রাজধানী
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় গরিবই রয়ে গেল
রাজধানীতে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে ৩৪২টি। তিন মাসে ৪০টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা গেছে দুরবস্থার চিত্র। এসব বিদ্যালয় যেন গরিব, পড়েও দরিদ্র পরিবারের শিশুরা।
পুরান ঢাকার অভিজাত এলাকা ওয়ারী। সেখানকার লালমোহন সাহা স্ট্রিটে সুউচ্চ ভবনের ফাঁকে একতলা একটি ঘর। ছাউনি টিনের, দেয়াল পাকা। তারই মধ্যে একটি সাইনবোর্ডে লেখা—‘মুসলিম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, স্থাপিত-১৯৫৭ ’।
সম্প্রতি বিদ্যালয়টিতে গিয়ে দেখা যায়, মোটামুটি ৫০০ বর্গফুট আয়তনের একটি মাত্র কক্ষ। পুরো ঘরজুড়ে জীর্ণতার ছাপ। একপাশে একটি চেয়ার ও ছোট একটি টেবিল পেতে প্রধান শিক্ষকের বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। বাকি জায়গায় ১০ থেকে ১২টি বেঞ্চ রাখা শিক্ষার্থীদের জন্য। সেখানেই চলছে পাঠদান।
১৯৭৩ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে ৩৬ হাজার ১৬৫টি প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করেছিলেন, তার একটি মুসলিম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। বিগত ৫০ বছরে ওয়ারীর একতলা ঘরগুলো ভেঙে বহুতল ভবন হয়েছে, শিক্ষা খাতে ব্যয় বহুগুণ বেড়েছে, কিন্তু মুসলিম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে উন্নতির ছোঁয়া লাগেনি।
বিদ্যালয়টিতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ৫০। শিক্ষক রয়েছেন ৩ জন। এ বিদ্যালয়ে ওয়ারীর নিম্ন আয়ের পরিবারের শিশুরা পড়ে। শিক্ষকেরা জানান, শিশুদের জন্য বিদ্যালয়ে কোনো খেলার মাঠ নেই। বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা নেই। বর্ষাকালে স্কুলের মেঝে স্যাঁতসেঁতে হয়ে যায়। এমনকি শৌচাগারও (টয়লেট) ছিল না। বছরখানেক আগে শিক্ষকেরা নিজস্ব উদ্যোগ ও এলাকাবাসীর সহায়তায় একটি শৌচাগার নির্মাণ করেন। বিদ্যালয়টিতে কোনো দপ্তরি নেই।
শিক্ষকেরা আরও জানান, বিদ্যালয়টির শিক্ষকেরা সরকারি চাকরিজীবী হিসেবে সরকারের কাছ থেকে বেতন পান। আর বছরে ৫০ হাজারের মতো সরকারি বরাদ্দ আসে, যা দিয়ে রক্ষণাবেক্ষণ এবং বিদ্যুৎ ও পানির বিল পরিশোধ করা হয়।
২০১৫ সালের ২৪ আগস্ট মুসলিম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিদর্শনে গিয়েছিলেন তৎকালীন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, বিদ্যালয়টিতে নতুন ভবন তৈরি করা হবে এবং শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিত করা হবে। যদিও সেই প্রতিশ্রুতি এখনো পূরণ হয়নি। মুসলিম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক রুমা চৌধুরী (গত ফেব্রুয়ারিতে বদলি হয়েছেন) প্রথম আলোকে বলেন, রাজধানীতে এমন দুরবস্থার মধ্যে একটি বিদ্যালয়ে শিক্ষা কার্যক্রম চলতে পারে, সেটা ভাবাই যায় না।
শিক্ষাকে সর্বস্তরে ছড়িয়ে দেওয়ার বিষয়ে রাজনৈতিক অঙ্গীকারের অভাব দেখি না। তবে এসব বিষয় যাঁদের দেখভাল করার কথা, যাঁরা ব্যবস্থাপনা ও তদারকির দায়িত্বে আছেন, তাঁরা সেটি ঠিকমতো করছেন না।রাশেদা কে চৌধূরী, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা
