বঙ্গবন্ধুর অবিকৃত ভাস্কর্য বানাতে চান ভাস্কর অভিজিৎ
ঢাকার কেরানীগঞ্জের ওয়াশপুর গার্ডেন সিটিতে তিন কক্ষের একটি বাসায় থাকেন ভাস্কর অভিজিৎ কান্তি দাশ। বাসাজুড়ে ভাস্কর্য রাখা। কোনো ভাস্কর্য বানানো শেষ করেছেন, কোনোটি ফ্রেমে বসিয়েছেন। ভাস্কর্য নির্মাণের প্রক্রিয়া হিসেবে কোনো ভাস্কর্য পলিথিন দিয়ে মুড়িয়ে রাখা হয়েছে। কোনোটিতে পানি ছিটাতে হচ্ছে। চলতে ফিরতে হঠাৎই মনে হলে অভিজিৎ কোনো ভাস্কর্যের চোখ ঠিক করছেন বা কোনোটির মাথার চুলে আঁচড় দিচ্ছেন।
ভাস্কর্যগুলোর বেশির ভাগই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের। অভিজিৎ বললেন, তিনি এ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর প্রায় ৩০টি ভাস্কর্য তৈরি করেছেন। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি এবং বিভিন্ন ব্যাংকের মুজিব কর্নারে অভিজিৎ কান্তি দাশের তৈরি বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়েছে। কুষ্টিয়ার খোকসা উপজেলা পরিষদের সামনের দেয়ালে বানানো বাংলাদেশের মানচিত্রের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যটিও তাঁরই তৈরি।
আমি কোনো রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নই। বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য বানিয়ে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারকে খুশি করতেও চাইনি কখনো। আমি ফরমায়েশি কিছু কাজ করি, আর বেশির ভাগ কাজই করি নিজের ভালো লাগা থেকে। ইচ্ছে আছে ভবিষ্যতে নিজের একটি বড় স্টুডিও হবে। আর বঙ্গবন্ধু, বঙ্গবন্ধুর পরিবার এবং বঙ্গবন্ধুর জীবনের সঙ্গে যাঁরা জড়িত ছিলেন তাঁদের ভাস্কর্য দিয়ে একক প্রদর্শনীর আয়োজন করা
অভিজিতের মতে, কারও ভাস্কর্য বানালে তা খেয়ালখুশি মতো না বানানোই ভালো। যে ব্যক্তির ভাস্কর্য তাঁকে ভালোভাবে বুঝতে হবে। এই ভাস্কর বলেন, ভাস্কর্য তৈরির জন্য কোনো নির্দেশনা নেই। ভাস্কর্যে ভুলত্রুটি হলে তা দেখভালের কেউ নেই। কার ভাস্কর্য তা লিখে না দিলে বোঝার উপায় থাকে না এটি কার ভাস্কর্য।
বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের সংখ্যার বিষয়ে অভিজিৎ বললেন, ‘আমি ব্যক্তি বঙ্গবন্ধুকে পছন্দ করি। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলায় ভাস্কর্য বিভাগে পড়াশোনা করেছি। পড়াশোনা করার সময় ২০১৮ সালে প্রথম বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য বানাই। সারা দেশে বঙ্গবন্ধুর অনেক ভাস্কর্য চোখে পড়ে। কিন্তু কোনো কোনো ভাস্কর্যের বিকৃতি দেখলে খুব দুঃখ লাগে। আমি বঙ্গবন্ধুর সঠিক ও আদর্শ ভাস্কর্য বানাতে চাই। বিষয়টিকে স্টাডি হিসেবে নিয়েছি।’
অভিজিৎ কান্তি দাশ তাঁর নামের ইংরেজি বানানের আদ্যক্ষরগুলো দিয়ে বাসায় ছোট স্টুডিওটির নাম দিয়েছেন একেডি স্টুডিও। বাসায় নিজের ঘুমানোর জন্য একটি বিছানা, একটি বইয়ের শেলফ আর একটি কম্পিউটার টেবিল ছাড়া বলতে গেলে আর কোনো আসবাব নেই। সব জায়গায় ভাস্কর্য বানানোর সরঞ্জাম। এ ভাস্কর যে কাজগুলো করেন, তার ছবি দেন ফেসবুকে। তা দেখেই অনেকে অনেক কাজের ফরমাশ দেন। ভাস্কর্য বানানো নেশা হলেও এখন এটিকে পেশা হিসেবে নিয়েছেন।
অভিজিৎ কান্তি দাশের বাসায় নিজের ঘুমানোর জন্য একটি বিছানা, একটি বইয়ের শেলফ আর একটি কম্পিউটার টেবিল ছাড়া বলতে গেলে আর কোনো আসবাব নেই। সব জায়গায় ভাস্কর্য বানানোর সরঞ্জাম। ফ্যানের বাতাসে ভাস্কর্য শুকিয়ে ফেটে যাবে বলে দুই রুমে সিলিং ফ্যান লাগাননি। গরমে ঘামতে ঘামতে কাজ করছিলেন।
