ডেঙ্গু পরিস্থিতি: শিশুরা আক্রান্ত হচ্ছে বেশি
ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত নাতনি হাফসাকে (৭) নিয়ে নারায়ণগঞ্জের বাসিন্দা লিপি আক্তার পাঁচ দিন ধরে আছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। হাফসা গত (অক্টোবর) মাসের পুরোটা জুড়েই টাইফয়েডে ভুগেছে। পাঁচ দিন সুস্থ থাকার পর আবারও ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়। শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে নারায়ণগঞ্জের ক্লিনিক থেকে ঢাকায় নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। হাফসা নারায়ণগঞ্জের একটি স্কুলে নার্সারিতে পড়ে।
হাসপাতালের শিশু বিভাগে গিয়ে আজ সোমবার দুপুরের দিকে দেখা হলো লিপি আক্তারের সঙ্গে। তিনি বললেন, শুধু হাফসা নয়, ওর মা-ও ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। তিনি হাসপাতালে ভর্তি আছেন।
হাসপাতালের চিকিৎসা নিয়ে খুশি লিপি আক্তার। তিনি বলছিলেন, ‘এখানকার চিকিৎসা খুবই ভালো। নাতনি প্রায় সুস্থ।’
দেশে এই নভেম্বর মাসেও ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ছে। ‘এই নভেম্বর মাস’ শব্দগুলো যোগ করা হলো এ জন্যই যে সাধারণত এ মাসে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্তের সংখ্যা কমে আসে। দেশে গত ২৪ বছরের অভিজ্ঞতা এমনই। কিন্তু এবার এর ব্যতিক্রম হচ্ছে।
আর এ বছর উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছে শিশুরা। তাদের মধ্যে আবার হাফসার মতো স্কুলগামী শিক্ষার্থী বেশি। এই হাসপাতাল এবং রাজধানীর আগারগাঁওয়ের বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটে গিয়ে দেখা গেছে, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত শিশুদের সংখ্যা বাড়ছে। বড় বিপদ হলো, শিশুরা ডেঙ্গুর মধ্যে অন্য রোগেও আক্রান্ত হচ্ছে।
স্কুলগামী শিশুরা আক্রান্ত হচ্ছে বেশি
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরে এখন পর্যন্ত (১০ নভেম্বর) শূন্য থেকে ১৫ বছর বয়সী ১২ হাজার ২১৪টি শিশু ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে। তাদের মধ্যে আবার ৭ হাজার ৯৮৪ জনই ৬ থেকে ১৫ বছর বয়সী। এ বয়সী শিশুরা সাধারণত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যায়। সে অনুযায়ী মোট আক্রান্ত শিশুর ৬৫ শতাংশের বেশি স্কুলগামী।
এখন পর্যন্ত শূন্য থেকে ১৫ বছর বয়সী শিশুদের মধ্যে ৪৭ জন ডেঙ্গুতে মারা গেছে। আবার তাদের মধ্যে ২৫ শিশুর বয়স ৬ থেকে ১৫ বছরের মধ্যে। অর্থাৎ ডেঙ্গুতে মারা যাওয়া শূন্য থেকে ১৫ বছর বয়সী শিশুদের মধ্যে ৫৩ শতাংশেরই বয়স ছিল ৬ থেকে ১৫ বছরের মধ্যে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ মুশতাক হোসেন বলছিলেন, সার্বিকভাবে মশার নিয়ন্ত্রণে জোর তৎপরতার অভাব আছে। স্বাভাবিকভাবেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ কর্মকাণ্ড যথাযথভাবে হচ্ছে না। স্কুলে বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গিয়ে শিশুরা যে আক্রান্ত হচ্ছে না, তা নিশ্চিত করে বলা যায় না।
চলতি বছর ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশি থাকলেও মার্চ মাস থেকে তা কমতে থাকে। জুন পর্যন্তও একটা সহনীয় অবস্থায় ছিল। কিন্তু জুলাই থেকে তা বাড়তে থাকে। জুলাই ও আগস্ট মাসে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের সময় ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের কার্যক্রম অনেকটাই স্থবির হয়ে আসে। জুলাইয়ের পর থেকে দেশে ডেঙ্গুর ব্যাপক বৃদ্ধিতে এর ভূমিকা আছে বলে মনে করেন জনস্বাস্থ্যবিদেরা।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু বিভাগের অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান লুৎফন নেছা বলেন, আমাদের ৩টি ইউনিটে প্রতিদিন প্রায় ১৫ থেকে ২০ জন শিশু চিকিৎসা নেয়। ৭ থেকে ১৩ বছরের শিশুই বেশি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকাসহ শহরাঞ্চলে শিশুরা ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছে বেশি।