ঢাকার প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর দুরবস্থার ক্ষেত্রে একটি উদাহরণ মুসলিম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। গত তিন মাসে এটিসহ ঢাকার ৪০টি প্রাথমিক বিদ্যালয় ঘুরে দেখা গেছে, কয়েকটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য—এক. সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নগরের দরিদ্র ও নিম্নবিত্ত পরিবারের শিশুরা পড়ে। দুই. বিদ্যালয়গুলোতে সরকারিভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত দপ্তরি, নিরাপত্তা প্রহরী, পরিচ্ছন্নতাকর্মী ও আয়া নেই। ব্যবস্থাপনা কমিটি বা স্থানীয়দের অনুদানে সামান্য বেতনে কোনো কোনো বিদ্যালয়ে এ ধরনের কর্মী রাখা হয়েছে। তিন. সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মলিন ও অপরিচ্ছন্ন। চার. শিক্ষার মান নিয়েও রয়েছে প্রশ্ন। পাঁচ. সহশিক্ষা কার্যক্রম নেই বললেই চলে। ছয়. বেশ কিছু বিদ্যালয়ের জমি ও অবকাঠামো বেদখল।
এই প্রতিবেদক যে ৪০টি বিদ্যালয়ে গেছেন, তা বাছাই করা হয়েছে এভাবে যে, প্রথমে প্রতিবেদক চারটি বিদ্যালয়ে গেছেন। এরপর সেখান থেকে তথ্য পেয়ে এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে মাঠ না থাকা, জমি বেদখলে থাকা বিদ্যালয় খুঁজে বের করা হয়েছে। পাশাপাশি দেখা হয়েছে বিদ্যালয়গুলোর পরিবেশ ও শিক্ষাদানের পরিস্থিতি। দেখা গেছে, ৪০ টির মধ্যে ৩০টি বিদ্যালয়ে কোনো মাঠ নেই। তিনটিতে কাগজে-কলমে মাঠ আছে, তবে তা বেদখল। শিক্ষা কর্মকর্তাদের হিসাবে, ঢাকায় ৩৪২টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে মাঠ নেই ২৫২ টির।
সরেজমিনে ২১টি বিদ্যালয়ের জমি ও ভবন বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের হাতে দখল অবস্থায় পাওয়া গেছে। এর বাইরে আরও চারটি বিদ্যালয়ের ভবন ও জমি বেদখল বলে জানা গেছে। ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে পাঠদান চলছে তিনটি বিদ্যালয়ে।
* বিদ্যালয়গুলো মলিন ও অপরিচ্ছন্ন
* শিক্ষার মান নিয়েও রয়েছে প্রশ্ন। সহশিক্ষা কার্যক্রম নেই
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের বিনা মূল্যে পড়ানো হয়। উপবৃত্তির ব্যবস্থাও আছে। শিক্ষকদের বেতন দেয় সরকার। কিন্তু একান্ত বাধ্য না হলে সাধারণত মানুষ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সন্তানদের ভর্তি করান না। এমনকি কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকদের সন্তানেরাও পড়ে অন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। বেসরকারি বিদ্যালয়ের তুলনায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো অনেক পিছিয়ে, সেটা সব দিক দিয়েই।
বঙ্গবন্ধু ১৯৭৩ সালে প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করেছিলেন প্রাথমিক শিক্ষাকে সর্বজনীন ও বাধ্যতামূলক করতে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন মন্ত্রণালয়ের বার্ষিক প্রতিবেদনে (২০২১-২২) দেওয়া বাণীতে উল্লেখ করেছেন, বাংলাদেশ উন্নয়নের মহাসড়কে দুর্বার গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। জাতীয় উন্নয়নে দক্ষ মানবসম্পদের বিকল্প নেই।
তাহলে ঢাকার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর দুরবস্থা কেন, তা জানতে চাওয়া হয়েছিল প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেনের কাছে। তিনি ২২ মার্চ প্রথম আলোকে বলেন, ঢাকা ও আশপাশের এলাকার সব বিদ্যালয়ের অবকাঠামো উন্নয়নে সরকার দৃষ্টিনন্দন প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এরই মধ্যে অনেক বিদ্যালয়ের দৃষ্টিনন্দন ভবন নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে। কোনো বিদ্যালয় আর জরাজীর্ণ থাকবে না।
