খেটে খাওয়া মানুষ এখন বড় অসহায়
শুক্রবার রাত ১০টা। ঢাকার ফাঁকা রাস্তা ধরে আমরা সিএনজিচালিত অটোরিকশায় করে বাসায় ফিরছি। কারওয়ান বাজার পদচারী–সেতুর নিচে ফার্মগেটমুখী সড়কে নেমে গেলাম। বাসায় যেতে একটা রিকশা নেব এবার। সেতুর নিচে কিছু নিম্ন আয়ের মানুষ তখন পণ্যবাহী ট্রাকের অপেক্ষায়। তারাও বাড়ি ফিরবে।
রিকশার জন্য প্রায় ১০ মিনিটের অপেক্ষা শেষে ফার্মগেটের দিকে হাঁটা দিলাম। সেতুর নিচে বসে থাকা নিম্ন আয়ের মানুষ তখনো ট্রাকের অপেক্ষায়। আশা ছিল, ফার্মগেট গিয়ে অন্তত কিছু মানুষ আর রিকশার দেখা মিলবে। তা হলো না। জ্বলজ্বলে সড়কবাতির নিচে শারীরিক ও মানসিকপ্রতিবন্ধী দুই নারী-পুরুষ দাঁড়িয়ে। আর কেউ নেই।
খানিকবাদে রিকশার দেখা মিলল। একা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে চালক নিজেই এগিয়ে এলেন। ভাড়া মিটিয়ে চলতে শুরু করল রিকশা। ইন্দিরা রোড হয়ে রিকশা যাচ্ছে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ের দিকে। এই সড়কে মেট্রোরেলের কাজ নেই। কিন্তু সড়ক বিভাজক হিসেবে দাঁড়িয়ে মেট্রোরেলের সাইনবোর্ড। এতে অন্য লেনটা দেখা যায় না। খানিকটা অন্ধকার। চালক নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে রিকশায় প্যাডেল মারছেন। কিছুটা থমথমে পরিবেশের কারণে মনে হলো সদ্য সাবেক এক রুমমেটের কথা।
কিছুদিন আগেও যখন ঢাকা শহরে নিত্যদিনের কোলাহল ছিল, তার মধ্যেই কল্যাণপুর বাসস্ট্যান্ড এলাকায় তার চলন্ত রিকশায় উঠে বসেন এক যুবক। পেটে ছুরি ধরেই চেয়ে বসেন পকেটে থাকা টাকা আর মুঠোফোন। ধস্তাধস্তির সময়ও চালক রিকশা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। ছুরির আঘাতে কিছুটা আহত রুমমেট লাফ দিয়ে রিকশা থেকে নেমে রক্ষা পেয়েছিলেন। ভাগ্য ভালো ছিল যে আশপাশে ওই দিন মানুষ ছিল। ভয় হলো, সুনসান এই পরিবেশে আমার বেলায়ও যদি এমনটি ঘটে?
খানিকটা ভয় নিয়েই খামারবাড়ি মোড় পেরিয়ে পৌঁছালাম মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে। আমাদের সঙ্গে তখন সমানতালে রিকশা চালাচ্ছিলেন বিজয় সরণির দিক থেকে আসা আরেক চালক। ২৪ কি ২৫ বছরের যুবক। মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ের সড়কবাতির আলোয় তার চেহারাটা স্পষ্ট। ক্ষুধার্ত হলে মানুষের চেহারা যেমন হয়, তেমন।
যাত্রী নয়, খাবারের সন্ধানেই এদিকটায় চষে বেড়াচ্ছেন। সংসদদের বাসভবনের পাশের ফুটপাতের ওপর এক ঝুপড়ি ঘরে আলো জ্বলছে। ওই যুবক রিকশাচালকের নজর সেদিকে। ভেবেছিলেন, হয়তো কোনো খাবারের দোকান। এগিয়ে গিয়ে দেখে হতাশ। গামছা দিয়ে মুখ মুছে চলতে শুরু করলেন ধানমন্ডির দিকে। আমাদের গন্তব্য শ্যামলী।
আমাকে বহন করা রিকশার নির্লিপ্ত চালকের সঙ্গে আলাপ শুরু হলো এবার।
‘মামা, বাসা কই?’
‘মিরপুর, মামা।’
‘রাতে খাইছেন?’
‘না, মামা।’
‘কই খাবেন?’
‘বাসায় গিয়ে।’
‘বাসায় আর কে কে আছে?’
‘কেউ না, মামা। এখন আমি একাই। দুপুরে নিজেই রান্না কইরা খাইছি। বিকেল থেকে এখন পর্যন্ত চার–পাঁচটার বেশি খ্যাপ মারতে পারিনি। এবার আর বাড়িত টাকা পাঠান হবি না। আমিই ক্যামনে চলমু, সেটাই বুঝব্যার পারতেছি না।’
খানিকক্ষণ চুপ। এরপর চালক নিজেই বললেন, ‘বাসায় আমরা ছয়জন থাকতাম। সবাই পেট চালানোর ইনকাম করতে আসছি। না হলে এই শহরে আসতাম না। এখন বাসায় কেউ নাই। বাড়িত গেছে। আমিই না যায়া ভুল করছি। বাড়িত গেলে খাওয়ার কষ্ট করা লাগত না। আল্লাহ কোনো না কোনোভাবে দিন পার করাত।’
বৃহস্পতিবার ওই রিকশাচালকের সঙ্গে আর কথা হয়নি। আগে যা হলো, তার বেশির ভাগই তিনি নিজ থেকে বললেন। খেটে খাওয়া মানুষেরা এমনই। কোনো এক প্রসঙ্গ তুললে গল্পের ঝুড়ি খুলে বসেন।
শুক্রবার রাতে আমরা সিএনজিচালিত অটোরিকশায় করে বাসায় ফিরছি। সঙ্গে আরও সহকর্মী আছেন। সবাই চুপ। ফার্মগেট, ইন্দিরা রোড হয়ে অটোরিকশা উঠল মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে। ফুটপাতের সেই ঝুপড়িঘরে আলো জ্বলছে। মনে হলো, প্রায় সমবয়সী সেই যুবক রিকশাচালকের কথা। ওই রাতে কি সে কোথাও খাবার পেয়েছিল? নাকি রাতভর উপোস থেকে পরদিন গ্রামের বাড়ির পথ ধরেছে? যান চলাচলও তো বন্ধ। ঢাকা শহরে নিশ্চয়ই ভাড়া বাসায় থাকে। এত রাতে বাসা ভাড়া কিংবা পেট চালানোর টাকা আয় করতে সে কি জনমানবহীন শহরে রিকশা নিয়ে ঘুরছে? নাকি আজ (শুক্রবার) রাতে সে বাসাতেই আছে! খেয়ে না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে পেট বাঁচাতে আসা শহরে।