। দুই হাসপাতালে এখন যন্ত্রণা আর শোকে কাতর দুই মা। একজন নিজে পা হারিয়ে শয্যাশায়ী। আরেকজনের বিনিদ্র রাত কাটছে সন্তানের শয্যাপাশে।
দুই মায়ের মধ্যে একজন কৃষ্ণা রায় চৌধুরী। দুই সন্তানের মা কৃষ্ণা ট্রাস্ট সার্ভিসেস লিমিটেডের একটি বেপরোয়া বাসের চাপায় নিজের বাম পা হারিয়েছেন। দুই সপ্তাহ ধরে তিনি ভর্তি পঙ্গু হাসপাতালে।
আরেক মা রুমানা সুলতানা। গত বৃহস্পতিবার ভিক্টর ক্ল্যাসিক নামের একটি বাসের চাপায় হারিয়েছেন তাঁর স্বামী সংগীতশিল্পী পারভেজ রবকে। এর দুদিন পর শনিবার রাতে উত্তরার কামারপাড়া এলাকায় একই পরিবহনের আরেকটি বাস চাপা দেয় তাঁর ছোট ছেলে ইয়াসির আলভী ও তাঁর বন্ধু মেহেদী হাসানকে। গুরুতর আহত হন আলভী। তবে প্রাণ হারিয়েছেন বন্ধু মেহেদী। বাসের চাপায় গুরুতর আহত হয়ে আলভী ভর্তি ট্রমা সেন্টারে। ছেলে পঙ্গু হয়ে যাবে কি না, সেই শঙ্কায় রয়েছেন রুমানা।
অথচ যাঁদের কারণে কৃষ্ণা রায় চৌধুরী ও রুমানা সুলতানার জীবনের ঘোর অন্ধকার নেমে এসেছে, তাঁদের প্রায় সবাই এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে।
গত ২৭ আগস্ট রাজধানীর বাংলামোটরে ট্রাস্ট সার্ভিসেস লিমিটেডের বাসটি ফুটপাতে দাঁড়িয়ে থাকা বিআইডব্লিউটিসির কর্মকর্তা কৃষ্ণা রায় চৌধুরীর বাম পা থেঁতলে দেয়। বাসচালক মোরশেদ ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যান। পঙ্গু হাসপাতালের চিকিৎসকেরা কৃষ্ণা রায়ের হাঁটুর নিচের অংশ কেটে ফেলেন। পরে সংক্রমণ হওয়ায় তাঁর হাঁটুর ওপরের কিছু অংশও কেটে ফেলা হয়। হাতিরঝিল থানায় কৃষ্ণা রায় চৌধুরীর স্বামী রাধেশ্যাম চৌধুরী মামলা করলেও তিন আসামির মধ্যে ট্রাস্টের বাসচালক মোরশেদ ছাড়া বাসের মালিক ও হেলপার এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে।
ঘটনার দুই সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও পায়ের যন্ত্রণা পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে পারেননি কৃষ্ণা রায় চৌধুরী। বাম পায়ে ড্রেসিং করানোর সময় ব্যথায় চিৎকার করেন তিনি।
বিআইডব্লিউটিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা খন্দকার মাসুম হাসান প্রথম আলোকে বলেন, কৃষ্ণার বাম হাঁটুর ওপরের অংশ কেটে ফেলতে হয়েছে। এখানে প্রায়ই ড্রেসিং করাতে হয়। ড্রেসিংয়ের সময় কৃষ্ণা চিৎকার করে বলেন, ‘দাদা মরিচ লাগানোর মতো জ্বলছে আমার পা।’ কৃষ্ণা রায় চৌধুরীর স্বামী রাধেশ্যাম চৌধুরী বলেন, তাঁর স্ত্রীর শরীরে যন্ত্রণা এখনো রয়েছে, দুর্বলতাও কাটেনি।
কৃষ্ণা রায়ের বাম পায়ে কৃত্রিম পা স্থাপন করানো হবে। তবে চিকিৎসা বেশ ব্যয়বহুল। অবস্থার উন্নতি হলে তাঁকে ভারত অথবা থাইল্যান্ডে নেওয়া হতে পারে। কিন্তু অর্থের ব্যবস্থা না করা গেলে দেশেই পা স্থাপন করা হবে।
কৃষ্ণা রায়ের চিকিৎসকেরা জানান, ভারত ও থাইল্যান্ডের দুটি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা এসে পায়ের মাপ নিয়ে গেছেন। তবে কৃষ্ণার বাম পায়ের কাটা জায়গায় স্কিন গ্রাফটিং করাতে হবে। এ জন্য অস্ত্রোপচার করে তাঁর শরীরের অন্য অংশ থেকে চামড়া নিতে হবে। এই ক্ষত শুকালে কৃত্রিম পা স্থাপনের দিনক্ষণ চূড়ান্ত করা হবে। তবে সবকিছু হলেও কৃষ্ণা রায় চৌধুরী আগের মতো কর্মস্থলে ফিরতে পারবেন কি না, সেটি এখনো অনিশ্চিত। কৃষ্ণা রায়ের স্বামী রাধেশ্যাম