ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরকেন্দ্রিক অপরাধের মধ্যে সোনা চোরাচালান ও মাদক পাচারের ঘটনা বেশি। করোনাকালে উড়োজাহাজ চলাচল বন্ধের সময় এসব অপরাধ কমে গিয়েছিল। উড়োজাহাজ চলাচল স্বাভাবিক হওয়ার পর এই অপরাধ আবার বেড়েছে।
পুলিশ বলছে, বিমানবন্দরকেন্দ্রিক অপরাধের মধ্যে শীর্ষে আছে সোনা চোরাচালান। এরপর মুঠোফোন ও সিগারেট পাচারের ঘটনা।
এই বিমানবন্দরে চোরাচালান হয়ে সোনা আসে আন্তর্জাতিক রুটের উড়োজাহাজে। আর মাদক বেশি আসে অভ্যন্তরীণ রুটের উড়োজাহাজে। গত ২৩ মাসের মামলার তথ্য বিশ্লেষণে এমন চিত্র উঠে এসেছে।
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ পরিস্থিতিতে গত বছরের মার্চে শাহজালাল বিমানবন্দর থেকে উড়োজাহাজ চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এর ফলে বন্ধ ছিল এ ধরনের অপরাধ। তিন মাস পর ওই বছরের জুনে উড়োজাহাজ চলাচল শুরু হলে আবার বেড়ে যায় এ ধরনের অপরাধ। অর্থাৎ এই অপরাধগুলো অনেকটা উড়োজাহাজ চলাচলের সঙ্গে সম্পৃক্ত।
ঢাকা কাস্টম হাউসের উপকমিশনার মারুফুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, হজরত শাহজালাল বিমানবন্দরে চোরাচালানসহ অপরাধ নিয়ন্ত্রণে শুল্ক বিভাগের পাশাপাশি একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা, এপিবিএন ও এভিয়েশন সিকিউরিটির সদস্যরা সমন্বিতভাবে কাজ করছেন। আগে অভিযান চালিয়ে সোনার চালান উদ্ধার করা হতো। এখন কড়াকড়ি নজরদারির কারণে চোরাচালান কমে গেছে। তারা ধরা পড়ার আশঙ্কায় কর দিতে বাধ্য হচ্ছে। গত মাসে (ডিসেম্বর) এই বিমানবন্দরে ২০ কোটি টাকার কর আদায় করা হয়েছে। তবে এখনো টাকার লোভে কিছু যাত্রী চোরাচালানের পণ্য বহন করছে।
যত মামলা
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) সদর দপ্তর সূত্র জানায়, ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২০ সালের নভেম্বর পর্যন্ত (এক বছর ১১ মাস) বিমানবন্দর থানায় মাদকের ১৩৫টি, চোরাচালানের ১২৫টি ও মানব পাচারের অভিযোগে ২৩টি মামলা হয়। এর মধ্যে ২০১৯ সালে মাদকের ৯৫টি, চোরাচালান ৮৭, মানব পাচার ২৩, প্রতারণা ৫, চুরি ৬, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে ২ মামলা হয়। পরের বছর ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত মাদকের ৪০, চোরাচালান ৩৮, মানব পাচার ১, প্রতারণা ৬, চুরি ১২, নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনায় ১টি মামলা হয়।
বিমানবন্দর থানার ওসি বি এম ফরমান আলী প্রথম আলোকে বলেন, কাওলা, হজ ক্যাম্প ও হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নিয়ে বিমানবন্দর থানা গঠিত। থানায় মাদক, চোরাচালান ও মানব পাচার আইনে হওয়া বেশির ভাগ মামলা বিমানবন্দরকেন্দ্রিক। উড়োজাহাজ চলাচলের সঙ্গে এই অপরাধগুলো সম্পৃক্ত। বিমানবন্দরের বাইরেও একই ধরনের কিছু অপরাধের ঘটনা ঘটে। মামলাগুলোর অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে ওসি ফরমান বলেন, দায়ের হওয়া কিছু মামলা আদালতে বিচারাধীন ও কিছু পুলিশের তদন্তাধীন আছে।
