গভীর রাতে শেখ হাসিনার ‘ঘৃণাস্তম্ভের’ গ্রাফিতি মোছায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ, প্রক্টরের পদত্যাগ দাবি
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষককেন্দ্র (টিএসসি)-সংলগ্ন মেট্রোরেলের পিলারে থাকা শেখ হাসিনার গ্রাফিতি (‘ঘৃণাস্তম্ভ’) গতকাল শনিবার দিবাগত রাতে মুছে ফেলা হয়। ঘটনাটি জানাজানি হলে শিক্ষার্থীরা তাৎক্ষণিকভাবে টিএসসিসংলগ্ন রাজু ভাস্কর্যের পাশের ‘ঘৃণাস্তম্ভের’ সামনে জড়ো হন। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর সাইফুদ্দিন আহমেদের অনুমতি নিয়ে এই কাজ করা হয়েছে জেনে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ শুরু করেন। তাঁরা প্রক্টরের পদত্যাগ দাবি করেন।
গতকাল দিবাগত রাত আড়াইটা থেকে বিক্ষোভ শুরু হয়। ভোর সাড়ে চারটা পর্যন্ত বিক্ষোভ চলে। ‘ঘৃণাস্তম্ভে’ থাকা গ্রাফিতিটি অর্ধেকটা মুছে ফেলা হয়েছিল। পরে ‘ঘৃণাস্তম্ভে’ শেখ হাসিনার আরেকটি গ্রাফিতি আঁকা হয়।
যা ঘটেছিল
গতকাল দিবাগত রাত দুইটার দিকে ঘৃণাস্তম্ভটিতে থাকা গ্রাফিতি মুছে ফেলা হচ্ছিল। বিষয়টি লক্ষ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থী মহিউদ্দিন ইকবাল ও প্রথম আলোর এই প্রতিবেদক।
যাঁরা গ্রাফিতি মুছে ফেলছিলেন, তাঁদের কাছে এই কাজ করার কারণ জানতে চান মহিউদ্দিন ইকবাল। গ্রাফিতি মুছে ফেলা বন্ধ করতে বলেন।
পরে ঘটনাটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের একটি গ্রুপে পোস্ট করা হয়। গ্রুপে শিক্ষার্থীরা এই গ্রাফিতি মুছে ফেলার প্রতিবাদ জানান।
পরবর্তী সময় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক সমন্বয়ক হাসিব আল ইসলামসহ আরও কয়েকজন ঘটনাস্থলে আসেন। এটি কেন মুছে ফেলা হচ্ছে—এমন প্রশ্ন তোলেন তাঁরা। এর পেছনে কারা জড়িত, কার অনুমতিতে এমনটা করা হচ্ছে, তা তাঁরা জানতে চান।
তখন মেট্রোরেলের পক্ষ থেকে ঘটনাস্থলে থাকা এই কাজের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ইউসুফ আহমেদ বলেন, এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের অনুমতি নেওয়া হয়েছে।
এ কথা শুনে শিক্ষার্থীরা তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
পদত্যাগ দাবি
এই ঘটনায় প্রক্টর সাইফুদ্দিন আহমেদকে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হওয়ার জন্য শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে আহ্বান জানানো হয়। তিনি দিবাগত রাত সাড়ে তিনটার দিকে ঘটনাস্থলে আসেন।
ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে প্রক্টর বলেন, গোয়েন্দা সংস্থার লোকেরা যখন মন্ত্রণালয়ের কাছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছবি পাঠায়, তখন এখানে থাকা দুটি ছবিও (শেখ মুজিব ও শেখ হাসিনা) চলে যায়। তাই তাঁরা (মন্ত্রণালয়) প্রশ্ন তোলেন, এখনো এই দুজনের ছবি থাকবে কেন? তাঁকে বিষয়টি জানানো হলে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের এস্টেট অফিসারকে বলেন। এস্টেট অফিসার তখন মেট্রোরেলকে বলে দেন। তাদের (মেট্রোরেল) পক্ষ থেকে লোক পাঠিয়ে এটা মুছে ফেলা হচ্ছিল।
