সবুজ বৃক্ষরাজির নিবিড় সমারোহ চারপাশে। তার মাঝ দিয়ে এঁকেবেঁকে বয়ে গেছে নদী। পূর্ব তীরের কাছেই তৈরি করা হয়েছিল মসজিদটি। নদীর পাড় থেকে বেশ খানিকটা উঁচু করে মাটি ফেলে তার ওপর পাকা ভিত্তি স্থাপন করা হয়। সেখানে চার ফুট চওড়া দেয়াল দিয়ে নির্মাণ করা হয় অনিন্দ্যসুন্দর মসজিদটি।
বলা হচ্ছে, সাতগম্বুজ মসজিদের কথা। ঢাকার ইতিহাসের অনুসন্ধানী বিশেষজ্ঞরা সবাই এ কথাই বলেছেন যে বড়ই নয়নাভিরাম ছিল তখন পরিবেশ। মসজিদে সাদা রং করা হয়েছিল। ইতিহাসবিদ ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আহমদ হাসান দানী তার ‘কালের সাক্ষী ঢাকা’তে লিখেছেন, ‘বর্ষাকালে নৌকায় করে মসজিদের দিকে আসার সময় সবুজ ঝোপঝাড় ও জঙ্গলের পেছন দিকে সাদা প্লাস্টার করা মসজিদটিকে খুবই সুন্দর দেখায়।’
মসজিদটি ঠিক কত সালে নির্মিত হয়েছিল তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি কোনো শিলালিপি না পাওয়ায়। তবে স্থাপত্যশৈলী দেখে আহমদ হাসান দানীর অনুমান ১৬৮০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে এটি নির্মিত।
অন্য ইতিহাসবিদেরাও আহমদ হাসান দানীর মত গ্রহণ করেছেন। প্রচলিত আছে সুবাদার শায়েস্তা খান এই মসজিদটির নির্মাতা। ঢাকার ইতিহাস আলোকিত করা সুবাদার শায়েস্তা খান নিজেও অত্যন্ত উঁচুমানের স্থপতি ছিলেন। বেশ কিছু নান্দনিক স্থাপত্যে রাজধানী ঢাকাকে তিনি আভিজাত্য এনে দেন।
অনেকেই মসজিদটি দেখে থাকবেন। আর সরাসরি চোখের দেখা না হলেও ‘সাতগম্বুজ মসজিদ’ নামটির সঙ্গে পরিচিতি রয়েছে জনসাধারণের। জিগাতলার বিজিবির প্রধান ফটকের সামনে থেকে মোহাম্মদপুর বিআরটিসির বাস ডিপো পর্যন্ত সড়কটির নামকরণও হয়েছে একটু সংক্ষিপ্ত করে এই মসজিদের নামে, ‘সাতমসজিদ সড়ক’।
মসজিদের নাম থেকেই অনুমান করা চলে সাতটি গম্বুজ রয়েছে মসজিদে। মোগল আমলের স্থাপত্যের বড় বৈশিষ্ট্য হলো ছাদের গম্বুজ, মিনার ও বুরুজ। এই মসজিদের ছাদেও গম্বুজ আছে তিনটি। মাঝেরটি বেশ বড়। আর উভয় পাশের গম্বুজ দুটি মাঝেরটির চেয়ে একটু ছোট ও সমান আকারের। অন্য চারটি গম্বুজ আছে মসজিদের চার কোনায় মিনারের ওপর। এই মিনারগুলো অন্য মসজিদের মিনার বা বুরুজের চেয়ে বেশ আলাদা। অষ্টকোনাকৃতির মিনারগুলো দোতলা। মসজিদের মূল ভবনটি থেকে বাইরে দিকে প্রক্ষিপ্ত। ভেতরটা ফাঁপা। দেখতে ঘরের মতো। এখানেও নামাজ আদায় করা যায়। কিন্তু ওপরতলায় ওঠার ব্যবস্থা নেই। এই মিনারগুলোর ওপরে চারটি গম্বুজ। সব মিলিয়ে গম্বুজ হলো সাতটি। এর ফলে লোকে মসজিদটিকে বলেন ‘সাতগম্বুজ মসজিদ’।
সাতগম্বুজ মসজিদটি এখন প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর সংরক্ষিত প্রত্নসম্পদ। তবে নিয়মিত নামাজ আদায় হয়। আগের সাদা রং এখন নেই। বাইরে ইট-সুরকির মতো রং করা। আর বুড়িগঙ্গা নদীও এখন অনেক পশ্চিমে সরে গেছে।
