তদন্ত কমিটির সদস্যদের নাম বলবেন না ইডেন কলেজের অধ্যক্ষ
রাজধানীর ইডেন মহিলা কলেজে সম্প্রতি ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও অস্থিরতা চলাকালে ছাত্রীদের অনৈতিক কাজে বাধ্য করার যে অভিযোগ সামনে এসেছে, তার কোনো সত্যতা নেই বলে দাবি করেছেন কলেজের অধ্যক্ষ সুপ্রিয়া ভট্টাচার্য।
তিনি বলেছেন, ‘অভিযোগটির সত্যতা যাচাইয়ের জন্য আমরা কলেজের এক হাজার শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলেছি। কারও কাছ থেকে এ বিষয়ে সামান্যতম প্রমাণ বা সূত্র পাইনি।’ নারী আন্দোলনকর্মীদের পক্ষ থেকে ইডেন কলেজ ঘিরে সামনে আসা অভিযোগগুলোর বিচার বিভাগীয় তদন্তের যে দাবি উঠেছে, সে বিষয়ে অধ্যক্ষ বলেছেন, ‘এটি নিয়ে আমাদের মন্তব্য করার কিছু নেই।’
ছাত্রলীগের অন্তঃকোন্দলে গত ২৪ সেপ্টেম্বর রাত থেকে শুরু করে ২৫ সেপ্টেম্বর দিনভর উত্তপ্ত ছিল ইডেন কলেজ ক্যাম্পাস৷ ২৫ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় দুই পক্ষের সংঘর্ষে কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি তামান্না জেসমিন ওরফে রীভা, সাধারণ সম্পাদক রাজিয়া সুলতানাসহ অন্তত ১০ জন আহত হন৷
ক্যাম্পাসে বিশৃঙ্খলার ঘটনায় ২৫ সেপ্টেম্বর একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন অধ্যক্ষ সুপ্রিয়া ভট্টাচার্য৷ কলেজের ‘সাধারণ শিক্ষকদের’ মধ্য থেকে ৪ জনকে নিয়ে এই কমিটি গঠন করা হয়৷ যদিও শিক্ষকদের পরিচয় ও তদন্তের সুনির্দিষ্ট সময়সীমা তখন জানাতে চাননি অধ্যক্ষ৷ আজ মঙ্গলবার দুপুরে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘তদন্ত কমিটিতে কারা আছেন, এটা তো বলা যাবে না৷ তবে সাধারণ শিক্ষকদের মধ্য থেকে ৪ জনকে নিয়ে এই কমিটি করা হয়েছে৷ আশা করছি, দু-এক দিনের মধ্যে তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন পেয়ে যাব। এই প্রতিবেদন অনুযায়ী পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে৷’
‘অভিযোগের সত্যতা নেই’
বিশৃঙ্খলা ও সংঘর্ষের ঘটনায় ২৫ সেপ্টেম্বর রাতে ইডেন কলেজ শাখা কমিটি স্থগিত এবং সভাপতি তামান্না ও সাধারণ সম্পাদক রাজিয়ার বিরোধীপক্ষের ১২ নেত্রীসহ ১৬ নেতা-কর্মীকে স্থায়ী বহিষ্কার করে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ৷ বহিষ্কৃতদের মধ্যে ১২ জন পদধারী নেত্রী, অন্য ৪ কর্মীর বিষয়ে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি৷ অস্থিরতার ঘটনায় ইডেন কলেজ শাখা ছাত্রলীগের দুই পক্ষ পরস্পরের বিরুদ্ধে মামলা করেছে৷ লালবাগ থানা-পুলিশ মামলার তদন্ত করছে৷
ইডেন কলেজে দুই পক্ষের সংঘাত চলাকালে বহিষ্কৃত ছাত্রলীগ নেত্রী সামিয়া আক্তার ওরফে বৈশাখীসহ কয়েকজন অভিযোগ করেন, তামান্না ও রাজিয়া সাধারণ ছাত্রীদের অনৈতিক কাজে বাধ্য করেন৷ বোরকায় মুখ ঢাকা এক ছাত্রীর হাতে এই অভিযোগসংবলিত প্ল্যাকার্ডও দেখা যায়৷ বিষয়টি নিয়ে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক সমালোচনা শুরু হয়৷ পরে ২৭ সেপ্টেম্বর ইডেন কলেজ শাখা ছাত্রলীগের স্থগিত কমিটির সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের অনুসারীরা ‘অনৈতিক কাজে বাধ্য করার’ অভিযোগ তোলা ব্যক্তিদের শাস্তি দাবি করে কলেজের ফটকে মানববন্ধন করেন৷ এ সময় তাঁদেরও মুখ ঢাকা ছিল৷
