ঢাকা দক্ষিণ সিটির সড়কে একটু পরপর গর্ত, খানাখন্দ
দক্ষিণ সিটির প্রকৌশল বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ৩০ শতাংশ সড়কে গর্ত-খানাখন্দ তৈরি হয়েছে।
পুরান ঢাকার জুরাইন রেলগেট থেকে দয়াগঞ্জ মোড় পর্যন্ত সড়কের দৈর্ঘ্য আড়াই কিলোমিটারের কিছুটা বেশি। গেন্ডারিয়া নতুন রাস্তা হিসেবে পরিচিত এ সড়কের প্রায় পুরোটাই উঁচু-নিচু। কোথাও বড় গর্ত, কোথাও পিচ উঠে গেছে, কোথাও দেবে গেছে। দুই বছর ধরে এ অবস্থা। শুষ্ক মৌসুমে এই সড়কে কেউ রিকশা বা লেগুনায় চলাচল করলে ঝাঁকুনিতে শরীর ব্যথা হয়ে যায়। আর বৃষ্টির সময় আতঙ্কে থাকতে হয়, এই বুঝি গাড়ি উল্টে গেল!
গত মঙ্গলবার বিকেলে সামান্য বৃষ্টিতেই গেন্ডারিয়া নতুন রাস্তার কিছু অংশ ডুবে যায়। সড়কের যে অংশে পানি জমেনি, সে অংশ প্রায় এক ফুট গভীর কাদা জমে যায়। রিকশাচালকদের বেশির ভাগই ওই কাদাপথে যেতে রাজি হচ্ছিলেন না। পানি-কাদার মধ্যেই ঝুঁকি নিয়ে যাত্রী পরিবহন করছিল লেগুনা। সড়কের কিছু অংশ হয়ে রিকশা চলারও কোনো উপায় নেই।
জুরাইন রেলগেট থেকে মঙ্গলবার বিকেলে কোনোরকমে ওই পথটুকু লেগুনায় করে পার হন বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের কর্মী মো. জাকারিয়া। তাঁর সঙ্গে কথা হয় দয়াগঞ্জ মোড়ে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, জুরাইন-দয়াগঞ্জের মানুষ কীভাবে যে এই সড়কে চলাচল করে, তা অন্য এলাকার লোকজন বুঝবে না!
গেন্ডারিয়া নতুন রাস্তার মতো ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আওতাধীন বেশ কিছু সড়ক চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। করপোরেশনের প্রকৌশল বিভাগের তথ্য বলছে, দক্ষিণ সিটির আওতাধীন এলাকায় ১ হাজার ৬০০ কিলোমিটারের বেশি সড়ক রয়েছে। এর মধ্যে ৩০ শতাংশ সড়কের কোথাও গর্ত, কোথাও খানাখন্দ তৈরি হয়েছে। এসব সড়কে চলাচলের ক্ষেত্রে মানুষের সমস্যা হচ্ছে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটির তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী কাজী মো. বোরহান উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, বিভিন্ন এলাকার সড়ক সংস্কারে কাজ শুরু হয়েছে। তবে বৃষ্টির কারণে কাজের গতি বাড়ানো যাচ্ছে না। আগামী ১০ থেকে ১৫ দিনের মধ্যে ভাঙা সড়ক সংস্কারে পুরোদমে কাজ শুরু হবে।
সায়েদাবাদ-যাত্রাবাড়ীর সড়ক বেশি খারাপ
ঢাকা দক্ষিণ সিটির প্রকৌশল বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, সায়েদাবাদ-যাত্রাবাড়ী এলাকার সড়কের অবস্থা এখন বেহাল। এর মধ্যে টিকাটুলীর মোড় থেকে যাত্রাবাড়ী মোড় পর্যন্ত মেয়র মোহাম্মদ হানিফ উড়ালসড়কের নিচের অংশের অবস্থা খুব খারাপ। সেখানে সড়কে একটু পরপর বড় বড় গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। এর ফলে স্বাভাবিকভাবে গাড়ি চলতে না পারায় যানজট লেগেই থাকছে।
টিকাটুলীর মোড় থেকে যাত্রাবাড়ী পর্যন্ত হাটখোলা সড়কে পণ্য নিয়ে সপ্তাহে অন্তত তিনবার যাতায়াত করেন পিকআপ ভ্যানের (ছোট ট্রাক) চালক আবদুল কাদের। এ সড়কের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ইচ্ছার বিরুদ্ধে এ সড়কে চলতে হয়। ভাঙা সড়কে চলতে গিয়ে পিকআপের অবস্থাও খারাপ হয়ে যাচ্ছে।
এ ছাড়া দয়াগঞ্জ রেলসেতুর নিচের সড়ক, যাত্রাবাড়ীর মীরহাজীরবাগ এলাকা ও দোলাইরপাড় থেকে যাত্রাবাড়ী মোড় পর্যন্ত সড়কও চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। এসব সড়কে বিভিন্ন সেবা সংস্থার খোঁড়াখুঁড়ি ও বৃষ্টির পানি জমে থাকায় এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। একই অবস্থা বাংলাদেশ ব্যাংকের পেছনের সড়কেরও। এই সড়ক কাটা হয়েছে পানিনিষ্কাশনের জন্য পাইপ বসানোর জন্য। কয়েক মাস ধরে এ কাজ চলায় মানুষ চরম দুর্ভোগের মধ্যে পড়েছে।
