ঢাকায় স্কুলে ভর্তির জন্য শিশুর জন্মসনদ পেতে হিমশিম খাচ্ছেন অভিভাবকেরা

জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধনপ্রতীকী ছবি

মহুয়া সুলতানার বাসা রাজধানীর মিরপুর–১০ নম্বর এলাকায়। তাঁর তিন সন্তান। ছোট দুজন যমজ। বয়স ৪ বছর। নতুন বছরের শুরুতেই সন্তানদের বিদ্যালয়ে ভর্তি করাবেন। তাই দরকার সন্তানদের জন্মসনদ।

নিবন্ধনের জন্য গত সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকে দৌড়ঝাঁপ করছেন মহুয়া। গত ২৭ অক্টোবর এই নারীর সঙ্গে কথা হয় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) আওতাধীন মিরপুর–১৪ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর কার্যালয়ে। প্রায় এক মাস পার হলেও সনদ হাতে পাননি তিনি।

পরদিন অর্থাৎ ২৮ অক্টোবর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) আঞ্চলিক কার্যালয়-২-এ গিয়ে বেশ ভিড় দেখা গেল। অনেক অভিভাবক সন্তানের জন্মসনদ করাতে এসেছেন। একই উদ্দেশ্যে মুগদা থেকে এসেছিলেন বেসরকারি চাকরিজীবী হৃদয় আহমেদ। সন্তানকে বিদ্যালয়ে ভর্তি করাতে জন্মসনদ লাগবে। কিন্তু তাঁকেও ঘুরতে হচ্ছে।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় অক্টোবর থেকেই নতুন শিক্ষাবর্ষে ভর্তির তোড়জোড় শুরু হয়ে যায়। অনেক বিদ্যালয়ে নভেম্বর বা ডিসেম্বরের মধ্যে ভর্তির প্রক্রিয়া শেষ হয়। জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ অনুযায়ী, বিদ্যালয়ে ভর্তির সময় শিশুর বয়স শনাক্ত করতে আবেদন ফরমের সঙ্গে জমা দিতে হয় জন্মসনদের ফটোকপি। এ কারণে বিদ্যালয়ে ভর্তি ঘিরে প্রতিবছরই সেপ্টেম্বর বা তার আগে থেকেই শিশুর জন্মসনদ সংগ্রহে অভিভাবকদের তোড়জোড় শুরু হয়ে যায়।

সন্তানের জন্মনিবন্ধন করানোর জন্য আগে নিজের জন্মসনদ সংশোধন করতে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে যেতে বলা হয়েছে। আমাকে নিজে গিয়ে শুনানি করতে হবে কেন? জাতীয় পরিচয়পত্রেই তো সব তথ্য দেওয়া আছে।
-শাহিদ হাসান, অভিভাবক।

তবে এবার পরিস্থিতি কিছুটা ভিন্ন। শিক্ষার্থীদের সরকারবিরোধী আন্দোলনের জেরে জুলাইয়ে দেশজুড়ে জন্মনিবন্ধনের প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়েছে। আন্দোলনের সময় ১৮ থেকে ২৩ জুলাই টানা পাঁচ দিন মোবাইল ও ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট–সংযোগ বন্ধ ছিল। মোবাইল ইন্টারনেট–সংযোগ বন্ধ ছিল প্রায় ১০ দিন। গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বিভিন্ন ওয়ার্ড কাউন্সিলর, ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) চেয়ারম্যানরা আত্মগোপন করেন। কার্যালয়গুলোয় ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও হামলা করা হয়। সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলরদের অপসারণ করা হয়। এসব কারণে আগস্ট ও সেপ্টেম্বরের বড় অংশজুড়ে অনেক জায়গায় জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধনের কাজ বন্ধ থাকে। সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে এসে জন্মনিবন্ধনের আবেদন বাড়তে থাকে।

‘রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়, জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন’-এর তথ্য অনুযায়ী, এ বছরের ৬ আগস্ট পর্যন্ত সারা দেশে জন্মনিবন্ধনের আবেদনের সংখ্যা ছিল মাত্র ৩ হাজার ৩৯৮। গত ৩০ সেপ্টেম্বর তা লাফিয়ে বেড়ে দাঁড়ায় ৪৪ হাজার ২৬১টিতে। সবশেষ ১০ নভেম্বর জন্মনিবন্ধনের আবেদনের সংখ্যা ছিল ৩৮ হাজার ৫৫। জন্মনিবন্ধন হয়েছে ৩৩ হাজার ৯১৮টি।

