‘দিন আনি দিন খাই, ঘরে বাজার নাই, আমি তো কাজ পেলাম না’
নিজের আবাদি জমি নেই, তাই কাজের সন্ধানে সাতক্ষীরা থেকে রাজধানীতে এসেছেন আবুল মিয়া। পরিবার নিয়ে থাকেন গাবতলী বেড়িবাঁধ এলাকার সিটি কলোনিতে। দিনমজুরের কাজ করে পাঁচজনের সংসার চালান। আবুল প্রতিদিন সকালে মোহাম্মদপুর শিয়া মসজিদ মোড়ের শ্রমিকের হাটে আসেন কাজের খোঁজে।
আজ শনিবার সকালেও কাজের খোঁজে শিয়া মসজিদ মোড়ে এসে দাঁড়িয়েছেন আবুল। তাঁর মতো অর্ধশতাধিক দিনমজুর শ্রমিক জড়ো হয়েছিলেন। অন্যান্য দিন সকাল ৭টার মধ্যেই অনেকে দৈনিক মজুরির হিসেবে কাজ পেয়ে যান। কিন্তু আজ ৮টার পরেও কেউ কাজ পাননি। বিএনপির ঢাকা বিভাগীয় সমাবেশকে কেন্দ্র করে সকাল থেকেই রাজধানীর সড়কে লোকজনের উপস্থিতিই কম।
দিনমজুরদের এই হাটে পুরুষ শ্রমিকের পাশাপাশি কাজের আশায় এসেছেন নারী শ্রমিকেরাও। কাজের সন্ধানের এসেছিলেন আলপনা আকতার। পরিবার নিয়ে তিনি থাকেন ঢাকা উদ্যান এলাকায়। আলপনা বলেন, ‘সমাবেশ না কি জানি হবে। তার সঙ্গে আমাদের তো কোনো লেনাদেনা নাই। দিন আনি দিন খাই, ঘরে বাজার নাই। কিন্তু আমি তো কাজ পেলাম না।’
আবুল মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘দিনে ৫০০-৬০০ টাকা হিসেবে দিনমজুরের কাজ করি। তিন ছেলেমেয়ে, স্ত্রীকে নিয়ে পাঁচজনের সংসার। আমার আয়েই চলে। আজ মনে হচ্ছে কাজ পাওয়া যাবে না। পুলিশও দাঁড়াতে দিতে চাচ্ছে না। একটু পরেই চলে যাব।’
উপস্থিত শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রতিদিন সকালে শিয়া মসজিদ মোড়ে বসে এই শ্রমিকের হাট। গাবতলী, মোহাম্মদপুর, বেড়িবাঁধ ও আশপাশের এলাকার শ্রমিকেরা দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে কাজের আশায় এখানে ভিড় করেন। এখানে আসার আগেও শ্রমিকেরা জানেন না কাজ মিলবে কিনা। ইট ভাঙা, নির্মাণকাজ, জোগালি, রাজমিস্ত্রি, রাজমিস্ত্রির সহকারী, কাঠমিস্ত্রি, বস্তা টানা, মাটি কাটা, ড্রেন পরিষ্কার থেকে শুরু করে এমন কোনো কাজ নেই, যা তাঁরা করেন না।
শিয়া মসজিদ মোড়ে নুরানী টাওয়ারের সিঁড়ি, ফুটপাত ও সামনের সড়ক বিভাজকের ওপর বসে কাজ পাওয়ার অপেক্ষা করছিলেন শ্রমিকেরা। তাঁদের একজন আনোয়ার হোসেন। তিনি থাকেন কৃষি মার্কেট এলাকায়। আনোয়ার বলেন, ‘রাজনীতি আমরা বুঝি না। কাজ করি, টাকা পাই, সংসার চালাই। এক দিন কাজ না পেলেই কষ্ট হয়ে যায়। সকাল থেকে একজন লোকও শ্রমিক নিতে আসেন নাই।’
অভিজ্ঞতা আর কাজের ওপর ভিত্তি করে দৈনিক ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা পর্যন্ত মজুরি পেয়ে থাকেন শ্রমিকেরা। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অপেক্ষাকৃত কম মজুরিতে কাজে যেতে রাজি হন শ্রমিকেরা। যাঁরা কাজ পাবেন না, তাঁদের ভাবনা বাড়িতে গিয়ে কীভাবে কাটবে বেকার একটি দিন।
কাজের অপেক্ষায় থাকা শ্রমিকেরা নিজেদের মধ্যে গল্প করেই সময় কাটাচ্ছিলেন। তাঁদের একেকজনের জীবনকাহিনি একেক রকম। মোহাম্মদপুরে নবীনগর হাউজিং এলাকায় থাকেন রিজভী বেগম। তাঁর স্বামী নেই। দুই ছেলেমেয়েকে নিয়ে তার সংসার। তিনি বলেন, ‘জোগালির কাজ করি। দিনে ৫০০-৬০০ টাকা পাই। আজকে কাজ পাব না, ঘরে চলে যাব।’
দিনমজুর শ্রমিকদের সমাগমের জায়গাটিকে শ্রমিকেরা নিজেরা ডাকেন ‘মার্কেট’ বলে। শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শিয়া মসজিদ ছাড়াও মোহাম্মদপুর টাউন হল, মিরপুর ১ নম্বর মুক্তবাংলা শপিং কমপ্লেক্স, মিরপুর ১২ নম্বরের কালশী সড়কেও এমন শ্রমিকের হাট রয়েছে।
আজ রাজধানীর গোলাপবাগ মাঠে বিএনপির ঢাকা বিভাগীয় গণসমাবেশ। সমাবেশকে কেন্দ্র করে একজনের প্রাণহানি, দলের মহাসচিবসহ চার শতাধিক নেতা-কর্মীর গ্রেপ্তার, দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয় তছনছ, গত তিন দিনে এমন অনেক উত্তাপ ছড়িয়েছে। এই সমাবেশকে ঘিরে সাধারণ মানুষের মনেও রয়েছে শঙ্কা। আজ সকাল থেকেই রাজধানীর রাস্তাঘাট ফাঁকা। সড়কে যানবাহনের সংখ্যা কম। পথচারী ও যাত্রীর উপস্থিতিও হাতে গোনা। প্রতিটি সড়কের মোড়ে মোড়ে সতর্ক অবস্থানে রয়েছে পুলিশ।
শিয়া মসজিদ মোড়ে শ্রমিকদের হাটের পাশেই অবস্থান নিয়েছেন আদাবর থানার পুলিশ সদস্যরা। তাঁদের দুজন শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলছিলেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক পুলিশ সদস্য বলেন, ‘আজকের সমাবেশকে ঘিরে পুলিশ সতর্ক। তার মধ্যে এমন ৭০-৮০ জন এক জায়গায় জড়ো হওয়ায়, তাদের সরে যেতে বলা হয়েছে। বুঝতে পারছি তাঁরা দিনমজুর শ্রমিক, কিন্তু আমাদের কিছু করার নেই।’