মন্ত্রণালয়ে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দৃষ্টিনন্দন প্রকল্পটি বাস্তবায়নকাল ধরা হয়েছে ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। ব্যয় ১ হাজার ১৬০ কোটি টাকা। প্রকল্পটির অধীন ঢাকার ১৫৪টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভবন নতুন করে নির্মাণ এবং ১৭৭টি বিদ্যালয়ের অবকাঠামো উন্নয়ন করে দৃষ্টিনন্দন করা হবে। এর পাশাপাশি ঢাকার উত্তরায় ৩টি এবং পূর্বাচলে ১১টি নতুন বিদ্যালয় করা হবে। তবে প্রকল্প নেওয়ার পর তিন বছর চার মাস পেরিয়ে গেলেও অগ্রগতি কম। মাত্র ১০টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভবন নতুন করে নির্মাণ শুরু হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রকল্প পরিচালক মিজানুর রহমান (গত ২৮ মার্চ)। তিনি বলেন, এ প্রকল্পের উদ্দেশ্য বিদ্যালয়কে দৃষ্টিনন্দন করে শিক্ষার পরিবেশের বৈষম্য দূর করা। এর মাধ্যমে বিত্তবানেরা তাঁদের সন্তানদের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াতে আগ্রহী হবেন।
অবশ্য শিক্ষাবিদেরা মনে করেন, শুধু ভবন নয়, সামগ্রিক ব্যবস্থাপনা উন্নত করা ও শিক্ষাদানের মান বাড়ানো না হলে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রতি মানুষের আগ্রহ তৈরি হবে না।
মলিন বিদ্যালয়, দরিদ্র শিক্ষার্থী
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর এতই দুরবস্থা যে সেখানে সন্তানদের ভর্তি করানোকে নিজেদের সম্মানহানি হিসেবে গণ্য করেন সচ্ছল অভিভাবকেরা। আক্ষেপ করে সে কথাই বলছিলেন ওয়ারীর এম এ আলিম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শিরীন আক্তার। সম্প্রতি এই প্রতিবেদক স্কুলটিতে যাওয়ার পর তিনি বলেন, একজন বাড়িওয়ালার সন্তান এ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিল। কিন্তু তাঁর আত্মীয়স্বজন সেটা যেন মানতেই পারছিলেন না। কটু কথাও বলছিলেন। এ কারণে ওই অভিভাবক তাঁর সন্তানকে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে নিয়ে যান। এটা এখন সামাজিক বাস্তবতা।
এম এ আলিম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি ওয়ারীর যোগীনগরে। এটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৫২ সালে। শিক্ষকেরা জানান, বিদ্যালয়টিতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১৭০। শিক্ষক রয়েছেন ৭ জন। সরেজমিনে দেখা যায়, বিদ্যালয়টির জমির বড় অংশ বেদখল। সেখানে গড়ে উঠেছে পাঁচতলা ভবন। সেই ভবনের পাশের সরু একটু জায়গা দিয়ে বিদ্যালয়টিতে ঢুকতে হয়। একসঙ্গে একজনের বেশি শিক্ষার্থীর পক্ষে সেই পথ দিয়ে প্রবেশ কঠিন। শিক্ষকেরা জানান, চারতলা ভবনের একটি তলায় আরেকটি স্কুলের কার্যক্রম চলে। ওই বিদ্যালয় নিজেদের জমির দখল হারিয়ে এম এ আলিম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আশ্রয় নিয়েছে।
জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ অনুযায়ী, বিদ্যালয়ে একজন শিক্ষকের বিপরীতে ৩০ শিক্ষার্থী থাকলে সেটিকে আদর্শ মান ধরা হয়। তবে রাজধানীর বেশির ভাগ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর অনুপাতে শিক্ষক কম। যেমন ঢাকার ধানমন্ডির রায়েরবাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১ হাজার ১৫১। শিক্ষক রয়েছেন ১৫ জন (গত ফেব্রুয়ারির হিসাব)। মানে হলো, প্রতি ৭৮টি শিশুর বিপরীতে ১ জন শিক্ষক সেখানে শিক্ষাদান করেন। গুলশানের মেরাদিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়েই শিক্ষার্থী আছে ১ হাজার ৬০০-এর বেশি। শিক্ষক রয়েছেন ২৫ জন। অর্থাৎ ৬৪ শিক্ষার্থীর বিপরীতে শিক্ষক ১ জন।
