কোটা সংস্কার আন্দোলন: বাসাও নিরাপদ নয়, গুলিতে মৃত্যু ছয় নারী ও মেয়েশিশুর

নিহতদের মধ্যে ছয়জন নারী, কিশোরী ও মেয়েশিশু। গুলিবিদ্ধ হন ১৮-২০ জুলাইয়ের মধ্যে। হাহাকার, আক্ষেপে দিন কাটে পরিবারগুলোর।

মা মায়া ইসলাম (৬০) গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন। ছেলে বাসিত খান মুসা (৭) মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন। মাকে হারিয়ে, ছেলের দুশ্চিন্তায় এখন হাসপাতালেই দিন কাটে মুস্তাফিজুর রহমানের (২৯)।

সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলন চলার সময় গত ১৯ জুলাই (শুক্রবার) ঢাকার রামপুরার বাসার নিচে সিঁড়ির কাছে গুলিবিদ্ধ হন মুস্তাফিজুরের মা ও ছেলে। তিনি গত রোববার প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলার সময় প্রশ্ন করছিলেন, বাসায়ও কেন মানুষ নিরাপদ থাকতে পারল না?

মায়া ইসলামের মতো নিজের বাসায় নিরাপদ থাকতে পারেননি সদ্য মা হওয়া সুমাইয়া আক্তার (২০), কিশোরী নাঈমা সুলতানা (১৫), শিশু রিয়া গোপ (৬), তরুণী নাছিমা আক্তার (২৪) ও গৃহকর্মী মোসাম্মৎ লিজা আক্তার (১৯)।

কোটা সংস্কার আন্দোলন এবং পরবর্তী সংঘাত-সহিংসতায় অন্তত ৫৮০ জন মানুষের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। এর মধ্যে অন্তত ছয়জন নারী, কিশোরী ও মেয়েশিশু। তাঁদের সবার মৃত্যু হয়েছে ১৮, ১৯ ও ২০ জুলাই গুলি লেগে। এই আন্দোলন দমনে পুলিশ, র‍্যাব ও বাংলাদেশ বর্ডার গার্ডের (বিজিবি) বিরুদ্ধে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করে ব্যাপক গুলিবর্ষণের অভিযোগ রয়েছে।

নিহত ছয়জন নারী, কিশোরী ও মেয়েশিশুর মধ্যে তিনজনের মাথায়, দুজনের পেটে ও একজনের গলায় গুলি লেগেছিল। সুমাইয়া, নাঈমা ও লিজা বাসার বারান্দায় গুলিবিদ্ধ হন। রিয়া ও নাছিমা গুলিবিদ্ধ হন ছাদে থাকা অবস্থায়। মায়া ইসলাম গুলিবিদ্ধ হন বাসার নিচতলায় ‘কলাপসিবল গেটে’র ভেতরে থাকা অবস্থায়।

৫ আগস্ট শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন। জুলাই মাসেই ঢাকায় মানুষ নিহত হওয়ার ঘটনায় মামলা করা শুরু করে পুলিশ। ওই সব মামলায় বলা হচ্ছিল, সন্ত্রাসীদের ছোড়া এলোপাতাড়ি গুলিতে মৃত্যুগুলো হয়েছে।

অবশ্য ৮ আগস্ট গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন গত রোববার সাংবাদিকদের বলেছেন, পুলিশকে প্রাণঘাতী অস্ত্র দেওয়া ঠিক হয়নি। যারা পুলিশকে লাঠিয়াল বাহিনীর মতো ব্যবহার করেছে, তাদের আইনের আওতায় আনা হবে।

নাতির জন্য আইসক্রিম কিনতে যাচ্ছিলেন মায়া

মায়া ইসলামের ছেলে মুস্তাফিজুর প্রথম আলোকে জানান, তাঁর বাসা রাজধানীর রামপুরা থানার সামনে মেরাদিয়া হাট এলাকায়। সাততলা বাড়ির ছয়তলার একটি ফ্ল্যাটে ভাড়া থাকেন তিনি। সেখানে তাঁর বাবা, স্ত্রী ও সন্তানের সঙ্গে মা মায়া ইসলাম থাকতেন। মালিবাগ বাজারে একটি ইলেকট্রনিক পণ্যের দোকান রয়েছে তাঁর।

