জাতীয় জাদুঘরে সংগ্রহ আছে, ঘাটতি সংরক্ষণ প্রশিক্ষণে
বাংলাদেশের জাতীয় জাদুঘর শতবর্ষী প্রতিষ্ঠান। খোন্দকার মোস্তাফিজুর রহমান মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন ২০২০ সালের জুন থেকে। আন্তর্জাতিক জাদুঘর দিবস সামনে রেখে তাঁর কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল জাতীয় জাদুঘরের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে। প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম, সাফল্য ও দুর্বলতা নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি।
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: জাতীয় জাদুঘরে প্রবেশের জন্য অনলাইনে টিকিট কাটতে গিয়ে দর্শনার্থীরা বিড়ম্বনার শিকার হচ্ছেন। অনেকে ফিরেও যাচ্ছেন। সমাধান নিয়ে কী ভাবছেন?
খোন্দকার মোস্তাফিজুর রহমান: ২০২০ সালে যখন করোনা সংক্রমণ খুব বেশি, তখন দর্শক সংখ্যা সীমিত করার কথা ভাবা হয়। জাদুঘর পরিচালনা ট্রাস্টি বোর্ড সিদ্ধান্ত নেয় অনলাইনে টিকিট বিক্রির। প্রথম দিকে তো করোনার জন্য বন্ধও ছিল কিছুদিন। পরে যখন খুলে দেওয়া হয়, তখন দর্শকসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখতে চাই আমরা।
এখন দৈনিক ১ হাজার ৫০০ টিকিট দেওয়া হয়। জনগণের স্বার্থেই এটা করা হয়েছে। যদিও কয়েকটি দেশে এখনো করোনার অবস্থা ভালো নয়। তবে আমাদের দেশের পরিস্থিতি অনেকটা স্বাভাবিক হয়েছে। পরবর্তী বোর্ড মিটিংয়ে আমরা প্রস্তাব তুলব। সবাই সম্মত হলে সশরীর টিকিট কাটার ব্যবস্থা আবার শুরু হবে। তবে অনলাইন বাদ দেওয়া হবে না। দুটি মাধ্যমই থাকবে।
জাতীয় জাদুঘরের ওয়েবসাইটে আছে টিকিটের লিংক। কেমন করে কাটতে হবে, সেটাও উল্লেখ আছে। যে কেউ ওই নিয়মাবলি পড়ে টিকিট কাটতে পারবেন। আমাদের এ বিষয়ে যে আইটি বিশেষজ্ঞ, তাঁর নম্বরও আছে ওয়েবসাইটে। সমস্যায় পড়লে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন দর্শনার্থীরা।
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: ছুটির দিনগুলোতে দর্শনার্থীদের ভিড় অনেক বেশি হয়। এই রোজার ঈদে অনেক দর্শনার্থী দূর থেকে এসে ফিরে গেছেন। উৎসবের সময় কেন বন্ধ রাখা হয় জাদুঘর?
মোস্তাফিজুর: দেখুন, উৎসব তো সবার জন্য। জাদুঘরে যে কর্মী কাজ করে, তাদেরও তো ঈদে, পূজায় বন্ধ দরকার আছে। জাদুঘরের নিয়ম অনুযায়ী সরকারি ছুটির দিন বন্ধ থাকবে। তা ছাড়া শুক্রবার ছুটির দিন হলেও আমরা কিন্তু আধা বেলা খোলা রাখি। সাপ্তাহিক ছুটি বৃহস্পতিবার। আবার দেখুন জাতীয় দিবসগুলোতে সব বন্ধ, কিন্তু জাদুঘর পুরো দিন খোলা থাকে। ওই সময় স্কুলশিক্ষার্থী, বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মানুষ, বয়স্ক মানুষদের বিনা পয়সায় জাদুঘরে প্রবেশ ও প্রদর্শনী দেখার ব্যবস্থা আছে।
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: সংগ্রহের সংখ্যা অনুযায়ী প্রদর্শন সম্ভব হয় কত শতাংশ?
মোস্তাফিজুর: জায়গা খুব কম। আমাদের গ্যালারি আছে ৩৫টা। সংগ্রহ আছে প্রায় ৯৪ হাজার কিন্তু প্রদর্শন করা সম্ভব হয় মাত্র ৫ হাজার। বাকিগুলো রাখা আছে স্টোরে। তবে কিছু সময় পরপর এগুলো বদলে প্রদর্শন করা হয়। আগের সংগ্রহ সরিয়ে সেখানে অন্যগুলো রাখা হয়।
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: স্টোরে রাখাও তো খুব ঝুঁকিপূর্ণ। ঠিকমতো সংরক্ষণ না হলে নিদর্শন নষ্ট হবে।
মোস্তাফিজুর: রাখার মতো ব্যবস্থা, জায়গা দুটোই আছে। ওটা অসুবিধা নয়।
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: সীমিত পরিসরে সমস্যার সমাধান নিয়ে কোনো পদক্ষেপ নিয়েছেন?