সিটি করপোরেশনসহ স্থানীয় সরকারের প্রতিষ্ঠানগুলোর ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো কি যথেষ্ট অগ্রাধিকার পাচ্ছে না? এমন প্রশ্নের জবাবে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ভারপ্রাপ্ত প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ফজলে শামসুল কবীর প্রথম আলোকে বলেন, ‘শিশুদের আক্রান্ত হওয়ার বিষয়টি নিঃসন্দেহে উদ্বেগজনক। কিন্তু দক্ষিণ সিটির ৮৩৬ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রতিটিতেই আমরা সচেতনতামূলক কর্মসূচি করেছি, প্রয়োজনীয় ওষুধও দেওয়া হয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার দায়িত্ব শুধু সিটি করপোরেশনের না, এটি স্কুল কর্তৃপক্ষেরও। দায়িত্ব নিয়ে এসব কাজ স্কুলগুলোকে করতে হবে।’
স্কুলগামী শিশুদের মধ্যে ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশি হচ্ছে। কিন্তু তারা যে স্কুল গিয়েই যে আক্রান্ত হচ্ছে, তা নিশ্চিত করে বলা যায় না বলে মনে করেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক শেখ দাউদ আদনান। তিনি বলেন, ডেঙ্গু মশা সাধারণত সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বেশি কামড়ায়। এ সময়টায় শিশুরা স্কুলে যায় বা বিকেলের দিকে মাঠে খেলা করে। এখন এই হেমন্তকালেও গরম ভাব রয়েছে প্রকৃতিতে। তাই শিশুরা সাধারণত স্কুলে বা মাঠে যেখানেই থাকুক, সেখানে হাফশার্ট বা হাফপ্যান্ট পরে থাকে। অর্থাৎ তাদের শরীরের অনেকটাই অনাবৃত থাকে। তাই মশার কামড় খাওয়ার আশঙ্কাও থাকে।
শিশুদের ডেঙ্গু বাড়ছে
বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের বিশেষায়িত ডেঙ্গু কর্নারের একটি শয্যায় ব্যথায় কাতরাচ্ছে চার বছর বয়সী মরিয়ম। শিশুটির মাথায় হাত বুলিয়ে তাকে শান্ত করতে চেষ্টা করছেন নানি রত্না। মরিয়মের মা শূন্যদৃষ্টি নিয়ে বসে আছেন বিছানার এক কোণে। তাঁদের বাড়ি গোপালগঞ্জে। চলতি মাসের শুরুতে হঠাৎ জ্বর আসে মরিয়মের। তিন দিন পর শুরু হয় খিঁচুনি। চোখমুখ উল্টে আসে শিশুটির। এরপর গোপালগঞ্জ সদরের একটি ক্লিনিকে ভর্তি করা হলে তিন দিন পর সেখানকার চিকিৎসকের পরামর্শে ঢাকায় নিয়ে আসেন। ভর্তি করেন শিশু হাসপাতালে।
এই হাসপাতালের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত এখানে ৫৯১টি শিশু ডেঙ্গু নিয়ে ভর্তি হয়েছিল। এর মধ্যে মারা গেছে সাতটি শিশু। গত বছর আক্রান্তের সংখ্যা ছিল দুই হাজারের বেশি। আর মারা গিয়েছিল ২৩ শিশু। গত বছর সবচেয়ে বেশি ৫৫৮টি শিশু ডেঙ্গু নিয়ে ভর্তি হয়েছিল আগস্ট মাসে। এরপর থেকে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা কমতে থাকে। তবে চলতি বছর সবচেয়ে বেশি ২৪৪ শিশু আক্রান্ত হয়েছে অক্টোবর মাসে। আর এ মাসের প্রথম ১০ দিনে ৮৮ শিশু ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে।
ডেঙ্গুর মধ্যে হচ্ছে অন্য অসুখও
গতকাল রোববার থেকে আজ সোমবার পর্যন্ত সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় শিশু হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ১১টি শিশু। এখন ডেঙ্গু নিয়ে ভর্তি শিশুর সংখ্যা ৪৫। এই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত শিশুদের অনেকেই আবার টাইফয়েড, জন্ডিস, নিউমোনিয়া ছাড়াও পেটের নানা অসুখে আক্রান্ত।
দেড় বছরের শিশু তাওহিদের জ্বর আর খিঁচুনি উঠলে গত শনিবার তাকে বিশেষায়িত ডেঙ্গু কর্নারে ভর্তি করা হয়। শিশুটির মা জানান, শ্বাসকষ্টের সমস্যায়ও আছে শিশুটির। পাশের শয্যায় বুধবার থেকে ভর্তি সাড়ে পাঁচ বছর বয়সী রিয়া মণি। ডেঙ্গুর সঙ্গে পেটের পীড়ায় আক্রান্ত সে।
চিকিৎসকেরা বলছেন, ডেঙ্গুর সঙ্গে শিশুর শরীরে অন্যান্য রোগ বাসা বাঁধার কারণ অভিভাবকদের অসচেতনতা। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে স্বাভাবিকভাবেই শিশুর রুচি কমে যায়। খেতে চায় না। অভিভাবকেরা অসচেতনভাবে নানা খাবার খেতে দেন। শরীর দুর্বল থাকায় অন্যান্য রোগে সহজেই আক্রান্ত হয় শিশু।
শিশু হাসপাতালে চিকিৎসক মাহমুদুল হক চৌধুরী বলছিলেন, এখন অনেক শিশু ডেঙ্গুর সঙ্গে অন্যান্য রোগ যেমন জন্ডিস, নিউমোনিয়া ছাড়াও পেটের পীড়ায় আক্রান্ত হচ্ছে। তাদের চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় শয্যা দেওয়া হচ্ছে।