সিটি করপোরেশনের প্রকৌশলীরা বলছেন, মতিঝিলের অভিসার সিনেমা হল–সংলগ্ন পদচারী–সেতুর নিচের সড়ক এবারের বৃষ্টিতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আবার বিদ্যুৎ ও পানির সংযোগ লাইনের জন্য এ সড়ক কাটতে হয়েছে।
বৃষ্টিতে খানাখন্দ তৈরি হয়েছে সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালের আশপাশের সব সড়কে। একই অবস্থা ডেমরার বর্ণমালা স্কুল রোডেরও। এ ছাড়া ধলপুর আউটফল স্টাফ কোয়ার্টারের পশ্চিম পাশের সড়ক, বাসাবো-মাদারটেক প্রধান সড়ক, হাতিরপুল বাজারের সামনের সড়ক, মগবাজার থেকে মালিবাগের দিকে যাওয়ার প্রধান সড়ক, মুগদা হাসপাতালের সামনের সড়ক ও বাসাবো-মাদারটেক প্রধান সড়কে ছোট-বড় গর্ত তৈরি হওয়ায় যানবাহন চলাচলে সমস্যা হচ্ছে।
সড়কের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে অবগত রয়েছেন বলে জানান ঢাকা দক্ষিণ সিটির প্রশাসক নজরুল ইসলাম খান। তিনি গতকাল শুক্রবার রাতে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, করপোরেশনের নিজস্ব তহবিল থেকে দ্রুত সড়কের সংস্কারকাজ শুরু করতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
সড়ক সংস্কার হয় না দীর্ঘদিন
দক্ষিণ সিটিতে নতুন যুক্ত হওয়া ১৮টি ওয়ার্ডের অলিগলির বেশির ভাগ সড়কের অবস্থা খুব খারাপ। নতুন ওয়ার্ড ৬৬ নম্বরের সাবেক কাউন্সিলর আবদুল মতিন সাউদ প্রথম আলোকে বলেন, ডেমরার ডগাইর ও বামৈল এলাকা যখন ইউনিয়ন পরিষদের অধীন ছিল, তখন সড়ক নির্মাণ ও উন্নয়নে যে কাজ হয়ছিল, সিটি করপোরেশনে যুক্ত হওয়ার পর সে অর্থে তেমন কিছু হয়নি। বৃষ্টি হলে এলাকার বেশির ভাগ সড়ক ডুবে থাকে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটির দুজন প্রকৌশলী নাম না প্রকাশ করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, শেখ ফজলে নূর তাপস মেয়র থাকার সময় শ্যামপুর শিল্পাঞ্চল এলাকার বিভিন্ন সড়কের উন্নয়নে ১৩৭ কোটি টাকার কাজ হয়েছিল। এর বাইরে সুনির্দিষ্ট এলাকা ধরে বড় কোনো কাজ তাঁর সময়ে হয়নি। আর দক্ষিণ সিটিতে নতুন যুক্ত হওয়া ১৮টি ওয়ার্ডে সড়ক সংস্কারে তেমন কোনো কাজ তিনি করেননি।
জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্য বংশাল থেকে তাঁতীবাজার মোড় হয়ে বাবুবাজার ব্রিজ পর্যন্ত সড়কের এক পাশ কেটে পাইপ বসাচ্ছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি। নর্থ-সাউথ রোড নামে পরিচিত এ সড়কে পাইপ বসানোর কাজটি গত দেড় বছরেও শেষ করা যায়নি। গুলিস্তান থেকে সদরঘাটমুখী মানুষকে এই পথ হয়েই চলাচল করতে হয়। আবার দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সদরঘাট হয়ে রাজধানীতে আসা মানুষ ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় যেতে বংশালের এ সড়ক ব্যবহার করেন। পদ্মা সেতু হয়ে বাবুবাজার হয়ে অনেকে ঢাকায় আসেন এ সড়ক হয়েই।
পুরান ঢাকার অন্যতম ব্যস্ত এ সড়ক দীর্ঘদিন ধরে কেটে ফেলে রাখায় দিনের বেশির ভাগ সময় যানজট হচ্ছে। রাতেও যানজট থাকছে।
নগর–পরিকল্পনাবিদদের সংগঠন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান প্রথম আলোকে বলেন, সড়ক উন্নয়ন ও সংস্কারের জন্য সিটি করপোরেশন প্রতিবছর শত শত কোটি টাকা খরচ করে। তাহলে সড়ক টেকসই হয় না কেন? এর কারণ, বরাদ্দ হওয়া টাকার পুরোটা সড়ক সংস্কারে খরচ হয় না। কাজ শুরুর আগেই কমিশন ও ভাগাভাগিতে বরাদ্দের ২০-৩০ শতাংশ প্রভাবশালীর পকেটে চলে যায়। রাজনৈতিক বিবেচনায় ঠিকাদার নিয়োগ হয় এবং নিম্নমানের নির্মাণ উপকরণ ব্যবহৃত হয়। ফলে সড়ক টেকসই হয় না। এই সংস্কৃতি এখন পাল্টাতে হবে।
আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ঢাকার যেসব সড়কে খানাখন্দ, সেসব সড়ক জরুরি ভিত্তিতে সংস্কারে সিটি করপোরেশনের পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। একই সঙ্গে সংস্কারকাজ যেন দায়সারাভাবে না হয়, সেদিকে সিটি করপোরেশনকে খেয়াল রাখতে হবে।