সব মিলিয়ে ঢাকার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক রয়েছেন ৩ হাজার ৩৩৫ জন (গত ফেব্রুয়ারির হিসাব)। একজন শিক্ষকের বিপরীতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা গড়ে ৪৫। চারটি বিদ্যালয় পাওয়া গেছে, যেখানে অনুমোদিত পদ থাকলেও শিক্ষক সে অনুযায়ী নেই। সেগুলো হলো ওয়ারীর মুসলিম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ইসলামিয়া ইউপি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, কাজী ফরী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ছোট কাটারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। আবার কিছু বিদ্যালয়ে শিক্ষকের অনুপাতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা কম।
বাংলাদেশে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার মান কেমন, তা নিয়ে সাম্প্রতিক কোনো গবেষণা পাওয়া যায়নি। তবে চিত্রটি উঠে এসেছিল ২০১৫ সালে ‘জাতীয় শিক্ষার্থী মূল্যায়ন’ শীর্ষক প্রতিবেদনে। এতে দেখা যায়, তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীদের গণিতে যে দক্ষতা থাকা উচিত, তা নেই ৫৯ শতাংশের ক্ষেত্রে। পঞ্চম শ্রেণিতে সেটা ৯০ শতাংশ। দরিদ্র পরিবারের শিক্ষার্থীদের মধ্যে দক্ষতার ঘাটতি অনেক বেশি। কারণ হিসেবে ওই প্রতিবেদনে বেশ কয়েকটি বিষয় উল্লেখ করা হয়। একটি হলো, শিক্ষাদানের নিম্নমান।
বেসরকারি বিদ্যালয়ে পড়াতে অভিভাবকদের উচ্চ ব্যয় করতে হয়। যেসব বিদ্যালয় জনপ্রিয়, সেখানে বেতন মাসে দুই থেকে আট হাজার টাকা। বছরের শুরুতে ভর্তিতে লাগে ২০ থেকে ৫০ হাজার টাকা। কোথাও কোথাও ব্যয় আরও বেশি।
মিরপুরে বেসরকারি একটি স্কুলে কেজিতে পড়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যক্তির সন্তান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সন্তানের বেতন, ভর্তির খরচ, বই কেনা ও যাতায়াত মিলিয়ে তাঁর মাসে ব্যয় ১০ হাজার টাকার বেশি। তাঁর বাসার কাছেই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে। সেটা রেখে দূরের বিদ্যালয়ে সন্তানকে ভর্তি করিয়েছেন শুধু পড়াশোনার মানের কারণে।
জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এ বলা হয়েছে, প্রাথমিক শিক্ষা হবে সর্বজনীন, বাধ্যতামূলক, অবৈতনিক এবং সবার জন্য একই মানের। প্রাথমিক শিক্ষাকেন্দ্রে স্থান ও বিদ্যালয়ভেদে সুযোগ-সুবিধার প্রকট বৈষম্য, অবকাঠামোগত সমস্যা, শিক্ষকস্বল্পতাসহ সমস্যাগুলো দূর করে শিক্ষার ভিত শক্ত করা হবে।
ঢাকার বাস্তবতায় যেসব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠ নেই, সেখানে মাঠ করার সুযোগ নেই। বিদ্যালয়সংলগ্ন ফাঁকা জমি না থাকা এবং জমির উচ্চমূল্যের কারণে এটি করা সম্ভব নয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইআর) সহযোগী অধ্যাপক মো. মজিবুর রহমান তাঁর কার্যালয়ে এই প্রতিবেদককে বলেন, সবার জন্য সমান মানের শিক্ষা দিতে সরকারের উদ্যোগ কম। এর একটি কারণ, দেশে প্রচুর বেসরকারি বিদ্যালয় গড়ে উঠেছে। তাদের মূল উদ্দেশ্য ব্যবসা। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনার মান ভালো হলে বেসরকারি বিদ্যালয়ের ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাঁর মতে, সরকারি বা আধা সরকারি প্রতিষ্ঠানে যাঁরা চাকরি করেন, তাঁদের সন্তানদের সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ানো বাধ্যতামূলক করা হলে সরকারি বিদ্যালয়ের মান বাড়ানোর উদ্যোগ দেখা যেতে পারে।
মাঠ নেই ২৫২ টিতে
জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এ বলা হয়েছে, শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের পরিবেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মাঠ, ক্রীড়া, খেলাধুলা ও শরীরচর্চার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করতে হবে।