আজ ইডেন কলেজের অধ্যক্ষ সুপ্রিয়া ভট্টাচার্য আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে প্রথম আলোকে বলেন, ‘ছাত্রীদের অনৈতিক কাজে বাধ্য করা হয় বলে যে অভিযোগ করা হচ্ছে, তার সত্যতা যাচাইয়ের জন্য আমরা র্যান্ডমলি এক হাজার শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলেছি৷ কারও কাছ থেকে আমরা ওই অভিযোগের বিষয়ে সামান্যতম প্রমাণ বা সূত্র পাইনি৷ এমনকি কলেজের কাউন্সেলিং সাইকোলজিস্টের সঙ্গেও আমরা কথা বলেছি৷ কারণ, ছাত্রীরা বিভিন্ন সময়ে তাঁর কাছে সরাসরি বা অনলাইনে তাঁদের নানা ব্যক্তিগত সমস্যা শেয়ার করে সমাধান চান৷ কাউন্সেলিং সাইকোলজিস্ট বলেছেন, তাঁর কাছেও কখনো কোনো ছাত্রী অনৈতিক কাজে বাধ্য করার বিষয়ে কিছু বলেননি৷ সে ক্ষেত্রে আমরা বলতে পারি, ছাত্রীদের অনৈতিক কাজে বাধ্য করার অভিযোগের কোনো সত্যতা কোথাও নেই৷’
ছাত্রলীগের এক পক্ষ আরেক পক্ষকে ঘায়েল করার জন্যই এ অভিযোগ তুলেছে বলে মন্তব্য করেন অধ্যক্ষ৷ ছাত্রীদের সম্ভ্রম নিয়ে যে নেতিবাচক আলোচনা চলছে, সে জন্য গণমাধ্যমসহ সবার ইতিবাচক ভূমিকা আশা করেন তিনি।
তদন্তের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন
ইডেন কলেজে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের অন্তঃকোন্দলে এক পক্ষ অন্য পক্ষের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ তুলেছে, সেগুলো নিয়ে আগে থেকেই কানাঘুষা ছিল। এসব অভিযোগের মধ্যে আছে কলেজের ছাত্রীনিবাসে আসন-বাণিজ্য, ছাত্রীদের অনৈতিক কাজে বাধ্য করা, চাঁদাবাজি ইত্যাদি৷ ছাত্রলীগের কোন্দলের আগেও সাধারণ ছাত্রীদের ভাষ্যে গণমাধ্যমে এসব অভিযোগ উঠে এসেছে৷ কিন্তু কোন্দলের সময় খোদ ছাত্রলীগ নেত্রীরাই এসবের একধরনের ‘সত্যতা’ নিশ্চিত করেন৷
ইডেন কলেজে ছাত্রলীগ নেত্রীদের বিতর্কিত কর্মকাণ্ডগুলোর বিষয়ে কর্তৃপক্ষ বরাবরই নীরব থেকেছে৷ বিভিন্ন সময় অভিযোগ এলেও কখনোই কারও বিরুদ্ধে তারা কোনো ব্যবস্থা নেয়নি৷ এ নিয়ে ২৪ আগস্ট প্রথম আলোর প্রথম পৃষ্ঠায় -ইডেনে ছাত্রলীগই ‘সব’, চোখ ‘বন্ধ’ থাকে কর্তৃপক্ষের—শিরোনামে বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়৷ তখন ইডেন কলেজ অধ্যক্ষ দাবি করেছিলেন, কলেজের ছাত্রীনিবাসে কর্তৃপক্ষই সিট দেয়, এখানে বাণিজ্যের কোনো বিষয় নেই৷
কর্তৃপক্ষ আগেও ছাত্রলীগের অন্যায় দেখে নীরব থেকেছে, তাই তাদের তদন্ত নিরপেক্ষ হবে না বলে মনে করেন ইডেন কলেজের সাধারণ ছাত্রীরা৷ হজরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) ছাত্রীনিবাসের এক ছাত্রী নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, কলেজ কর্তৃপক্ষ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত করতে পারবে বলে কোনো শিক্ষার্থীই মনে করেন না৷ তদন্তের নামে সময়ক্ষেপণ করে তাঁরা শুধু ইডেন কলেজ নিয়ে সর্বত্র চলমান আলোচনাটা বন্ধের অপেক্ষায় আছেন৷