আহির ভৈরব সুরে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান
সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে আহির ভৈরব সুরে সারেঙ্গিবাদনের ভেতর দিয়ে রাজধানীর রমনার বটমূলে শুরু হয়েছে ছায়ানটের বর্ষবরণ ১৪৩০–এর অনুষ্ঠান। প্রায় আট মিনিটের এ পরিবেশনার পর শুরু হয় গানের পালা।
সম্মেলক গানের ফাঁকে ফাঁকে বিশিষ্ট শিল্পীদের একক কণ্ঠে থাকছে গান ও আবৃত্তি। এবারের গানগুলো সাজানো হয়েছে নতুন স্নিগ্ধ আলোয় স্নাত প্রকৃতির গান, মানবপ্রেম, দেশপ্রেম, আত্মবোধন আর জাগরণের সুরবাণী দিয়ে। অনুষ্ঠানটি রমনা বটমূল থেকে বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বাংলাদেশ বেতার সরাসরি সম্প্রচার করছে। এ ছাড়া ছায়ানটের ইউটিউব চ্যানেলেও সরাসরি অনুষ্ঠান দেখানো হচ্ছে।
রাজধানীতে ১৯৬৭ সালে প্রথম রমনার বটমূলে পয়লা বৈশাখের সূর্যোদয়ের সময় সংগীতানুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল সংগীত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছায়ানট। সেই অনুষ্ঠানই মূলত বাংলা নববর্ষ বরণের সাংস্কৃতিক উৎসবকে সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রেরণা যুগিয়েছে।
সেই থেকে (১৯৬৭) পয়লা বৈশাখ উদ্যাপনের একটা অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গও হয়ে উঠেছে ছায়ানটের বর্ষবরণের আয়োজন। এরপর কেবল ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় বৈরী পরিবেশের কারণে অনুষ্ঠান হতে পারেনি। ২০০১ সালে এ গানের অনুষ্ঠানে জঙ্গিরা ভয়াবহ বোমা হামলা করলেও অনুষ্ঠানের ধারাবাহিকতায় ছেদ পড়েনি। এর মধ্যে করোনার কারণে ২০২০–২১ সালে বর্ষবরণের এই আয়োজন সম্ভব হয়নি। দুই বছর পর গত বছর সাড়ম্বরে রমনার বটমূলে বর্ষবরণের অনুষ্ঠান করে ছায়ানট।
ছায়ানটের পাশাপাশি বর্ষবরণে থাকছে চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রা। সাধারণত নববর্ষে পান্তা-ইলিশসহ নানা রকম দেশি খাবারের আয়োজন থাকে। তবে এবার পবিত্র রমজানে দিনের বেলায় এসব খাবারের আয়োজন থাকছে না। আর সব কর্মসূচিও রমজানের মর্যাদা রক্ষা করে উদ্যাপন করা হবে বলে আগেই জানিয়েছেন আয়োজকেরা।
বাংলায় নববর্ষ কেবল একটি বার্ষিক আনুষ্ঠানিকতার ভেতরে সীমিত নয়; এর সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব সুদূরপ্রসারী। এই দিনে জাতি-ধর্ম-বর্ণ-ধনী-দরিদ্রনির্বিশেষে সর্বস্তরের মানুষ একসঙ্গে একই অনুভবে একাত্ম হয়ে উৎসবে শামিল হন। উদ্যাপন করেন বাংলার গৌরবময় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার।
পয়লা বৈশাখের এই উৎসব পরিণত হয়েছে সবচেয়ে বড় উৎসবে। ইতিহাসবিদেরা মনে করেন, মোগল সম্রাট আকবরের প্রবর্তিত ‘ফসলি সন’-এর অনুসরণ করে হিজরি ৯৬৩ মোতাবেক ১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলা সনের গণনা শুরু হয়েছিল। হিজরি সাল গণনা হয় চান্দ্রমাসের হিসাবে। এতে কৃষকদের থেকে বার্ষিক খাজনা আদায়ে সমস্যা হচ্ছিল। সেই সংকট নিরসনের জন্যই সম্রাট আকবর হিজরি ও গ্রেগরিয়ান বর্ষপঞ্জির সমন্বয় করে নতুন ‘ফসলি সন’ প্রবর্তন করেছিলেন, যেটির শুরু হয় ‘বৈশাখ’ মাস থেকে।
বর্তমান সময়ে যদিও দৈনন্দিন জীবনের কাজকর্ম, শিক্ষা, বাণিজ্য—সবকিছুই গ্রেগরিয়ান বর্ষপঞ্জি অনুসরণ করেই সম্পন্ন হয়ে থাকে, তবু বাংলার নিজস্ব বর্ষপঞ্জি একেবারে নিষ্প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েনি। বিশেষত, কৃষিনির্ভর এ দেশে চাষাবাদের ক্ষেত্রে এখনো কৃষকেরা বাংলা মাসের হিসাবই গণনা করে থাকেন। এ ছাড়া বিভিন্ন ধর্ম-সম্প্রদায় তাদের ধর্মীয় রীতি, আচার-অর্চনা, মাঙ্গলিক আয়োজনের ক্ষেত্রেও বাংলা দিনক্ষণের গণনা অনুসরণ করে থাকে। ফলে, বাংলা বর্ষপঞ্জি ক্ষেত্রবিশেষে গুরুত্বের সঙ্গেই কার্যকর রয়েছে।
বছরের প্রথম দিনটিকে আনন্দঘন উৎসব আয়োজনের মধ্য দিয়ে উদ্যাপন করার রীতি-রেওয়াজ বহু প্রাচীন; পৃথিবীর বহু দেশে তা প্রচলিত। আমাদের দেশে নাগরিক পরিসরে পয়লা বৈশাখের উৎসব মূলত সাংস্কৃতিক কর্মসূচিকে কেন্দ্র করেই সম্পন্ন হয়ে থাকে। দেশের ঐতিহ্যবাহী লোকসংস্কৃতির বিভিন্ন উপাদান-উপকরণের বিপুল সমারোহ ঘটে পয়লা বৈশাখের উৎসবে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, লালন সাঁই, হাসন রাজা, শাহ আবদুল করিমের গানসহ বাংলার বৈচিত্র্যময় সংগীতভুবনের হরেক রকম গান কণ্ঠে নিয়ে সকাল থেকে সুরে সুরে আকাশ ভরিয়ে তোলেন গায়কেরা। এসব গানে থাকে পুরোনো বছরের ব্যর্থতা, গ্লানি পেছনে ফেলে নতুন বছরে নতুন সম্ভাবনায় অগ্রগামী হওয়ার প্রত্যাশা। সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে ‘এসো হে বৈশাখ এসো এসো...’ গানের সুর।