শিক্ষা কর্মকর্তাদের মাধ্যমে খোঁজ নিয়ে এবং সরেজমিনে দেখা যায়, রাজধানীর ৩৪২টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে মাঠ আছে মাত্র ৯০টি বিদ্যালয়ে, অর্থাৎ ২৫২ টিতে মাঠ নেই। ওয়ারীর এম এ আলীম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শিরীন আক্তার বলেন, একটি শ্রেণিকক্ষে শিশুদের তিনি একবার প্রশ্ন করেছিলেন, কেন তারা বিদ্যালয়ে আসে? এর উত্তর কাগজে লিখে দিতে বলেছিলেন তিনি। ৯০ শতাংশ শিক্ষার্থী উত্তর দিয়েছিল, বিদ্যালয়ে এসে তারা বন্ধুদের সঙ্গে খেলতে পারে। তিনি আরও বলেন, মাঠ না থাকার কারণে শিক্ষার্থীরা খেলতে পারে না। অথচ শিশুদের পাঠদানকে আনন্দময় করা ও মানসিক বিকাশের জন্য খেলাধুলার বিকল্প নেই। উল্লেখ্য, এম এ আলীম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মাঠ নেই।
তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীদের গণিতে যে দক্ষতা থাকা উচিত, তা নেই ৫৯ শতাংশের ক্ষেত্রে। পঞ্চম শ্রেণিতে সেটা ৯০ শতাংশ। দরিদ্র পরিবারের শিক্ষার্থীদের মধ্যে দক্ষতার ঘাটতি অনেক বেশি।
কোনো কোনো বিদ্যালয়ের মাঠের জায়গা রয়েছে। তবে তা বেদখল। ফলে শিশুরা খেলতে পারে না। ঢাকার আটটি বিদ্যালয়ের মাঠে পানির পাম্প বসিয়েছে ঢাকা ওয়াসা। ফলে শিশুদের খেলার মাঠ আর থাকেনি। যেমন ঢাকার খিলগাঁওয়ের আইডিয়াল মুসলিম বালক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও বালিকা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় দুটির কার্যক্রম চলে একই ভবনে। দুটি বিদ্যালয়ের জমি মাত্র ১২ দশমিক ৩৭ শতাংশ। ভবন করা হয়েছে প্রায় ৬ শতাংশ জমিতে। ভবনের সামনে ছোট্ট উঠানের মতো জায়গায় শিশুরা খেলাধুলা করত। এখন পুরো আঙিনায় ওয়াসার পানির পাম্প।
আইডিয়াল মুসলিম বালক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সামসুন নাহার প্রথম আলোকে বলেন, ১৯৯৬ সালে এলাকাবাসীর পানির চাহিদা পূরণের জন্য পাম্পটি বসানো হয়। এখন আর ফাঁকা জায়গা নেই যে শিশুরা খেলবে।
ঢাকা ওয়াসার পানির পাম্প বসানো হয়েছে মেরাদিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, পুরান ঢাকার সুরিটোলা প্রাথমিক বিদ্যালয়, মিরপুরের ইসলামিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয় ও শহীদবাগ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ডেমরার মাদারটেক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও মাতুয়াইল দক্ষিণপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ধানমন্ডি ১ নম্বর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে।
ঢাকা ওয়াসার পরিচালক এ কে এম সহিদ উদ্দিন গত ২৮ মার্চ প্রথম আলোকে বলেন, এলাকার মানুষের পানির চাহিদা পূরণ করতে কোথাও জায়গা না পেয়ে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠে পাম্প বসানো হয়েছে। অন্য জায়গায় পাম্প বসানোর সুযোগ পেলে বিদ্যালয়ের মাঠ খালি করে দেওয়া হবে।
ঢাকার বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনায় (২০২২) বিদ্যালয়ের মাঠের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, ঢাকায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জমির পরিমাণ হবে অন্তত দেড় একর। প্রতিটি বিদ্যালয়ে মাঠ থাকবে।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শাহ রেজওয়ান হায়াত গত ২৫ মার্চ প্রথম আলোকে বলেন, ঢাকার বাস্তবতায় যেসব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠ নেই, সেখানে মাঠ করার সুযোগ নেই। বিদ্যালয়সংলগ্ন ফাঁকা জমি না থাকা এবং জমির উচ্চমূল্যের কারণে এটি করা সম্ভব নয়। তবে শিক্ষার্থীদের খেলাধুলার জন্য বিদ্যালয়ের আশপাশে ফাঁকা জায়গা বা সামাজিক প্রতিষ্ঠানের জায়গায় শিশুদের খেলার মাঠের ব্যবস্থা করার চেষ্টা চলছে।
