এই চক্রের কাছে গামছাই ‘প্রাণঘাতী অস্ত্র’
সুভাষ চন্দ্র সূত্রধর পরিবারের হাল ধরতে দেশ ছেড়েছিলেন ২০১৩ সালের শেষভাগে। পেশায় রংমিস্ত্রি। মাটি কামড়ে পড়েছিলেন সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে। করতেন রংমিস্ত্রির কাজ। বিয়ে করতে দেশে এসেছিলেন। ফেরার পথে ঢাকার খিলক্ষেতে খুন হন। তাঁকে গামছা পেঁচিয়ে কারা খুন করল, তা এখনো জানতে পারেনি পুলিশ।
ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা (গুলশান) বিভাগের উপকমিশনার মশিউর রহমান সুভাষের হত্যাকারীদের খুঁজছেন। রোববার তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সুভাষের স্ত্রী ঋতু রানী, তাঁর বৃদ্ধ মা বিচার চেয়ে কাঁদছেন। আসামি গ্রেপ্তারে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছেন তাঁরা।
সুভাষের ভাইপো অর্পণ সূত্রধর প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর কাকা ২০২০ সালের নভেম্বরে দেশে এসেছিলেন বিয়ে করতে। বিয়ের পর লকডাউনে আটকা পড়েন।
অনেক চেষ্টার পর ৮ মে আবারও যাওয়ার ব্যবস্থা হয়। কোভিড পরীক্ষার জন্য আগেই বাড়ি ছাড়তে হয় তাঁকে। ৫ মে সন্ধ্যার দিকে বগুড়ার শিবগঞ্জ থানার মোকামতলা বাসস্ট্যান্ডে যান। দেশজুড়ে গণপরিবহন বন্ধ। অপেক্ষা ঢাকাগামী যেকোনো পরিবহনের। শেষ পর্যন্ত একটা মাইক্রোবাস জোগাড় হয়। রাত সাড়ে ৯টার দিকে তাঁরা মোকামতলা ছাড়েন। রাত ২টা ৩৭ মিনিট পর্যন্ত স্ত্রীর সঙ্গে কথাও হয়। কথোপকথনের একপর্যায়ে তিনি বলেছিলেন, মাইক্রোবাসে তিনজন যাত্রী কম আছে। পরে যাত্রী ওঠাতে মাইক্রোবাস কোথাও থেমেছিল কি না তা, জানেন না তাঁরা। মধ্যরাতে হঠাৎ সুভাষের ফোন থেকে একটা ফোন আসে। কেউ একজন বলেন, সুভাষ রিকশা থেকে পড়ে মারা গেছেন। এরপর ফোনটা বন্ধ হয়ে যায়। পরে খিলক্ষেত থানা থেকে জানানো হয় সুভাষের মৃত্যুসংবাদ।
পুলিশ জানায়, সুভাষকে রক্তাক্ত অবস্থায় কুড়িল বিশ্বরোডের ৩০০ ফিটমুখী ফ্লাইওভারের ওপর থেকে পাওয়া যায়। পুলিশ কাদের সন্দেহ করছে? ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) উপকমিশনার মশিউর রহমান বলেন, তাঁদের অভিজ্ঞতা বলে বাস, মিনিবাস চলাচল যখন বন্ধ থাকে, তখন তুরাগ, উত্তরার আবদুল্লাহপুর, হাউজিংয়ের মোড়, কামারপাড়া, বিমানবন্দর থেকে ঢাকা মহানগরীর ভেতরে যাতায়াতের জন্য অনেকেই সিএনজি অটোরিকশা, মাইক্রোবাস, প্রাইভেট কার অথবা মালবাহী পিকআপে উঠে থাকেন। গণপরিবহনের স্বল্পতার সুযোগ নিয়ে এসব পরিবহন অনেক সময় চালায় ছিনতাইকারী বা ডাকাত চক্রের লোকজন। তারাই গাড়ির চালক সাজে, তিন–চারজন সাজে সহযাত্রী। তারপর গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়ার কথা বলে ভুক্তভোগীদের এলোপাতাড়ি চড়, ঘুষি মারতে থাকে চক্রটি। তারপর সঙ্গে থাকা গামছা দিয়ে দুই দিক থেকে চেপে ধরে। টাকাপয়সা, স্বর্ণালংকার ও মুঠোফোন ছিনিয়ে নেওয়ার সময় ভুক্তভোগী ব্যক্তি বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলে খুন করে ফেলে তারা।
পুলিশের এই কর্মকর্তা জানান, এর আগেও কুড়িল ফ্লাইওভারে এ রকম একাধিক লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। লাশ উদ্ধার হয়েছে পূর্বাচলগামী ৩০০ ফিট রাস্তা এবং রাস্তার পার্শ্ববর্তী খাল থেকে, মগবাজার ফ্লাইওভারের ওপর এবং নিচ থেকে। ডাকাতি বা ছিনতাই করার মতো প্রাণঘাতী অস্ত্র বা মালামাল না থাকায় এবং এসব অপরাধীর চলনবলন নিরীহ প্রকৃতির হওয়ায় এরা কখনো নিরাপত্তাচৌকিতে বা পুলিশি টহলেও ধরা পড়ে না। সাধারণ গামছাকেই প্রাণঘাতী অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে এরা।
পুলিশ আরও জানায়, কুড়িল-বিশ্বরোড উড়ালসড়ক, পূর্বাচল ৩০০ ফিট এক্সপ্রেসওয়ে এলাকা ঝুঁকিপূর্ণ। এখানে নানা ধরনের নির্মাণকাজ হচ্ছে। সে কারণে আলোকবাতি, সিসি ক্যামেরা ইত্যাদির অভাব আছে। ঢাকা মহানগরীর এ অঞ্চলগুলোতে প্রশস্ত ও ফাঁকা রাস্তা হওয়ার কারণে অপরাধীরা অপরাধ করে মাঝেমধ্যেই নির্বিঘ্নে পালিয়ে যেতে পারে। পুলিশ নগরবাসীকে গভীর রাতে অপরিচিত প্রাইভেট কার, মাইক্রোবাস ও সিএনজিতে রাইড শেয়ার না করার অনুরোধ করেছে।