এটা দেখে একজনও যদি ভাবেন নারী নির্যাতন করবেন না...
কম্বলের কোনায় সেলাই মেশিনে সেলাই করে স্টিকার লাগানো হচ্ছে। স্টিকারে লেখা, ‘কাপুরুষরাই নারী নির্যাতন করে’। কম্বলের গায়ে এমন লেখার উদ্দেশ্য হলো, শীতের রাতে কম্বল গায়ে দেওয়ার সময় স্টিকারের এই লেখা দেখে যেন একজন পুরুষ ভাবেন তিনি কোনো নারীকে নির্যাতন করবেন না। একজন নারী যেন নির্যাতক পুরুষের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতে পারেন।
বেসরকারি সংগঠন বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের বাসন্তী গার্মেন্টসের তৈরি কম্বলে এমন স্টিকার যুক্ত করা হয়েছে। পুরো কাজ সম্পন্ন করেন নারীরা। তাঁরাই কম্বলের কাপড় কেনা, কাটা, সেলাই, প্যাকিং করাসহ পুরো কাজটি করেন। গত বুধবার গিয়ে দেখা যায়, এই নারীদের কেউ স্টিকার কেটে দিচ্ছিলেন আর কেউ কেউ কম্বলে স্টিকার লাগিয়ে তা সেলাই করে দিচ্ছিলেন। সেলাই মেশিনে ব্যস্ত থাকা ১৫ জন নারীর মধ্যে কয়েকজন বললেন, পুরুষদের নির্যাতন করতে তো আর কোনো কারণ লাগে না। ভাত রান্না হতে দেরি হওয়ার মতো ঘটনায়ও স্ত্রীর গায়ে হাত তোলেন পুরুষেরা। আরও কত কারণ আছে।
‘কাপুরুষরাই নারী নির্যাতন করে’, এ স্টিকার নারী নির্যাতন কমাবে কি না? এই প্রশ্নে কর্মীদের বেশির ভাগই না-সূচক মাথা নাড়লেন। তবে এটাও স্বীকার করলেন, পুরুষকে কাপুরুষ ডাকলে একটু তো গায়ে লাগবেই। তাতে করে অনেকে ভালোও হতে পারেন।
বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের স্বেচ্ছাসেবক সুলতানা জান্নাত বললেন, কম্বল গায়ে দেওয়ার সময় একজন পুরুষও যদি একটু নড়েচড়ে বসেন বা চিন্তাটা মাথায় ঢোকে, সে ভাবনা থেকেই এবার কম্বলে এ স্টিকার লাগানো হচ্ছে।
এ ফাউন্ডেশনের স্বেচ্ছাসেবক রেজিনা পারভীনের মতে, নারীর গায়ে হাত তোলা এবং বিভিন্নভাবে নির্যাতন করার বিষয়টিকে নির্যাতক পুরুষেরা ‘পৌরুষ’ হিসেবে বা তাঁরা ক্ষমতাবান তার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে দেখতে অভ্যস্ত। কিন্তু স্টিকারে স্পষ্ট ভাষায় তাঁদের কাপুরুষ বলা হচ্ছে। এটা অনেক পুরুষেরই মানতে কষ্ট হবে। অনেকে নতুন করে ভাবার অবকাশ পাবেন। আরও স্পষ্ট করে বললেন, নির্যাতক পুরুষের বিরুদ্ধে কোনো না কোনোভাবে আওয়াজ তুলতে হবে এবং আওয়াজটাকে চলমান রাখতে হবে।
বাসন্তী গার্মেন্টসে কর্মরত নারীদের মধ্যেও অনেকে স্বামীর হাতে নির্যাতনের শিকার। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন বললেন, ‘ঘর-সংসার করতে গেলে স্বামীর হাতে মাইর তো খাইতেই হয়।’ বাসন্তী গার্মেন্টসে কর্মরত নারীরা এর আগে ‘এক টাকায় স্যানিটারি ন্যাপকিন’ তৈরি করেছেন।
বাসন্তী হোটেলে নারী ‘অতিথি’ বাড়ছে