উল্লেখ্য, নানা প্রয়োজনে সরকার বিপুল টাকা ব্যয়ে জমি অধিগ্রহণ করে। মাঠের প্রয়োজনে জমি অধিগ্রহণের নজির বিরল। বরং ঢাকার ফাঁকা জায়গাগুলোতে সরকারি সংস্থাই নানা অবকাঠামো করেছে।
ঝুঁকিপূর্ণ ভবনেও পাঠদান
যে তিনটি বিদ্যালয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে পাঠদান হচ্ছে, তার একটি পুরান ঢাকার ওয়ারীর মহিলা সমিতি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। গত ১২ ডিসেম্বর ঢাকা জেলা শিক্ষা কর্মকর্তাকে চিঠি দিয়ে তৎকালীন থানা শিক্ষা কর্মকর্তা মঈনুল হোসেন বলেন, বিদ্যালয়টির ভবনের অবস্থা খুবই জরাজীর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ। অফিসকক্ষসহ প্রতিটি শ্রেণিকক্ষের ছাদের পলেস্তারা খসে পড়ছে। প্রাক্-প্রাথমিক শ্রেণিকক্ষের ছাদ থেকে রডসহ বৈদ্যুতিক পাখা পড়ে গেছে। যেকোনো মুহূর্তে বড় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।
অবশ্য সম্প্রতি গিয়ে দেখা যায়, ঝুঁকিপূর্ণ ভবনেই পাঠদান চলছে। বিদ্যালয়টিতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৬১। শিক্ষক রয়েছেন ৭ জন। বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষক লিপিকা তালুকদার প্রথম আলোকে বলেন, বিকল্প ব্যবস্থা নেই। বাধ্য হয়েই এখানে পাঠদান চলছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, রাজধানীর ৩৪২টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে মাঠ আছে মাত্র ৯০টি বিদ্যালয়ে, অর্থাৎ ২৫২ টিতে মাঠ নেই।
ভবন ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করা বাকি দুই বিদ্যালয়ও পুরান ঢাকার। বিদ্যালয় দুটি হলো কোতোয়ালি থানার ছোট কাটারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও লালবাগ থানার চাম্পাতলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এর মধ্যে ছোট কাটারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভবনটি ২০১৩ সালে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করা হয়। তখনই বিদ্যালয়টি সাময়িকভাবে সরিয়ে নেওয়া হয় বংশালের হয়বৎনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। সাত বছর পর ২০২০ সালে আবারও নিজস্ব জমিতে স্থানান্তর করা হয় বিদ্যালয়টি। কিন্তু ভবন সমস্যার সমাধান হয়নি। এখন বিদ্যালয়ের ফাঁকা জমিতে দুটি টিনের খুপরিঘর করে চলছে বিদ্যালয়ের কার্যক্রম।
বিদ্যালয়টির সহকারী শিক্ষক ফেরদৌসী আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, বিদ্যালয়টি টিকিয়ে রাখতে যুদ্ধ চলছে।
‘করুণ দশা দেখলে দুঃখ লাগে’
ঢাকায় প্রাথমিক পর্যায়ে নানা ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। ইংরেজি মাধ্যমের বিদ্যালয়, ইংরেজি সংস্করণের বিদ্যালয়, আধা সরকারি বিদ্যালয়, বেসরকারি বিদ্যালয় ইত্যাদি। এসবের মধ্যে যেন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোই দরিদ্র।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঢাকা মহানগরীর এই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের করুণ দশা দেখলে দুঃখ লাগে। শিক্ষাকে সর্বস্তরে ছড়িয়ে দেওয়ার বিষয়ে রাজনৈতিক অঙ্গীকারের অভাব দেখি না। তবে এসব বিষয় যাঁদের দেখভাল করার কথা, যাঁরা ব্যবস্থাপনা ও তদারকির দায়িত্বে আছেন, তাঁরা সেটি ঠিকমতো করছেন না।’ তিনি বলেন, অঞ্চলভিত্তিক তদারকি করে সমস্যা চিহ্নিত করতে হবে। তারপর পরিকল্পনা করে এসব সমস্যার সমাধান করতে হবে।