মায়া ইসলামের দুই ছেলেমেয়ের মধ্যে মুস্তাফিজুর ছোট। তিনি বলেন, ১৯ জুলাই বাইরে বিক্ষোভ পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হলে বেলা তিনটার দিকে তাঁর মা নাতি বাসিতকে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামেন। উদ্দেশ্য ছিল আইসক্রিম কেনা। নিচে নেমে দেখেন বাসার কলাপসিবল গেট ও প্রধান দরজা বন্ধ। তখনই গুলি এসে সামনে থাকা বাসিতকে প্রথম আঘাত করে। গুলি বাসিতের মাথার বাঁ দিক দিয়ে ঢুকে অপর পাশ দিয়ে বেরিয়ে যায়। তারপর তাঁর মায়ের তলপেট দিয়ে ঢুকে পেছনের দেয়ালে লাগে।

গুলিবিদ্ধ মায়া ইসলামকে স্থানীয় একটি হাসপাতালে নেওয়া হয়েছিল। সেখানে চিকিৎসা শেষে তাঁরা যান এক স্বজনের বাসায়। পরদিন ২০ জুলাই সকালে মায়া ইসলামের শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে তাঁকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। মুস্তাফিজুর জানান, তাঁর মায়ের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত হতে সরকারি কোনো একটি সংস্থা ফোন করেছিল। আর তাঁর ছেলের আইসিইউর বিল দিতে হচ্ছে না। তবে ওষুধ কেনা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার খরচ তিনিই বহন করেন।

মুস্তাফিজুরের সঙ্গে গত রোববার যখন কথা হয়, তখন তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ছিলেন। সঙ্গে তাঁর স্ত্রী নিশামনি। মুস্তাফিজুর বলেন, তাঁর মা মায়া ইসলামের কাছেই ছেলে বাসিত বড় হয়েছে। পরিবারের সবকিছু তাঁর মা-ই সামলাতেন। মাকে হারিয়েছেন, ছেলে চোখই খুলছে না।

নাঈমার ছোট ভাই চিৎকার করে ওঠে

আর পাঁচ দিন পরই ১৫ বছরে পা দিত দশম শ্রেণির ছাত্রী নাঈমা সুলতানা। গত ১৯ জুলাই বিকেল পাঁচটার দিকে উত্তরার বাসার বারান্দায় শুকাতে দেওয়া কাপড় আনতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায় সে।

চাঁদপুরের মতলব উত্তর উপজেলার হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক গোলাম মোস্তফা ও আইনুন নাহার দম্পতির দুই মেয়ে ও এক ছেলের মধ্যে নাঈমা ছিল দ্বিতীয়। সে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ছাত্রী ছিল। তার দাফন হয় গ্রামের বাড়িতে।

নাঈমার মা আইনুন নাহার গত রোববার প্রথম আলোকে বলেন, ‘সন্তানদের ভালো পড়াশোনা করাতে ওদের বাবা ওদের ঢাকার স্কুল-কলেজে ভর্তি করিয়ে দেন। উত্তরায় ভাড়া বাসায় আমি ওদের সঙ্গে থাকতাম। ওর বাবা গ্রামেই থাকেন। অথচ ঢাকায় এসে বাসায় সন্তানকে হারাতে হলো।’

উত্তরার ৯ নম্বর সেক্টরের পাঁচতলা একটি ভবনের চারতলায় থাকেন আইনুন নাহার। তিনি জানান, ঘটনার দিন তিনি ফ্ল্যাটের সব দরজা-জানালা বন্ধ রেখেছিলেন। বিকেলে ছবি আঁকছিল নাঈমা। মাকে বলেছিল সে পিৎজা বানাবে। একপর্যায়ে ‘বারান্দা থেকে কাপড় নিয়ে আসি’ বলে নাঈমা বারান্দার দিকে যায়। তিনিও পেছন পেছন যান। বারান্দার দরজা খোলামাত্র গুলি এসে নাঈমার মাথায় ঢুকে যায়।

