সিদ্দিকবাজারে বিস্ফোরণ: একে একে মারা গেলেন তাঁরা তিনজন
রাজধানীর সিদ্দিকবাজারে বিস্ফোরণ ঘটা সেই ভবনের বেজমেন্টে ‘বাংলাদেশ স্যানিটারি’ নামের দোকানটিতে ছিলেন তিনজন কর্মী। বিস্ফোরণের ঘটনায় একে একে তিনজনই মারা গেলেন।
শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আজ শনিবার সকালে মারা যান মৃধা আজম। তিনি লাইফ সাপোর্টে ছিলেন।
মৃধা আজমের লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তরের সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ স্যানিটারি মালিক আবদুল মোতালিবের ভাই আবদুস সাত্তার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের দোকানে তিনজন কর্মকর্তা-কর্মচারী ছিলেন। তাঁদের সবাই মারা গেছেন। আগে একজনের লাশ পাওয়া যায়। পরে দুজন লাইফ সাপোর্টে থাকা অবস্থায় মারা যান।’
মৃধা আজম পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে সবার বড় ছিলেন। পরিবারে স্ত্রী, পাঁচ বছরের এক মেয়ে, মা, বাবা ও পড়াশোনা করা তিন ভাইবোনের সবাই তাঁর আয়ের ওপর নির্ভরশীল। পরিবারের সবাইকে নিয়ে তিনি থাকতেন রাজধানীর মধুবাগে। তাঁদের গ্রামের বাড়ি পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলায়।
আজমের চাচা আবুল বাশার প্রথম আলোকে বলেন, আজম আগে ঢাকায় চায়ের দোকান করতেন। একার আয়ে চলছিল না দেখে তাঁর বাবাকে সেই দোকানে বসিয়ে তিনি বাংলাদেশ স্যানিটারিতে চাকরি নেন। ওর বাবাও অসুস্থতার কারণে বেশ কিছুদিন ধরে দোকান করতে পারছিলেন না। এই অবস্থায় তাঁদের পরিবারের কী হবে, এখন কেউ জানে না।
এর আগে বিস্ফোরণের তৃতীয় দিনে বাংলাদেশ স্যানিটারির ব্যবস্থাপক মেহেদী হাসান ওরফে স্বপনের (৪০) লাশ উদ্ধার করতে পারে ফায়ার সার্ভিস। তাঁর বাড়ি নোয়াখালীর সোনাইমুড়ী উপজেলায়। আর গত বৃহস্পতিবার রাতে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের লাইফ সাপোর্টে থাকা অবস্থায় মারা যান দোকানটির কর্মী ইয়াসিন আলী। তাঁর বাড়ি নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে।
এদিকে এই বিস্ফোরণের ঘটনায় ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার ভবনমালিকসহ তিনজনের দুই দিনের করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত। সেই তিনজনের মধ্যে রয়েছেন বাংলাদেশ স্যানিটারি দোকানের মালিক আবদুল মোতালিব হোসেন মিন্টু। আজ শনিবার রিমান্ড শেষ হওয়ার কথা।
বার্ন ইনস্টিটিউটে গত মঙ্গলবার এই বিস্ফোরণের পর ১২ জন ভর্তি হন। তাঁদের মধ্যে মো. মোস্তফা (৫০) ও কামাল শেখ (৪০) নামের দুজন চিকিৎসা নিয়ে চলে যান। একজনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। ইয়াসিন ও আজম ছাড়াও মো. মুসা (৪৫) নামের আরেকজনের মৃত্যু হয়। এখন বার্ন ইনস্টিটিউটে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) থাকা দুজনের মধ্যে একজন লাইফ সাপোর্টে রয়েছেন।
বাকি চারজনের শরীরের পাশাপাশি কারও কারও শ্বাসনালিও পুড়েছে। গ্লাসসহ ছিটকে আসা বিভিন্ন পদার্থে শরীরও কেটেছে।
বার্ন ইনস্টিটিউটের সমন্বয়ক অধ্যাপক সামন্ত লাল সেন জানান, এখানে ভর্তি কারও অবস্থা এখনো উন্নতির দিকে যায়নি।
অসহায় তাঁরাও
ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালেও মো. রাজন (১৮) নামের একজন আইসিইউতে ভর্তি আছেন। তিনি সিদ্দিকবাজারে একটি ইলেকট্রিক দোকানে কাজ করতেন। তাঁর গ্রামের বাড়ি শেরপুরের শ্রীবরদী উপজেলায়। তাঁরা থাকেন ঢাকার উত্তর মুগদায়। তাঁর বাবা মো. জাফর আলী রাজধানীর ৮ নম্বর পরিবহনের একটি বাসের চালকের সহকারী। মা নাছিমা পোশাকশ্রমিক।
অভাব–অনটনে জাফর–নাছিমা দুই ছেলে ও এক মেয়ের কাউকে পড়াশোনা করাতে পারেননি। এর মধ্যে করোনার আগে জাফর ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হন। তার পর থেকে তিনি হৃদ্যন্ত্রসহ শরীরে নানা সমস্যায় ভুগছেন। মেয়ের কিডনিতে সমস্যা। এর মধ্যে ছেলে রাজন দুর্ঘটনার শিকার হয়ে আইসিইউতে।
নাছিমা প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার সব দিক দিয়াই বিপদ। হেয় (স্বামী) অসুস্থ। মাইয়্যা অসুস্থ। আবার ছেলের এই অবস্থা। আমার সব দিক দিয়াই টানা–ছ্যাচড়া করা লাগতেছে।’
ঢাকা জেলা প্রশাসন থেকে ১৫ হাজার টাকা সহায়তা দিয়েছে, তা দিয়ে চিকিৎসার পাশাপাশি নিজেরাও চলছেন জানিয়ে নাছিমা বলেন, ‘এরপর কী হবে, তা জানি না।’
সিদ্দিকবাজারের ঘটনায় ঢামেক হাসপাতালে ১৭৩ জনকে আনা হয়। তাঁদের মধ্যে ২০ জনকে ভর্তি রাখা হয়। চিকিৎসা নিয়ে ছয়জন বাড়ি ফিরেছেন। বর্তমানে এখানে ১৪ জন ভর্তি আছেন।
ঢামেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. নাজমুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের এখানে আইসিইউতে থাকা ব্যক্তির অবস্থা এখনো স্থিতিশীল নয়। তবে বাকি ১৩ জনের উন্নতি হচ্ছে।’