সব তথ্য ঠিকঠাক থাকলে জন্মনিবন্ধন আসলে খুবই সহজ বিষয়। সময় ও শ্রম বেশি লাগে না। তবে সনদের তথ্য সংশোধন করতে গেলে কিছুটা সময় লাগে।
-শাহ আলম কবির, মিরপুরের কাফরুলের ১৬ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর কার্যালয়ের সচিব।

শিশুদের বিদ্যালয়ে ভর্তির সময় যত এগিয়ে আসছে, ততই ভিড় বাড়ছে নিবন্ধক কার্যালয়গুলোয়। ডিএনসিসির পুরোনো ওয়ার্ড ১ থেকে ৩৬ নম্বর পর্যন্ত ওয়ার্ড কাউন্সিলরের কার্যালয় ও নতুন ওয়ার্ড ৩৭ থেকে ৫৪ পর্যন্ত ডিএনসিসির ১০টি আঞ্চলিক কার্যালয় এবং ডিএসসিসির ১০টি আঞ্চলিক কার্যালয়কে জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধনের নিবন্ধক কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার করা হয়।

ডিএসসিসির অঞ্চল-২-এর আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা রেজাউল করিম প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিবছর বিদ্যালয়ে ভর্তির মৌসুমের শুরু থেকেই অর্থাৎ সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে জন্মসনদ সংগ্রহের চাহিদা বেড়ে যায়। ফলে এ সময়ে কাজের চাপও বাড়ে। প্রয়োজনে অতিরিক্ত জনবল দিয়ে হলেও বাড়তি চাপ সামলাতে হয়।

বাড়তি সময় নিয়ে দুশ্চিন্তা

যমজ সন্তানের মা মহুয়া সুলতানা জানিয়েছিলেন জন্মসনদের জন্য সেপ্টেম্বর থেকে ছুটছেন। এত দেরি কেন হচ্ছে জানতে চাইলে মহুয়া বলেন, পাঁচ বছর আগে প্রথম সন্তানের (এখন বয়স ৮ বছর) জন্মনিবন্ধন করার সময় মা-বাবার জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়েই করা গিয়েছিল। এখন মা-বাবার জন্মসনদ লাগছে। তাঁর নিজের ও স্বামীর জন্মসনদ নেই। তাই আগে তাঁদের স্বামী-স্ত্রীর জন্মসনদ করাতে হবে। এরপর সন্তানদের।

২০২১ সালের ১ জানুয়ারি থেকে করা সরকারি নিয়ম অনুযায়ী, ২০০১ সালের পর জন্ম নেওয়া ব্যক্তিদের জন্মনিবন্ধন করাতে হলে মা-বাবার জন্মসনদ থাকা আবশ্যিক।

মহুয়া জানালেন, তিনি ও তাঁর স্বামী সপ্তাহ তিনেক আগে (২৭ অক্টোবর পর্যন্ত) জন্মনিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছেন। এখনো সনদ হাতে পাননি। তাই সময়মতো সন্তানদের জন্মসনদ পাওয়া না–পাওয়া নিয়ে তিনি দুশ্চিন্তায় ভুগছেন।

২০২১ সালের ১ জানুয়ারি থেকে করা সরকারি নিয়ম অনুযায়ী, ২০০১ সালের পর জন্ম নেওয়া ব্যক্তিদের জন্মনিবন্ধন করাতে হলে মা-বাবার জন্মসনদ থাকা আবশ্যিক।

জাতিসংঘ শিশু অধিকার কনভেনশনের অনুচ্ছেদ ৭ অনুযায়ী, জন্মনিবন্ধন করতে হবে শিশুর জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই। আর রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়ের এক নির্দেশিকায় শিশুর জন্মের ৪৫ দিনের মধ্যে জন্মনিবন্ধনের ব্যাপারে তাগিদ দেওয়া হয়েছে।