গত ১০ বছরে শাহজালাল বিমানবন্দর এলাকা থেকে এপিবিএন এক মেট্রিক টন সোনা আটক করে।এপিবিএনের অতিরিক্ত সুপার আলমগীর হোসেন
গত বছরের ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২১ মার্চ থেকে ১৫ জুন পর্যন্ত অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক রুটে উড়োজাহাজ চলাচল বন্ধ থাকে। ১৬ জুন থেকে তা আবার চালু হয়। তখন থেকে শাহজালাল বিমানবন্দরে মাদক ও চোরাচালান ধরা পড়ে। গত জুন থেকে নভেম্বর পর্যন্ত মাদকের ২১টি, চোরাচালানের ১৭টি মামলা হয়। গত ২১ মার্চ থেকে ১৫ জুন পর্যন্ত সময়ে বিমানবন্দর থানায় ৯টি মাদকের মামলা হলেও সেগুলো বিমানবন্দর কেন্দ্রিক নয়। এসব মামলা বিমানবন্দরের বাইরের এলাকার বলে জানিয়েছেন ওসি ফরমান আলী।
কয়েকটি ঘটনা
গত ১৮ নভেম্বর মধ্যপ্রাচ্যের দুবাই থেকে আসা একটি উড়োজাহাজ শাহজালাল বিমানবন্দরে অবতরণ করে। গোপন খবরের ভিত্তিতে ঢাকা কাস্টম হাউসের কর্মকর্তারা ওই যাত্রীর কাছ থেকে ৬০টি সোনার বার আটক করে। উদ্ধার করা সোনার বারের ওজন ৬ কেজি ৯০ গ্রাম।
একই বছরের ১৮ অক্টোবর হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে রপ্তানি কার্গো হাউসে কর্তব্যরত এভিয়েশনের সদস্যরা সন্দেহজনক গার্মেন্টস পণ্যের কার্টনে থাকা ৩৮ হাজার ৯০০ ইয়াবা বড়ি জব্দ করেন। চালানটি সাউদিয়া কার্গো এয়ারের একটি উড়োজাহাজে সৌদি আরব যাচ্ছিল। ঘটনাস্থল থেকে সন্দেহভাজন দুজনকে আটক করা হয়। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর এ ঘটনায় বিমানবন্দর থানায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা করে।
গত ৯ সেপ্টেম্বরে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে রপ্তানি কার্গো ভিলেজে ডুয়েল ভিউ স্ক্যানারে নিরাপত্তা তল্লাশির সময় এভিয়েশন সিকিউরিটির সদস্যরা রপ্তানি পোশাকের চালানে কোকেনসদৃশ এমফিটামিন নামের বিপুল পরিমাণ নতুন মাদক উদ্ধার করেন। এ সময় রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের ছয় কর্মচারীকে আটক করেন এভিয়েশন সিকিউরিটির সদস্যরা। একটি বিদেশি কুরিয়ারের মাধ্যমে বাংলাদেশ বিমানের একটি উড়োজাহাজে পণ্যগুলো হংকং হয়ে অস্ট্রেলিয়ায় যাওয়ার কথা ছিল।
শাহজালাল বিমানবন্দর এলাকার দায়িত্বে থাকা এপিবিএনের অতিরিক্ত সুপার আলমগীর হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, গত ১০ বছরে শাহজালাল বিমানবন্দর এলাকা থেকে এপিবিএন এক মেট্রিক টন সোনা আটক করে। তিনি বলেন, উড়োজাহাজে আসা চোরাচালান, মাদক জব্দ, মানব পাচারকারী আটকে এপিবিএনের পাশাপাশি বিমানবন্দরে কর্মরত ঢাকা কাস্টম হাউস, শুল্ক গোয়েন্দারা অভিযান চালান। তাঁর দেওয়া তথ্যমতে, আন্তর্জাতিক রুটের উড়োজাহাজে আসে সোনার চোরাচালান। আর মাদক বেশি আসে অভ্যন্তরীণ রুটের উড়োজাহাজে।