‘বর্ষাকালে যখন সারা অঞ্চল ডুবে যায়, তখন দূর থেকে সাদা মসজিদটিকে একটি শ্বেত কবুতরের মতো দেখায়’ উল্লেখ করে পুরাতত্ত্ববিদ আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া তাঁর বাংলাদেশের প্রত্নসম্পদ বইতে যে বর্ণনা দিয়েছেন, এখন মসজিদের সেই শোভা আর নেই।
সময়ের সঙ্গে পরিবর্তন হয়েছে অনেক। নদী সরে গেছে, নিবিড় অরণ্যানী উজাড় করে চারপাশে গড়ে উঠেছে অগণিত বহুতল ভবন। পরিবেশের স্নিগ্ধতা না থাকা সত্ত্বেও সাতগম্বুজ মসজিদের সৌন্দর্য এখনো অনেকটাই অম্লান। মসজিদের সামনে, অর্থাৎ পূর্ব দিকে অনেকটা জায়গাজুড়ে সবুজ ঘাসে ঢাকা মাঠ। কিনার ও ভেতর দিয়ে কিছু শোভাবর্ধনকারী গাছগাছালিও আছে। এরপর কংক্রিট ঢালাই করা উন্মুক্ত চত্বর। এই অংশ পরে সম্প্রসারিত করা। এরপর একটা খিলান আকৃতির ফটক। সেখান দিয়ে মসজিদের মূল চত্বরে যেতে হয়। এখন তারাবিহর নামাজের জন্য এই অংশে ত্রিপলের ছাউনি তোলা হয়েছে। এরপরই মূল মসজিদ।
মসজিদটি বাইরের দিক থেকে ৫৮ ফুট লম্বা ও ২৭ ফুট চওড়া। সাতগম্বুজ মসজিদের ভেতরে বাইরের প্রতিটি দেয়াল এত চমৎকার নকশা করা, মসজিদ ও এর চারদিকের দোতলা ফাঁপা মিনারের গড়ন এমন যে লিখে তার সৌন্দর্য তুলে ধারার চেষ্টা করা অবান্তর। মসজিদের কার্নিশ ও গম্বুজে লতাপাতার কারুকাজ। মিনারগুলোর নিচে প্রবেশপথ ছাড়াও ওপরের তলায় আছে খিলান আকৃতির জানালা।
মূল মসজিদের ভেতরে পশ্চিমে দেয়ালে প্রধান মিহরাবটি খিলান আকৃতির। তার দুই পাশে দুটি ছোট মিহরাব। প্রতিটি মিহরাবের পাশে একটি করে ছোট কুলুঙ্গি। পূর্ব দিকের দেয়ালও মিহরাব বরাবর তিনটি প্রবেশপথ। মাঝেরটি বড়। এই দুই দেয়ালে আছে ৬টি করে ১২টি কুলুঙ্গি। উত্তর ও দক্ষিণের দেয়ালে একটি করে প্রবেশপথ। দুই পাশে খিলানে নকশা করা। এই নকশার ভেতরে একটি করে কুলুঙ্গি। প্রবেশপথ, মিহরাব, গম্বুজের অভ্যন্তর অংশে নানা রকমের জ্যামিতিক নকশা ফুটিয়ে তোলা। পুবের দেয়ালের বাইরের অংশ এবং পশ্চিমের দেয়ালের বাইরের অংশেও রয়েছে এমন অলংকরণ।
এই মসজিদের স্থাপত্যে আরেকটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য রয়েছে। পশ্চিম ও দক্ষিণ দিকে বারান্দার মতো বেশ খানিকটা জায়গা তৈরি করা। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, নদী ও প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্যই এই প্রশস্ত বারান্দা তৈরি করা হয়েছিল। মুসল্লিরা ইবাদত বন্দেগির পরে এখানে বসে নিসর্গের শোভা অবলোকন করতেন মুগ্ধ নয়নে।
মোগল আমলের পরে সাতগম্বুজ মসজিদের আশপাশের পরিবেশটা অন্য রকম হয়ে পড়েছিল। মুনশী রহমান আলী তায়েশ তাঁর ‘তাওয়ারিখে ঢাকা’ বইতে উল্লেখ করেছেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে পুরো ধানমন্ডি, জাফরাবাদ এলাকায় জনবসতি কমে গিয়ে জঙ্গলাকীর্ণ হয়ে পড়েছিল। সাতগম্বুজ মসজিদও পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে।