অভিজিৎ বলেন, ‘আমি কোনো রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নই। বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য বানিয়ে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারকে খুশি করতেও চাইনি কখনো। আমি ফরমায়েশি কিছু কাজ করি, আর বেশির ভাগ কাজই করি নিজের ভালো লাগা থেকে। ইচ্ছে আছে ভবিষ্যতে নিজের একটি বড় স্টুডিও হবে। আর বঙ্গবন্ধু, বঙ্গবন্ধুর পরিবার এবং বঙ্গবন্ধুর জীবনের সঙ্গে যাঁরা জড়িত ছিলেন, তাঁদের ভাস্কর্য দিয়ে একক প্রদর্শনীর আয়োজন করা।’
বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য বানিয়ে সন্তুষ্ট কি না বা আদর্শ প্রতিকৃতি বানাতে পেরেছেন কি না, এমন প্রশ্নের উত্তরে অভিজিৎ বললেন, ‘এখন পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য বানিয়ে নিজে সন্তুষ্ট হতে পারিনি। মনমতো হয়নি বলে অনেক কাজ শেষ না করে ফেলে রেখেছি। তবে আমি চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। একদিন না একদিন বঙ্গবন্ধুর অবিকৃত ভাস্কর্য বা প্রতিকৃতি বানাতে পারব সে আশাতে আছি।’
অভিজিৎ কান্তি দাশ মনে করেন, বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য বানাতে বানাতে তিনি বঙ্গবন্ধুকে জানতে পারছেন। তাঁর মতে, বঙ্গবন্ধুর ভালো রেজল্যুশনের ছবি অনেক সময় পাওয়া যায় না। তাই অনেক সময় ইচ্ছে থাকলেও ভালো ভাস্কর্য বানানো কঠিন হয়ে পড়ে।
ফ্যানের বাতাসে ভাস্কর্য শুকিয়ে ফেটে যাবে বলে অভিজিৎ তাঁর কেরানীগঞ্জের বাসার দুই কক্ষে সিলিং ফ্যান লাগাননি। গরমে ঘামতে ঘামতে কাজ করছিলেন। বললেন, শিল্পীর আরামের জীবন বলতে কিছু নেই। দেশে বর্তমানে শিল্পের কদরও নেই। বঙ্গবন্ধু থেকে শুরু করে বিভিন্ন ভাস্কর্য বানানোর দায়িত্ব পাচ্ছে ঠিকাদারেরা, তাঁরা আবার তাঁদের পছন্দের কাউকে কাজ দিচ্ছেন। শিল্পীদের অনেকেই পেটের দায়ে দ্রুত কাজ শেষ করতে চান।
অভিজিৎ কান্তি দাশের বাড়ি চট্টগ্রামে। এ ভাস্কর বলেন, ছোট বেলায় পূজার সময় যাঁরা প্রতিমা বানাতেন তাঁদের বাড়ি থেকে মাটি চুরি করে আনতেন। তা দিয়ে অনেক কিছু বানাতেন। একবার একটি গণেশের মূর্তি বানিয়েছিলেন। প্রতিমা বানান এমন এক কাকা তা দেখে খুব প্রশংসা করেছিলেন। এ ছাড়া অভিজিৎ এবং তাঁর দুই ভাই পড়াশোনা আর খেলাধুলার পাশাপাশি ছবি আঁকতেন। সেসব ছবি বাবা বিবরণ কান্তি দাশ, মা দুলালী রানী দাশ দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখতেন। বাড়িতে কোনো মেহমান এলে তাঁরা অভিজিৎ কান্তি দাশের ছবির একটু বেশি প্রশংসা করতেন। সব মিলে চারুকলায় পড়ার প্রতি আগ্রহটা বাড়তে থাকে। এ ছাড়া এইচএসসিতে পড়ার সময় তিনি চট্টগ্রামের রামকৃষ্ণ মিশনের ছাত্রাবাসে ছিলেন। যে রুমে তিনি থাকতেন সেখানে পেনসিলে স্কেচ করা বিভিন্ন ছবি টানিয়ে রাখতেন। তা দেখেও অনেকে উৎসাহ দেন। এ ছাত্রাবাসে থাকা অবস্থায় এক চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতায় প্রথমও হয়েছিলেন।
পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ভাস্কর্য বিভাগে পড়াশোনা করেন অভিজিৎ। তিনি সিরাজগঞ্জে বেসমেন্টসহ ৪০ ফিটের মুক্তির সংগ্রাম নামে একটি ভাস্কর্য বানিয়েছেন। অভিজিৎ মনে করেন, এটি এখন পর্যন্ত তাঁর সব থেকে বড় কাজ। এ ছাড়া ঢাকায় গোয়েন্দা সংস্থার সদর দপ্তরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছয় ফিটের ভাস্কর্যটি প্রশংসিত হয়েছে। ২০২০ সালে জাতীয় শোক দিবস উদ্যাপন পরিষদের আয়োজনে পেয়েছেন শেখ কামাল পুরস্কার।
দেড় মাস আগে অভিজিৎ দিনাজপুরের মেয়ে মুনমুন ঝাঁকে বিয়ে করেছেন। তিনিও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের ভাস্কর্য বিভাগ থেকে পড়াশোনা শেষ করেছেন। বর্তমানে ঠাকুরগাঁও বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে চারুকলা বিষয়ে শিক্ষকতা করছেন।
অভিজিৎ মনে করেন, শিল্পের মূল্যায়ন হলে, শিল্পীর কদর বাড়লে এবং শিল্পী একেকটি শিল্পকর্মের জন্য পর্যাপ্ত সময় দিতে পারলে শিল্প বিশেষ করে ভাস্কর্যের বিকৃতি রোধ করা সম্ভব হবে।