মোস্তাফিজুর: জাদুঘরের পেছনে নতুন একটা ভবন হবে। দ্বিতল আন্ডারগ্রাউন্ড নিয়ে ১৫ তলা ভবন তৈরির পরিকল্পনা হচ্ছে। এখানকার সব স্টোর সেখানে নিয়ে গেলে এই ভবনে আরও ২০ থেকে ২২টি গ্যালারির জায়গা পাওয়া যাবে। তখন আরও অনেকগুলো দেখানো যাবে। তবে এ কাজ শেষ হতে অন্তত তিন বছর সময় লাগবে।
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: পাঠাগারে গবেষণার জন্য প্রবেশাধিকার নিয়ে ঝামেলার অভিযোগ পাওয়া যায়।
মোস্তাফিজুর: গ্রন্থাগার ব্যবহার করতে হলে একটা ফরম পূরণ করে আবেদন করতে হবে। এটা তো জটিল ব্যাপার নয়। আমরা বরং আরও গবেষকদের আহ্বান জানাই আসার জন্য। উল্টো ভালো গবেষকই তো পাওয়া যায় না।
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: শিক্ষার্থীদের আগে জাদুঘরের উদ্যোগে দর্শনের জন্য নিয়ে আসা হতো। কার্যক্রমটা বন্ধ রয়েছে।
মোস্তাফিজুর: জাদুঘরের একটা স্কুলবাস ছিল। ওটা পাঠিয়ে তাদের বিনা পয়সায় আনা–নেওয়া করা হতো। বাসটি বছর পাঁচ হলো নষ্ট। আসলে ওটাও একজনের দেওয়া ছিল। নতুন বাস না পাওয়ায় এখন কাজটা করা সম্ভব হচ্ছে না।
যদি কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দলবদ্ধভাবে শিক্ষার্থীদের নিয়ে আসে, তাহলে বিনা পয়সায় দেখার সুযোগ করে দিয়েছে জাদুঘর কর্তৃপক্ষ। এ জন্য আমরাই বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আহ্বান জানিয়ে চিঠি পাঠাই।
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: জাদুঘরের নিদর্শনের ক্ষতি করলে ১০ বছরের কারাদণ্ডের বিধান রেখে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর বিল-২০২২ পাস হয়েছে সংসদে। যদি অনিচ্ছাকৃতভাবে ক্ষতি হয়, তাহলে জরিমানা বা শাস্তির ব্যাপার কেমন করে নির্ধারণ হবে?
মোস্তাফিজুর: অপরাধ ঘটলে ব্যাপারটা আমরা পাঠাব আদালতে। বিচারের দায়িত্ব কিন্তু আমাদের নয়। ইচ্ছাকৃত না অনিচ্ছাকৃত, সেটা নির্ধারণ করবেন আদালত।
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: নীতিমালা ও বিধি লঙ্ঘন করে ভাস্কর নভেরা আহমেদের ‘পরিবার’ বা কাউ অ্যান্ড টু ফিগার্স ভাস্কর্যটি নষ্ট করা হয়েছে। এ নিয়ে তদন্ত প্রতিবেদনে দোষীকে শাস্তির সুপারিশ করেছে কয়েক বছর আগে। অগ্রগতি কত দূর ?
মোস্তাফিজুর: এটা কয়েক বছর আগে আমি দায়িত্ব গ্রহণ করার আগের ঘটনা। শিল্পী নভেরা আহমেদের ভাস্কর্যগুলো সংরক্ষণের জন্য চারুকলার কয়েকজন শিক্ষককে নিয়ে একটা কমিটি গঠন করা হয়। পরিবার বা কাউ অ্যান্ড টু ফিগার্স ভাস্কর্যটি ছিল জাদুঘরের সামনে উন্মুক্ত জায়গায়। রোদ বৃষ্টি ঝড়ে কয়েকটি স্থানে ক্র্যাক ধরে যায়। গরুর শিং আর কোথায় যেন একটু ভেঙেও যায়। ভাস্কর্যটি ভেতরে এনে রাখার সিদ্ধান্ত হয়। সে জন্য ওই ভাস্কর্যের একটা অনুকৃতিও তৈরির সিদ্ধান্ত হয়। এ দায়িত্ব দেওয়া হয় জাদুঘরের একজন কর্মকর্তাকে। তিনি এটাকে সংস্কার করে অনুকৃতি তৈরি করে বাইরে বসান। সংরক্ষণ কমিটির ভাষ্য অনুযায়ী, এ সংস্কারের কাজটা ঠিক হয়নি।
শিল্পীর মূল ভাস্কর্য ভেঙে গেলে সেটাকে ওই অবস্থাতেই রাখতে হবে। এটা সংরক্ষণ নীতিমালাবিরোধী বলে কমিটি মন্তব্য করে প্রতিবেদন দেয়। প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে ২০২০ সালের প্রথম দিকে। তা নিয়ে তদন্ত শুরু হয়। এরপর তো করোনা শুরু হয়ে গেল। এর মধ্যে মহাপরিচালকেও পরিবর্তন এসেছে। শেষ বোর্ড মিটিংয়ে আমরা প্রতিবেদনটি তুলেছিলাম। বোর্ড সিদ্ধান্ত নিয়েছ, যে কাজটি করেছে, তাকে আমরা কঠোরভাবে সতর্ক করব।
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: তার মানে নীতিনির্ধারক পর্যায়ে পরিবর্তন হলে এমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের তদন্ত প্রতিবেদনের সুপারিশ বাস্তবায়নে দেরি হবে?