আইনুন নাহার বলেন, ‘নিজের বাসায় এভাবে অনিরাপদ হয়ে পড়ব, ভাবিনি। সবকিছুতে এখন আমাদের ভয় ঢুকে গেছে। এত রক্ত দেখে ছোট ছেলে (৮ বছর বয়সী আবদুর রহমান) অসুস্থ হয়ে পড়েছে। ঘুম থেকে চিৎকার করে ওঠে। বলে, “মা গুলি আসছে, গুলি”।’ তিনি বলেন, ‘নাঈমা চিকিৎসক হতে চেয়েছিল। সব স্বপ্ন শেষ হয়ে গেল।’

রিয়া ছাড়া শূন্য ঘর

১৯ জুলাই ছাদে খেলতে গিয়েছিল শিশু রিয়া গোপ (৬)। রাস্তায় সংঘর্ষ শুরু হলে বাবা দীপক কুমার গোপ মেয়েকে বাসায় আনতে ছাদে যান। রিয়াকে কোলে তুলে নিতেই একটি বুলেট এসে বিদ্ধ হয় তার মাথায়। এরপর পাঁচ দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউতে মারা যায় সে।

দীপক কুমার ও বিউটি ঘোষ দম্পতির একমাত্র সন্তান ছিল রিয়া। নারায়ণগঞ্জ সদরের নয়ামাটি এলাকায় একটি চারতলা বাড়ির চারতলায় বাস পরিবারটির। দীপক কুমার নারায়ণগঞ্জের একটি রড-সিমেন্টের দোকানের ব্যবস্থাপক। রিয়া এ বছর স্কুলে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছিল।

দীপক কুমার বলেন, তাঁর এখন আর কিছু ভালো লাগে না। কথা বলতেও ইচ্ছা করে না। রিয়ার মা বিউটি ঘোষ মানসিকভাবে আরও ভেঙে পড়েছেন। সন্তানের জন্য সারাক্ষণ কান্নাকাটি করেন। ঠিকভাবে খাওয়াদাওয়া করেন না। ঘুমান না।

দুই ভাতিজাকে নিয়ে ছাদে গিয়েছিলেন নাছিমা

দুই ভাতিজাকে নিয়ে গত ১৯ জুলাই ছাদে গিয়েছিলেন নাছিমা আক্তার (২৪)। সেখানে গুলিবিদ্ধ হয়ে তিনি পরদিন রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। গুলিবিদ্ধ হন তাঁর ভাতিজা আয়মান উদ্দিন (২০)।

নাছিমার ভাবি রেহানা আক্তার গত রোববার ওই দিনের কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন। তিনি বলেন, গুলি তাঁর ছেলের বুকের এক পাশ দিয়ে ঢুকে বেরিয়ে পেছনে থাকা নাছিমার গালের ভেতর দিয়ে গলার খাদ্যনালিতে ঢুকে যায়।

রেহানার স্বামী হেলাল উদ্দিন স্পেনপ্রবাসী। তিনি তিন ছেলে ও ননদকে নিয়ে ধানমন্ডির ১ নম্বরে একটি নয়তলা ভবনে ভাড়া থাকেন। ঘটনার দুই সপ্তাহ আগে নাছিমা নোয়াখালী থেকে তাঁর বাসায় বেড়াতে এসেছিলেন। তাঁর ছেলে আয়মান ১৫ দিন চিকিৎসার পর ৫ আগস্ট বাসায় ফিরেছেন।

আয়মান প্রথম আলোকে বলেন, ছাদে তিনি, ছোট ভাই সালমান উদ্দিন, ফুপু নাছিমা এবং অন্য ফ্ল্যাটের আরও কয়েকজন ছিলেন। হঠাৎ করেই একটি গুলি এসে তাঁর বুকের এক পাশে বিদ্ধ হয়। নাছিমা গুলিবিদ্ধ হয়ে ছাদেই পড়ে যান।

