আকালের দিনে মিলনের স্বপ্ন এখন শুধুই চাল-ডাল

বয়স কত হবে? মেরেকেটে তিরিশ। বেশি হওয়ার সম্ভাবনা নেই। নাম মো. মিলন হোসেন। আদি নিবাস? যাঁরা জীবনসংগ্রামের জন্য স্বপ্নের ঢাকা শহরে আসেন, তাঁদের আদি নিবাস কিংবা সাকিন হয় জেলার নাম। মিলনের জেলার নাম যশোর। বুড়ো বাপ-মা, স্ত্রী, সন্তান মিলিয়ে পাঁচ সদস্যের সংসার তাঁর। কৃষি মার্কেট থেকে ফেরার পথে তাঁর সঙ্গে কথা হয়, তখন বেলা দুটোর কিছু বেশি। মিলন বলছিলেন, তিনি ফিরবেন চাল-ডাল নিয়ে। তারপর রান্না হবে। তারও পরে খাওয়া। তিনি বাদে আরও চারজন বসে আছেন বাড়িতে। এর মধ্যে দুজন বয়স্ক মানুষ।

প্রায় সপ্তাহখানেক পর সংসারের প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস কিনতে বাসা থেকে রওনা দেওয়ার সময় গলির মুখে মিলন এগিয়ে এসে আমাকে রিকশায় তুলেছিলেন। তারপর যখন আনাজপাতি কিনব বলে তাঁকে ছেড়ে দেওয়ার কথা ভাবছি, তখন তিনি জানান, তিনি আমার জন্য অপেক্ষা করবেন। বুঝলাম, এই আকালের দিনে কিছুক্ষণ অপেক্ষার বিনিময়ে বাড়তি কিছু টাকা তিনি হাতছাড়া করতে চাচ্ছেন না। আমি সায় দিয়ে এবং তাঁকে টাকা না দিয়েই জিনিসপত্র কেনাকাটা করে ফেললাম। আমাকে দেখে এগিয়ে এলেন মিলন। এবার ফিরতি পথে।

করোনাকালের এই সময়ে হাতে বেশ সময় থাকে আর রাস্তাঘাট কল্পনার চেয়ে বেশি ফাঁকা বলে রিকশাওয়ালাদের সঙ্গে বেশ কথাবার্তা হচ্ছে। মিলনের সঙ্গেও সেভাবেই শুরু হয়েছিল আলাপচারিতা। মোহাম্মদপুর এখন করোনাভাইরাসের হটস্পট। আদাবর, শেখেরটেক, বছিলা ইত্যাদি জায়গায় করোনার জমজমাট উৎসব চলছে। এই হটস্পটেই থাকি আমরা দুজন—মিলন ও আমি। মিলন হাসতে হাসতে যশোর-ঢাকার মিশ্র ভাষায় বললেন, ভাইজান, দেখছেন করোনা ক্যামনে শোয়ায় দিল মানুষগো। তারপর নীরবতা। বেশ কয়েকবার পেডেল মেরে তিনি আবার বললেন, যদি মরি, আমার বাড়ির লোকজনগো কী হইব! বুইড়া বাপ-মা। বউটা জোয়ান। নাহয় আর একটা বিয়া বইব, যদি বাঁইচা থাকে। কিন্তু পোলাডার কী হইব? তারপর হে হে করে হেসে উঠে মিলন বলেন, মইরা যাওয়াই ভালো। বাঁইচা থাকাটাই কঠিন এই সময়। মইরা গেলে খাওনের চিন্তা নাই।

ভরদুপুরের ঠাটা রোদে রিকশা ভ্রমণের আনন্দ তখন আর মাথায় নেই। নীরব শ্রোতা হিসেবে শুনতেও ভালো লাগছে না মিলনের নিরেট বাস্তব কথাবার্তা। ধাক্কা লাগে তো। কোথায় যেন ধাক্কা লাগে। করোনার এই নতুন হটস্পটে যারাই আমরা আছি, এখনো (সম্ভবত) সুস্থ আছি, তাদের সবাই কি আমরা মিলনের মতোই ভাবছি? যদি মরে যাই...।

রিকশাচালক মিলন হোসেন ঢাকা শহরে রিকশা চালান প্রায় ১২ বছর। এবারই এত অর্থনৈতিক কষ্টে পড়েছেন তিনি। ছবি: লেখক
রিকশাচালক মিলন হোসেন ঢাকা শহরে রিকশা চালান প্রায় ১২ বছর। এবারই এত অর্থনৈতিক কষ্টে পড়েছেন তিনি। ছবি: লেখক

আচ্ছা, মিলন কি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সেই জানাজার সংবাদ জানেন, যেখানে সম্ভবত কয়েক হাজার মানুষ উপস্থিত হয়েছিলেন? জানেন না মনে হয়। নইলে আমি নিশ্চিত, মিলন সেটা নিয়ে কিছু একটা জানতে চাইতেন আমার কাছে। অথবা হাসতে হাসতে বলতেন, দ্যাখছেন ভাইজান, মানুষ কত বোকা। কিন্তু মিলন তেমন কিছুই বলেন না আমাকে। আমি জানি, এই মুহূর্তে তিনি যতই হাসতে হাসতে কথা বলুন না কেন, তাঁর মাথার ভেতর ঘুরছে, তিনি ছাড়া আরও চারজন মানুষ বসে আছেন শেখেরটেক ১২ নম্বরের কোনো ঝুপড়ি বাড়িতে। তিনি ফিরলে পর রান্না হবে। তারও পরে খাওয়া। অথচ ইনকাম অর্ধেকের নিচে। আছে রিকশা জমার চাপ, প্রতিদিন এক শ টাকা।

বাসার সামনে চলে আসি আমরা। কত দেব, জানতে চাইলে মিলন হোসেন বললেন, ইনসাফ মতো দ্যান। ইনসাফ! এই করোনাকালে রিকশাওয়ালা মিলন আর চাকরিজীবী মধ্যবিত্ত আমার মধ্যকার পার্থক্য যখন কয়েক দিন আর কয়েক মাসের কাজ বন্ধ থাকা, তখন ইনসাফ করতেও বড় ভয় করে।