মোস্তাফিজুর: কাগজপত্র ঠিকঠাকমতো থাকলে দেরি হওয়ার কথা নয়। ফাইল ঠিক থাকলে নিয়ম অনুযায়ী কাজ এগোয়। কোনো কারণে ফাইল আসতে দেরি হলে তখন বিলম্ব হয়। দেখা যায় একেকটা মিটিংয়ে অ্যাজেন্ডা থাকে ২২ থেকে ২৫টা করে। তখন আমাদের প্রায়োরিটি নির্ধারণ করতে হয়। কোনোটা হয়তো তখন পিছিয়ে যায়।
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: পৃথিবীর অনেক বড় বড় জাদুঘরে ফ্ল্যাশ ব্যবহার না করে ছবি তোলার অনুমতি আছে। আমাদের জাতীয় জাদুঘরে এ অনুমতি নেই। শিক্ষার্থীদের জন্য প্রয়োজন। জাদুঘরের কোন নীতিমালায় এটা আছে?
মোস্তাফিজুর: আপনি বলছেন অনেক বড় জাদুঘরে ছবি তোলার অনুমতি আছে। কিন্তু এই মাত্র দেড় মাস আগে আমাদের এক মিটিংয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক আবারও পরামর্শ দিয়েছেন, যেন কোনোভাবে ছবি তোলার অনুমতি দেওয়া না হয়। উনি খুব শক্ত অবস্থান নিয়ে জানিয়েছেন, বিশ্বের অনেক দেশের জাদুঘরেই ছবি তোলার অনুমতি নেই। ফ্লাশ ব্যবহার করলে সংগ্রহের ক্ষতি হতে পারে। জাদুঘর একটা শতবর্ষী প্রতিষ্ঠান। অনেক বিশিষ্টজনের মতামতের ভিত্তিতে এর নীতিমালা তৈরি করা হয়েছে। এই গাইডলাইন বদলাতে হলে অনেকের মতামত নিয়ে আবার পরিবর্তন করতে হবে।
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: বেশ কিছু সংগ্রহে দেখলাম শুধু বাংলায় নামকরণ। বিদেশি পর্যটকদের জন্য আমাদের জাদুঘর কতটা আকর্ষণীয় মনে করেন?
মোস্তাফিজুর: আপনি ঠিকই বলেছেন, আমাদের মন্তব্য বইয়েও এমন মন্তব্য এসেছে। কিছু নিদর্শনের ইংরেজি হয়নি। এগুলো করতে হবে। গ্যালারিস্বল্পতা আছে আগেই বলেছি। কিন্তু আমার তো মনে হয় বিদেশি পর্যটকেরা যথেষ্ট আগ্রহী। তাঁদের উপস্থিতি দেখে অন্তত তাই মনে হয়।
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: জাদুঘরের যে উদ্দেশ্য, তাতে বর্তমানে কোথায় কমতি আছে, আর কতখানি সফল?
মোস্তাফিজুর: সংরক্ষণ ব্যবস্থাপনা বিদেশি বিশেষজ্ঞদের প্রশিক্ষণে হওয়া দরকার। বিভিন্ন ধরনের সংগ্রহ আছে, সেসব রক্ষণাবেক্ষণ নিয়ম ভিন্ন ভিন্ন। এগুলো সঠিকভাবে তদারক করতে ভালো প্রশিক্ষণের বিকল্প নেই।
দেখুন আমাদের বড় কাজ হচ্ছে জাদুঘরের নিদর্শন সংগ্রহ করে ভান্ডার সমৃদ্ধ করা। প্রতিবছরই এটা শতাধিক করি আমরা। এ বছর দেড় শ মতো করব আশা করি। সেদিক থেকে আমরা সফল। সংগ্রহের পর নিয়মের মধ্য দিয়ে নিবন্ধন করতে হয়। এরপর প্রদর্শনীর দায়িত্ব। সেটাও করা হয়। বাকিগুলো সংরক্ষণাগারে রাখা হয়। এগুলো হচ্ছে জাদুঘরের মূল কাজ। আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হচ্ছে গবেষণা। আমি মনে করি, এই জায়গাতে দুর্বলতা আছে। এত বড় জাদুঘর, সে তুলনায় গবেষক অপ্রতুল। তাঁরা এগিয়ে আসেন না, আগ্রহে কমতি আছে। আমরা কিন্তু তাঁদের সহযোগিতার জন্য প্রস্তুত।
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
মোস্তাফিজুর: আপনাকেও ধন্যবাদ।