ইউসুফ আলী ও সালেহা বেগমের চার মেয়ে ও তিন ছেলের মধ্যে নাছিমা ছিলেন ছোট। তাঁকে নোয়াখালী বেগমগঞ্জের রাজগঞ্জ ইউনিয়নের মনপুরা গ্রামের নানার বাড়িতে দাফন করা হয়।

চার দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়েছেন লিজা

রাজধানীর শান্তিনগরের একটি বাসার গৃহকর্মী ছিলেন মোসাম্মৎ লিজা আক্তার (১৯)। ১২ তলা ভবনের সাততলায় থাকতেন। ১৮ জুলাই বেলা তিনটার দিকে বারান্দায় এসে দাঁড়াতেই তাঁর পেটে গুলি লাগে।

লিজা যে পরিবারটির সঙ্গে থাকতেন, তাঁরা প্রথমে লিজাকে অরোরা স্পেশালাইজড হাসপাতালে ভর্তি করেন। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে পপুলার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। ২২ জুলাই হাসপাতালে লিজা মারা যান। পরদিন ভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলার সাঁচড়া ইউনিয়নের দেউলা গ্রামে পারিবারিক কবরস্থানে লিজাকে দাফন করা হয়।

লিজার গ্রামের বাড়িতে গিয়ে বড় বোন সালমা আক্তারের (২৮) সঙ্গে কথা বলেন প্রথম আলোর ভোলা প্রতিনিধি নেয়ামতউল্যাহ। সালমা বলেন, তাঁরা কারও কাছে বিচার চান না। বিচার চেয়ে কী হবে?

সুমাইয়াকে খোঁজে তাঁর সন্তান

২০ জুলাই সন্ধ্যা পৌনে ছয়টার দিকে সুমাইয়া আক্তার (২০) বাসার বারান্দায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। তাঁর আড়াই মাস বয়সী একটি শিশুসন্তান রয়েছে। তিনি পরিবারের সঙ্গে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের পাইনাদিতে একটি ভবনের ছয়তলায় বাস করতেন।

সুমাইয়ার মা আসমা বেগম গত রোববার প্রথম আলোকে বলেন, ঘটনার সময় বাইরে সংঘর্ষ চলছিল। র‍্যাবের হেলিকপ্টার আকাশে উড়ছিল। তিনি হেলিকপ্টার দেখতে বারান্দায় দাঁড়িয়েছিলেন। ওই সময় মেয়ে সুমাইয়া শিশুসন্তানকে ঘুম পাড়িয়ে তাঁর পাশে এসে দাঁড়ান। হঠাৎ করেই সুমাইয়া ঢলে পড়তে থাকেন।

আসমা বেগম বলেন, তিনি ভেবেছিলেন মেয়ে হয়তো ভয় পেয়েছে। সুমাইয়াকে জড়িয়ে ধরার পর দেখেন তাঁর মাথা থেকে গলগল করে রক্ত বের হচ্ছে। তাঁর মাথায় গুলি লেগেছে। ঘটনাস্থলেই তাঁর মৃত্যু হয়।

সুমাইয়ার স্বামী জাহিদ হোসেন কাঁচপুরে একটি পোশাক কারখানায় অপারেটর হিসেবে কাজ করেন। সুমাইয়া মায়ের কাছে গিয়েছিলেন সন্তান হওয়ার আগে। আসমা বেগম বলেন, সুমাইয়ার মেয়ে সোয়াইবা এখন তাঁর কাছেই আছে। সে মায়ের স্পর্শ খোঁজে, বুকের দুধ খোঁজে। ঘুমানোর সময় বুকের দুধের জন্য ছটফট করতে থাকে।

আসমা বেগমের প্রশ্ন, ‘মেয়ে হত্যার বিচার কার কাছে দেব?’