মুনতাসীর মামুন ‘স্মৃতি বিস্মৃতির ঢাকা’ বইতে উল্লেখ করেছেন ঢাকার নবাব আহসান উল্লাহ ঝোপজঙ্গল সাফ করে মসজিদটি সংস্কার করেন। তিনি একজন মুয়াজ্জিনও নিয়োগ দিয়েছিলেন। তখন থেকেই ঐতিহাসিক সাতগম্বুজ মসজিদে আবার ধ্বনিত হচ্ছে আজানের সুর।
বর্তমানে মোহাম্মদপুরের বাঁশবাড়ী এলাকায় পড়েছে সাতগম্বুজ মসজিদ। গত শুক্রবার জুমার পরে মসজিদে কথা হলো পরিচালনা কমিটির বর্তমান কোষাধ্যক্ষ মো. ওয়াহিদুজ্জামান বিশ্বাসের সঙ্গে। তিনি ৩০ বছর ধরে মসজিদ পরিচালনা কমিটিতে এই দায়িত্ব পালন করছেন। তাঁর কাছে জানা গেল পুরোনো মসজিদের ভেতরে তিন কাতারে ৮০-৯০ জন মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারেন। এ ছাড়া পুরোনো বারান্দা ও সম্প্রসারিত অংশ, উত্তর-দক্ষিণের পুরোনো বারান্দা, চারপাশের মিনারের নিচের তলা মিলিয়ে ১ হাজার থেকে ১২শ মুসল্লির নামাজ আদায়ের ব্যবস্থা করেছেন তাঁরা। মসজিদটি পরিচালনার যাবতীয় খরচ কমিটির ১৪ সদস্যের নিয়মিত মাসিক অনুদান ও মুসল্লিদের দানেই সম্পন্ন হয়ে থাকে। তবে তাঁরা কোনো সংস্কার বা পরিবর্তন-পরিবর্ধন করতে পারেন না। এটা প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের দায়িত্ব।
মসজিদের পুরো এলাকা লোহার গ্রিল দিয়ে ঘেরা। পুরোনো মসজিদের বাইরে সুরকির মতো রং থাকলেও ভেতরে সাদা রং করা। মেঝেতেও মার্বেল পাথরের মোজাইক। ওহাহিদুজ্জামান জানালেন, আগে মেঝেতে ইটের টালি বসানো ছিল। শত শত বছরের পুরোনো সেই টালি ভেঙে মেঝে এবড়োখেবড়ো হয়ে পড়েছিল। দেয়াল থেকেও সুরকির আস্তর ঝরে যাচ্ছিল। প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ মসজিদটির সংস্কারও করছিল না তাদের বাজেট না থাকায়। এদিকে আবার পরিচালনা কমিটিরও সংস্কারের এখতিয়ার নেই। খুবই অসুবিধায় পড়েছিলেন মুসল্লিরা। পরে ১৯৮৭-৮৮ সালের দিকে মেঝে ও ভেতরের দেয়াল সংস্কার করা হয়। বাইরে পশ্চিম দিকের বারান্দা অজুর জন্য একটি পুষ্করিণীও তৈরি করা হয়। তার পর থেকেই তারা মসজিদটির ভেতরের দেয়াল মলিন হয়ে পড়লে ঝেড়েমুছে রং করে পরিচ্ছন্ন করে রাখেন। ফলে ভেতরের অবস্থা এখন বেশ ভালো। সে তুলনায় বাইরের দেয়াল রোদে-বৃষ্টিতে অনেকটা মলিন। কালো কালো ছোপ পড়েছে অনেক জায়গায়, ঝরে যাচ্ছে আস্তর। পরিচালনা কমিটি পক্ষ থাকে বিষয়টি জানানো হয়েছে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগে। তবে জবাব সেই অভিন্ন—সংস্কারের তহবিল নেই।
কেবল সাতগম্বুজ মসজিদই নয়, দেশের গৌরবময় ইতিহাস-ঐতিহ্যের এমন অনেক অমূল্য সম্পদ অর্থ ও পরিচর্যার অভাবে মলিন-বিলীন হয়ে যাচ্ছে।