কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সম্পূর্ণ ভিন্ন এক পরিবেশে গতকাল রোববার ক্লাসে ফিরেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। দীর্ঘ ১১২ দিন পর ক্লাসে ফিরতে পেরে স্বস্তি প্রকাশ করেছেন শিক্ষার্থীরা। একই সঙ্গে ক্যাম্পাসে নির্যাতন–নিপীড়নের মতো কোনো ঘটনা যাতে আর না ঘটে, সেই প্রত্যাশার কথাও বলেছেন তাঁরা।
ক্লাসে ফেরা নিয়ে বিভিন্ন বিভাগ ও বর্ষের ১০ জন শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। তাঁদের একজন রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী মো. ফাহিম। তিনি বলেন, ‘এক নতুন বাংলাদেশে ভয়ভীতিমুক্ত ক্যাম্পাসে ফিরতে পেরেছি। ক্যাম্পাসে এই স্বস্তি বজায় থাকুক।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮৪টি বিভাগ ও ইনস্টিটিউটের মধ্যে ৫টি বিভাগ ছাড়া সব বিভাগে ক্লাস হয়েছে বলে গতকাল দুপুরে প্রথম আলোকে জানান প্রক্টর সাইফুদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, সকাল আটটা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগে ক্লাস শুরু হয়। বেশির ভাগ বিভাগে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি ছিল উল্লেখযোগ্য।
অবশ্য প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের ক্লাস এখনো শুরু হয়নি। ৩০ সেপ্টেম্বর থেকে প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের ক্লাস শুরু হবে বলে জানান প্রক্টর।
গতকাল সকাল সাড়ে ৯টার দিকে ক্যাম্পাসের নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট ভবন চত্বরে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে নিহতদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এ সময় সেখানে উপাচার্য নিয়াজ আহমেদ খান, সহ–উপাচার্য মামুন আহমেদ ও সায়মা হক বিদিশা, কোষাধ্যক্ষ জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীসহ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। এরপর সকাল সাড়ে ১০টা থেকে বিভিন্ন অনুষদে গিয়ে শ্রেণিকক্ষ পরিদর্শন করেন উপাচার্যসহ প্রশাসনের পদস্থ শিক্ষকেরা। তাঁরা বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলেন।
ঈদুল আজহার আগে গত ২ জুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছুটি শুরু হয়। ছুটি শেষে ১ জুলাই থেকে শ্রেণি কার্যক্রম তথা ক্লাস শুরু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সর্বজনীন পেনশনের ‘প্রত্যয়’ স্কিম প্রত্যাহারের দাবিতে সেদিন থেকে সর্বাত্মক কর্মবিরতিতে যান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা। অন্যদিকে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে আন্দোলন শুরু করেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের পৃথক আন্দোলনে গত জুলাইয়ে কার্যত অচল হয়ে পড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
শিক্ষার্থীদের আন্দোলন দমাতে দমন-পীড়নের পথ বেছে নিয়েছিল বিগত আওয়ামী লীগ সরকার। এর ফলে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন একপর্যায়ে সরকার পতনের আন্দোলনে রূপ নেয়। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসার পর গতকাল থেকে আবার শ্রেণি কার্যক্রম শুরু হলো।
ছাত্র–শিক্ষক সংলাপ
শিক্ষক–শিক্ষার্থীদের মধ্যে আন্তসম্পর্ক উন্নয়নের লক্ষ্যে সিনেট ভবনে গতকাল ইউনিভার্সিটি এডুকেটরস্ ফোরাম নামের একটি সংগঠনের উদ্যোগে ছাত্র-শিক্ষক সংলাপ হয়েছে। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ–উপাচার্য (শিক্ষা) মামুন আহমেদসহ বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা বক্তব্য দেন। শিক্ষক–শিক্ষার্থীদের মধ্যে আন্তসম্পর্ক উন্নয়নের জন্য শ্রেণিকক্ষে পাঠদান পদ্ধতি আরও উন্নত করা, শিক্ষক নিয়োগে যথাযথ মানদণ্ড বজায় রাখা এবং শিক্ষকদের অভিভাবকসুলভ আচরণ করার বিষয়টি সংলাপে উঠে আসে।
সিন্ডিকেট ভেঙে দেওয়ার দাবি
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান সিন্ডিকেট (সর্বোচ্চ নীতনির্ধারণী ফোরাম) ভেঙে দেওয়ার দাবিতে গতকাল বিকেলে ক্যাম্পাসে ‘নিপীড়নবিরোধী শিক্ষার্থীবৃন্দ’—এই ব্যানারে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান সিন্ডিকেটকে ‘আওয়ামী দালাল সিন্ডিকেট’ বলে উল্লেখ করেছে তারা। বিক্ষোভ মিছিলে বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনের নেতা–কর্মীরাও অংশ নেন।
বিভিন্ন অনিয়ম–অসংগতি ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে বাম ছাত্রসংগঠনের নেতা–কর্মীসহ সাধারণ শিক্ষার্থীদের উদ্যোগে ‘নিপীড়নবিরোধী শিক্ষার্থীবৃন্দ’ নামে অধিকারভিত্তিক নতুন একটি প্ল্যাটফর্ম বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় গড়ে তোলা হয়। গতকাল তাঁরা ক্যাম্পাসের বিভিন্ন এলাকায় মিছিল শেষে রাজু ভাস্কর্যের সামনে জড়ো হন এবং সমাবেশ করেন। সমাবেশে বলা হয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমান সিন্ডিকেট গত জুলাই–আগস্টের গণ–আন্দোলন ও অভ্যুত্থানের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিল। তারা নিপীড়কের পক্ষে ছিল। এই সিন্ডিকেট কোনোভাবেই বহাল থাকতে পারে না।