রায়েরবাজার বধ্যভূমি স্মৃতিসৌধ: দেশের গান আর শ্রদ্ধার ফুলে ফুলে ছেয়ে গেছে
কুয়াশার চাদর সরিয়ে শীতের সকালের রোদ তখনো এসে প্রকৃতিকে স্পর্শ করেনি। রাজধানীর রায়েরবাজারে শহীদ বুদ্ধিজীবী বধ্যভূমি স্মৃতিসৌধের প্রাঙ্গণ তার আগেই মুখর হয়ে উঠেছিল দেশাত্মবোধক গান, আবৃত্তি আর শ্রদ্ধা নিবেদন করতে আসা অগণিত মানুষের সমাগমে। তাঁরা ফুলে ফুলে ভরিয়ে দিয়েছেন স্মৃতিসৌধের বেদি।
আজ বৃহস্পতিবার সকাল পৌনে সাতটা থেকে রায়েরবাজার বধ্যভূমি স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদনের পর্ব শুরু হয়। মন্ত্রী, বীর মুক্তিযোদ্ধা, শিক্ষক-ছাত্র, রাজনীতিকসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ ব্যানার আর পুষ্পস্তবক নিয়ে শোভাযাত্রা করে বধ্যভূমি স্মৃতিসৌধে আসেন শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে মহান মুক্তিযুদ্ধে জীবন উৎসর্গ করা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য।
একাত্তরে রায়েরবাজারের এ স্থানে ছিল পরিত্যক্ত ইটখোলা। মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত বিজয়ের আগের মুহূর্তে এখানেই পাকিস্তানের ঘাতক সেনাবাহিনী তাদের সহযোগী রাজাকার, আলবদর, আলশামসদের সঙ্গে করে দেশের কৃতী শিক্ষক, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, শিল্পী, চিকিৎসক, দার্শনিক, আইনবিদ, রাজনীতিকসহ বুদ্ধিজীবীদের বাড়ি বাড়ি হানা দিয়ে তাঁদের তুলে এনে নির্মম নির্যাতন করে এই ইটখোলায় হত্যা করেছিল। মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পর এখান থেকে বুদ্ধিজীবীদের হাত বাঁধা মৃতদেহ পাওয়া যায়। প্রকাশ হয়ে যায় বাঙালিদের মেধাশূন্য করতে পাকিস্তানের খুনি বাহিনীর ঘৃন্য ষড়যন্ত্র। সেই শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্মরণেই এখানে তৈরি করা হয়েছে বধ্যভূমি স্মৃতিসৌধ।
জাতীয় পতাকা, শহীদ বুদ্ধজীবীদের ছবিসংবলিত পোস্টার, মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন ঘটনার ছবি, পত্রিকার কাটিং, ব্যানার আর ফুলে ফুলে সাজানো হয়েছিল বধ্যভূমি স্মৃতিসৌধ চত্বর। এর দক্ষিণ প্রান্তের সবুজ চত্বরে কেন্দ্রীয় খেলাঘর আসর শহীদ বুদ্ধিজীবীদের ছবি, ফুল ও পতাকা দিয়ে একটি স্থাপনা তৈরি করে।
তার পাশের ইটের স্তূপের ওপরে খেলাঘরের ছোট ছোট শিশুরা শহীদ বুদ্ধিজীবীদের মৃতদেহের অনুসরণে শুয়ে থেকে সেদিনের সেই দৃশ্যপট তৈরি করে।
এ ছাড়া স্মৃতিসৌধের উত্তর প্রান্তে ছিল মহান মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন ঘটনার ছবি নিয়ে একটি বড় স্থাপনাকর্ম।
মুক্তিযুদ্ধে বিভিন্ন সেক্টরের ছবির বড় বড় ডিজিটাল প্রিন্ট, ব্যানার, প্ল্যাকার্ড দিয়ে এ প্রান্ত সুসজ্জিত করেছিল মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠন ‘ব্রিগেড-৭১’। এ ছাড়া শিল্পকলা একাডেমির আয়োজনে স্মৃতিসৌধের মূল চত্বরের সামনে উন্মুক্ত স্থানে ব্যানার টাঙিয়ে আবৃত্তি, সংগীত পরিবেশনার আয়োজন করা হয়। এতে কবিতা পাঠ করেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা, সংগীত পরিবেশন করেন শিল্পী স্বরলিপিসহ অনেকে। ‘সব কটা জানালা খুলে দাও না’, ‘একবার যেতে দে না আমার ছোট্ট সোনার গাঁয়’, ‘সূর্যোদয়ে তুমি সূর্যাস্তেও তুমি’—এমন দেশাত্মবোধক গানে গানে একটা অন্য রকম আবহ সৃষ্টি হয়েছিল স্মৃতিসৌধ চত্বরে।
বধ্যভূমি স্মৃতিসৌধে মন্ত্রীদের মধ্যে সকালে শ্রদ্ধা জানাতে এসেছিলেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, তথ্যমন্ত্রী হাসান মাহমুদ। এ সময় ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করেছে। ভবিষ্যতেও এ বিচারকাজ চলতে থাকবে।
এ ছাড়া আওয়ামী লীগের পক্ষে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মতিয়া চৌধুরী, জাহাঙ্গীর কবির নানকসহ অনেকে।
রাজনীতিকদের মধ্যে সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্সের নেতৃত্বে সিপিবি, বাসদের পক্ষ থেকে রাজেকুজ্জামান রতনসহ আওয়ামী যুবলীগ, শ্রমিক লীগ, ছাত্রলীগ, বিপ্লবী ছাত্রমৈত্রীসহ বিভিন্ন শ্রমজীবী পেশাজীবী সংগঠনের পক্ষ থেকে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হয়। এ ছাড়া বীর মুক্তিযোদ্ধা, সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম, স্মৃতি একাত্তরসহ বিভিন্ন সংগঠন থেকে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়।
রায়েরবাজার বধ্যভূমি স্মৃতিসৌধে রাজধানীর বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে শ্রদ্ধা জানানো হয়েছে। এখানে তরুণ ও শিশু-কিশোরদের উপস্থিতিই ছিল বেশি। সংগঠন ছাড়া ব্যক্তিগতভাবেও এসেছেন বহু মানুষ। অনেকেই কালো ব্যাজ ও কালো পাঞ্জাবি বা সাদা-কালো প্রিন্টের শাড়ি পরেছিলেন।
সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মাকসুদ কামালের নেতৃত্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। এ ছাড়া জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা কলেজ, তিতুমীর কলেজ, লরেল ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, জাতীয় জাদুঘর, শিল্পকলা একাডেমিসহ বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। প্রায় বেলা ১২টা পর্যন্ত শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের পালা চলতে থাকে।