বাসন্তী গার্মেন্টসের নিচের ফ্লোরেই বাসন্তী হোটেল। এ হোটেলের পরিচালনার দায়িত্বেও কোনো পুরুষ নেই, পরিচালনাকারীদের সবাই নারী। নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে রাজধানীতে নারীদের জন্য একমাত্র আবাসিক হোটেল বাসন্তী নিবাসে নারী অতিথি বাড়ছে। গত ৮ মার্চ বাসন্তী নিবাস উদ্বোধন হলেও সেদিনই সরকার দেশে প্রথম করানোভাইরাস শনাক্তের কথা জানালে কার্যক্রম বন্ধ করে দিতে হয়। পরে গত ১ সেপ্টেম্বর থেকে হোটেলের কার্যক্রম আবার চালু হয়েছে। ঢাকার বাইরে থেকে আসা চাকরিপ্রার্থী নারীরা প্রতি রাতের জন্য ১৯৯ টাকা ভাড়ায় থাকতে পারছেন। ওয়াইফাই, এসি, কাপড় ধোয়ার জন্য ওয়াশিং মেশিন, ল্যাপটপে পড়ার জন্য আলাদা টেবিলসহ বিভিন্ন সুবিধা পাচ্ছেন নারীরা। শুধু নারীদের বাইরে থেকে খেয়ে আসতে হয় বা বাইরের খাবার ঘরে এনে খেতে পারেন।
বুধবার দুপুরে এ হোটেলে গিয়ে পার্বত্য অঞ্চলসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা বেশ কয়েকজন নারীর সঙ্গে কথা হয়। তাঁরা কোনো না-কোনো চাকরির ইন্টারভিউ দিতে এসেছেন। ঢাকায় দূর সম্পর্কের আত্মীয় আছেন কারও কারও। অনেকের ঢাকায় কেউ নেই।
এই নারীরা জানালেন, শুধু নারীদের জন্য এ হোটেল তাঁদের স্বস্তি দিয়েছে। যাঁর যত দিন প্রয়োজন, তত দিন থেকে চলে যেতে পারবেন, এতে কোনো জবাবদিহি নেই বা কোনো সংকোচবোধ কাজ করবে না। আত্মীয়রা কে কী ভাববেন, সে চিন্তাও করতে হবে না। খরচটাও অনেক কম। শুধু খাবারের চিন্তা ছাড়া এখানে একবার ঢুকে গেলে আর কোনো চিন্তা করতে হয় না।
চট্টগ্রামের এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী সারা। তাঁর বাড়ি আফগানিস্তানে। বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকায় এখন ঢাকায়। বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনে এর আগে স্বেচ্ছাসেবকের দায়িত্ব পালন করেছেন সারা। তিনি প্রায় ১০ দিন ধরে এ হোটেলেই থাকছেন।
আয়োজকেরা জানালেন, বাসন্তী গার্মেন্টসসহ ফাউন্ডেশনের বিভিন্ন উদ্যোগে কর্মরত স্বেচ্ছাসেবকেরাও হোটেলটিতে থাকার সুযোগ পান।
ক্যাপসুল আকারের একতলা ও দোতলা বিছানায় ৩০ জনের বেশি নারীর থাকার ব্যবস্থা আছে বলে জানালেন স্বেচ্ছাসেবক সুলতানা জান্নাত। তিনি বলেন, চাকরি বা ভর্তি পরীক্ষা দিতে ঢাকায় এসে কোথায় থাকবেন, শুধু সে চিন্তায় অনেক নারী শেষ পর্যন্ত আর পরীক্ষা বা ইন্টারভিউ দিতেই আসেন না। নিরাপত্তার বিষয়টি তো ছিলই।
অবশ্য এই হোটেলে সন্ধ্যা সাতটার মধ্যে ফেরার বাধ্যবাধকতা রাখা হয়েছে।
সুলতানা জান্নাত বললেন, বাসন্তী নিবাসে থাকতে চাইলে পরিচয়পত্র নিয়ে আসতে হয়। সব তথ্য যাচাইবাছাই করেই নিবাসীদের থাকতে দেওয়া হয়। বর্তমানে কোনো শিক্ষার্থী ভর্তি পরীক্ষার জন্য এলে প্রতি রাত এক টাকায় থাকার সুযোগ পাচ্ছেন।