চৌধুরী আজ মঙ্গলবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘দুই কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ দাবি করে ট্রাস্ট সার্ভিসেসের কাছে আইনি নোটিশ পাঠিয়েছি। তবে আমাদের পুরো সংসারে অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। চালক ছাড়া অন্য দুই আসামিকে এখনো ধরতে পারেনি। কেন ধরা পড়ছে না, তার উত্তর পাওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু বিচার পেতে আইনি লড়াই চালিয়ে যাব।’
হাতিরঝিল থানা থেকে মামলার তদন্তের দায়িত্ব পেয়েছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। পিবিআইয়ের বিশেষ পুলিশ সুপার (ঢাকা মেট্রো উত্তর) বশীর আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘মামলার তদন্তের দায়িত্ব পেলেও এখনো আমরা নথি বুঝে পাইনি। তবে আমরা (পিবিআই) ছায়া তদন্ত করছি। ট্রাস্টের বাসের মালিক ও হেলপারকে গ্রেপ্তারে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।’
এদিকে ছেলে ইয়াসির আলভীর চিকিৎসা খরচ জোগাড় করতে হিমশিম খাচ্ছেন পারভেজ রবের স্ত্রী রুমানা সুলতানা। রুমানা প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার ছেলের প্রতিদিন ওয়ার্ডে বেড ভাড়া ২২০০ টাকা। এর সঙ্গে ওষুধসহ অন্যান্য খরচও রয়েছে। দুর্ঘটনার পর ধারদেনা করে ২০ হাজার টাকা হাসপাতালে জমা দিয়েছি। বাকিতে ওষুধ কেনা হচ্ছে। এখনো কোনো টাকা জোগাড় করতে পারিনি।’
রুমানা সুলতানা বলেন, বাসের ধাক্কায় আলভীর কোমরের হাড়ে প্রচণ্ড আঘাত লেগেছে। বসতে পারে না। বিছানায় শুয়ে থাকতে হয়। গতকাল সোমবার আলভীর ডান হাতের কড়ে আঙুলের ব্যান্ডেজ খোলা হয়। নিজের আঙুল দেখে ভয়ে অজ্ঞান হয়ে যায় আলভী। তাঁর প্রস্রাব ও মলদ্বারেও প্রচণ্ড ব্যথা হচ্ছে। ব্যথার শঙ্কায় কিছু খেতে চাচ্ছে না।
ট্রমা সেন্টারের প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী আ ফ ম রুহুল হক প্রথম আলোকে বলেন, আলভীর শারীরিক অবস্থা উন্নতির দিকে। ছেলেটির কোমরে অস্ত্রোপচার করাতে হবে। চিকিৎসা করালে ভালো হবে। সর্বনিম্ন খরচে ওর চিকিৎসা করানো হবে।
বাসচাপায় মৃত্যুর ঘটনায় গত রোববার উত্তরা পশ্চিম থানায় মামলা করেছেন আলভীর বন্ধু মেহেদীর মামাতো ভাই মো. ফিরোজ। ভিক্টর পরিবহনের চালক রফিকুল ইসলামকে আটক করে পুলিশ। রফিককে আটকের আগেই তাঁর সহকারী পালিয়ে যান। তবে পারভেজ রবকে চাপা দেওয়া ভিক্টর ক্ল্যাসিকের আরেকটি বাসের চালক এখনো পলাতক। মামলার তদন্তে তুরাগ থানার পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয়নি বলেও জানান পারভেজ রবের স্ত্রী রুমানা সুলতানা।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও তুরাগ থানার উপপরিদর্শক (এসআই) নির্মল চন্দ্র দেব প্রথম আলোকে বললেন, ভিক্টর ক্ল্যাসিকের আটক বাসের নম্বর প্লেটের (ঢাকা মেট্রো ব ১২-০৯৬৩) সঙ্গে ইঞ্জিনের নম্বরে মিল নেই। রেজিস্ট্রেশন নম্বর সার্চ দিয়ে মিল পাওয়া যাচ্ছে না। বাসের চালক সব কাগজপত্র নিয়ে পালিয়ে গেছেন। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) সহায়তা চাওয়া হয়েছে।
ভিক্টর ক্ল্যাসিক পরিবহনের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন কি না? জানতে চাইলে এসআই নির্মল চন্দ্র দেব বলেন, ‘মামলার তদন্তে আমরা দেখছি, ঘুরছি। দেখা যাক।’