প্রক্টরের এমন মন্তব্যে শিক্ষার্থীরা ক্ষোভে ফেটে পড়েন। এটা যে ‘ঘৃণাস্তম্ভ’, তা কি প্রক্টর জানতেন না—এমন প্রশ্ন করেন শিক্ষার্থীরা।
তখন স্লোগান ওঠে, ‘বাহ্ প্রক্টর চমৎকার, স্বৈরাচারের পাহারাদার’, ‘খুনি হাসিনার দালালেরা হুঁশিয়ার-সাবধান’, ‘লেগেছেরে লেগেছে, রক্তে আগুন লেগেছে’, ‘খুনির ছবি মুছল কারা, স্বৈরাচারের দোসর তারা’; ‘জুলাইয়ের চেতনা বৃথা যেতে দেব না’, ‘ঘৃণাস্তম্ভ মুছল কেন, প্রক্টর জবাব চাই’।
উপস্থিত শিক্ষার্থীরা তখন প্রক্টর ও এস্টেট অফিসার ফাতেমা বিনতে মোস্তফার পদত্যাগ দাবি করেন।
ষড়যন্ত্র নয়, ভুল: প্রক্টর
শিক্ষার্থীদের এমন প্রতিক্রিয়ায় ঘটনাস্থলে প্রক্টর সাইফুদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘ভুল তো আমাদেরও হতে পারে।’
প্রক্টর বলেন, প্রয়োজনে এই ভুলের জন্য তিনি বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ক্ষমা চাইবেন। তবু যেন শিক্ষার্থীরা তাঁকে ভুল না বোঝেন। এটা ষড়যন্ত্র নয়, ভুল।
পরে ভোর সাড়ে চারটার দিকে এস্টেট অফিসার ফাতেমা বিনতে মোস্তফাও ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘সব প্রক্টর জানেন। আমি কিছু বলতে পারছি না।’
এর আগে রাত তিনটার দিকে এ ঘটনা শুনে ঘটনাস্থলে আসেন জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্যসচিব আখতার হোসেন। এসেই তিনি নিন্দা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
আখতার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আন্দোলনের পর থেকে এটা সারা পৃথিবীতে ‘ঘৃণাস্তম্ভ’ বা হাসিনাকে ঘৃণার প্রতীক। এখানে শিক্ষার্থীদের রক্তের দাগ লেগে আছে। কে বা কারা কোন উদ্দেশ্যে এই রক্তচিহ্ন মুছে দিতে চায়, তা তদন্ত করে বের করে তাদের বিচারের আওতায় আনতে হবে।’
ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক সমন্বয়ক আবদুল কাদের ও আবু বাকের মজুমদার। তাঁরাও একই কথা বলেন।
আবদুল কাদের প্রশ্ন করেন, প্রক্টর এটার অনুমতি কীভাবে দেন?
বাকের বলেন, ‘আমাদের তিন ছাত্র উপদেষ্টা এটি জেনেছেন এবং তাঁরা এটার নিন্দা জানিয়েছেন।’
ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ফেসবুকে তাৎক্ষণিক পোস্ট দেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখপাত্র উমামা ফাতেমা। তিনি লিখেন, ‘২৪-এর ঘৃণাস্তম্ভ আবার আঁকানো হবে। জুলাইকে মুছে দে্য়া এত সহজ না।’
আরেক পোস্টে প্রক্টরের পদত্যাগ দাবি করেন উমামা ফাতেমা।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক সমন্বয়ক আশরেফা খাতুন আজ রোববার সকালে ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে বলেন, আগের ছবিটাই (গ্রাফিতি) চান। আগের ছবির মতো ঘৃণা আর কোনোটায় প্রকাশ পাবে না। আর যে বা যারা মুছেছেন, সবার খোঁজ চান।
প্রক্টর সাইফুদ্দিন আহমেদ আজ প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটি “ঘৃণাস্তম্ভ” হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে স্বীকৃতি দেওয়া হবে। এটার উদ্বোধন করবেন উপাচার্য। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সব ধরনের গ্রাফিতি সংরক্ষণ করবে। কেউ মুছে ফেললে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’