১১ বছর বয়সের ছেলের জন্মসনদ পেতে ডিএসসিসির আঞ্চলিক-২ কার্যালয়ে এসেছিলেন জুলেখা বেগম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর নিজের ও স্বামীর জন্মসনদ ও জাতীয় পরিচয়পত্রে থাকা নামে কিছুটা তারতম্য আছে। ছেলের জন্মসনদের জন্য ঢাকার জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে জাতীয় পরিচয়পত্রের সঙ্গে মিল রেখে তাঁরা নিজেদের জন্মসনদ সংশোধনের আবেদন করেন। সেখানে শুনানি শেষে সনদ হাতে পাওয়ার পর ছেলের নতুন নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেন। সব মিলিয়ে এক বছর সময় লেগে গেছে।

জুলেখা বেগম বলেন, ‘এই একটা বছর অনেক কষ্ট হইছে। আল্লাহ এত দিন পরে মুখ তুইলা চাইছে।’

প্রক্রিয়া নিয়ে ক্ষোভ

পেশায় স্থপতি শাহিদ হাসানের সঙ্গে কথা হয় রাজধানীর কাফরুলে অবস্থিত ১৬ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলরের কার্যালয়ে। নিজের ভুলে ভরা বাংলা জন্মসনদ ঠিক করাতে এসেছিলেন। ক্ষোভের সঙ্গেই বললেন, ‘সন্তানের জন্মনিবন্ধন করানোর জন্য আগে নিজের জন্মসনদ সংশোধন করতে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে যেতে বলা হয়েছে। আমাকে নিজে গিয়ে শুনানি করতে হবে কেন? জাতীয় পরিচয়পত্রেই তো সব তথ্য দেওয়া আছে।’ তাঁর মতে, ওয়ার্ড কাউন্সিলরের কার্যালয়ে প্রয়োজনীয় কাগজ জমা দিলেই এই কাজ হওয়া উচিত।

বাড়তি ব্যয়ের অভিযোগ

ডিএনসিসির ১৯ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর কার্যালয় রাজধানীর বনানীর ১২ নম্বর সড়কে। কার্যালয়ের বাইরে পাঁচ বছরের ছেলেকে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন এক নারী। নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে তিনি বলেন, সন্তানের জন্মনিবন্ধন করতে এসে জানতে পারেন আগে সন্তানের বাবার নামের ভুল সংশোধন করতে হবে। জন্মসনদ সংশোধনের ফি ১০০ টাকা। কিন্তু তাঁর কাছ থেকে ৫০০ টাকা নিয়েছেন ওই কার্যালয়ের এক কর্মী।

ওই কার্যালয়ের এক কর্মীকে ‘জন্মনিবন্ধন করতে চাই’ বলতেই একটি সরু কাগজ ধরিয়ে দিলেন। কাগজে বনানী সুপার মার্কেটের একটি স্টেশনারি দোকানের ঠিকানা লেখা। ঠিকানায় গিয়ে রজনু রহমান নামের এক ব্যক্তির সঙ্গে দেখা হলো। তিনি বললেন, আবেদনকারীদের হয়ে তাঁরা কাজ করে দেন। প্রয়োজনে সংশোধনের জন্য সদরঘাটে ঢাকা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে গিয়েও কাজ করেন। জন্মসনদ তুলে দেওয়া পর্যন্ত তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকা নেন।

জাতিসংঘ শিশু অধিকার কনভেনশনের অনুচ্ছেদ ৭ অনুযায়ী, জন্মনিবন্ধন করতে হবে শিশুর জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই। আর রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়ের এক নির্দেশিকায় শিশুর জন্মের ৪৫ দিনের মধ্যে জন্মনিবন্ধনের ব্যাপারে তাগিদ দেওয়া হয়েছে। এ সময়ের মধ্যে বিনা মূল্যে নিবন্ধন করা যাবে। ৪৬ দিন থেকে ৫ বছর বয়স পর্যন্ত এ খরচ ২৫ টাকা। আর বয়স পাঁচ বছরের বেশি হলে খরচ ৫০ টাকা।

সামগ্রিক বিষয় নিয়ে মিরপুরের কাফরুলের ডিএনসিসির ১৬ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর কার্যালয়ের সচিব শাহ আলম কবির বলেন, সব তথ্য ঠিকঠাক থাকলে জন্মনিবন্ধন আসলে খুবই সহজ বিষয়। সময় ও শ্রম বেশি লাগে না। তবে সনদের তথ্য সংশোধন করতে গেলে কিছুটা সময় লাগে।