বৃষ্টি থেমে যাওয়ার ৩০ ঘণ্টা পরও রাজধানীর বেশ কিছু এলাকার সড়ক ডুবে ছিল। বিশেষ করে পুরান ঢাকার বাসিন্দাদের দুর্ভোগ ছিল বেশি। বকশীবাজার, চকবাজার, চানখাঁরপুল, হোসেনি দালান, বুয়েট ক্যাম্পাস ও স্বামীবাগ এলাকার বেশির ভাগ সড়কে হাঁটুসমান বা এর কাছাকাছি পরিমাণ পানি ছিল গতকাল শনিবার সন্ধ্যা ছয়টার দিকেও। এসব এলাকার অনেক ভবনের নিচতলার বাসিন্দারা দিনভর ব্যস্ত ছিলেন পানি সরানোর কাজে।
বুয়েট ক্যাম্পাসের ভেতরে কর্মকর্তা–কর্মচারীদের জন্য নির্মাণ করা আবাসিক ভবনগুলোর মধ্যে ১১টির নিচতলায় গত শুক্রবার দুপুরে পানি ঢোকে। গতকাল বিকেলেও একই পরিস্থিতি ছিল। সেখানকার একটি ভবনের নিচতলার ফ্ল্যাটের বাসিন্দা প্রীতম হালদার প্রথম আলোকে বলেন, শুক্রবার দুপুরের আগেই বাসার আঙিনা ডুবে যায়। এরপর ঘরের ফ্রিজ ও ওয়াশিং মেশিন টেবিলের ওপর তুলে রাখেন তাঁরা। শুক্রবার দুপুর থেকে তাঁরা দুর্ভোগের মধ্যে রয়েছেন। শনিবার দুপুরেও পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়ায় নিরুপায় হয়ে ঘরের সবাই মিলে পানি সরানোর কাজে নেমেছেন।
ভারী বৃষ্টি হলেই বুয়েট ক্যাম্পাসের বিভিন্ন এলাকায় পানি জমে যায় বলে জানান প্রীতম হালদার। তিনি বলেন, ঢাকায় এত কিছু হচ্ছে, এত অবকাঠামো তৈরি করা হয়েছে; কিন্তু জলাবদ্ধতার ভোগান্তি কমছে না। এই সমস্যার কেন সমাধান হয় না তা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি।
গত শুক্রবার সকালে ঢাকায় শুরু হওয়া বৃষ্টি দুপুর ১২টায় থেমে যায়; অথচ গতকাল সন্ধ্যায় বুয়েটের তিতুমীর হল, শেরেবাংলা হল, আহসানউল্লাহ হল, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হল ও সাবেকুন নাহার সনি হলের সামনে পানি জমে ছিল। বুয়েটের কেন্দ্রীয় খেলার মাঠ ছিল জলাবদ্ধ।
গতকাল বিকেল চারটার দিকে আহসানউল্লাহ হলের সামনে কথা হয় আবাসিক শিক্ষার্থী সালেহ আহমদের সঙ্গে। তিনি বলেন, বৃষ্টি হলেই হলের সামনে পানি জমে যায়। কখনো কখনো এই পানি পুরোপুরি সরতে দু–তিন দিন লেগে যায়।
বুয়েট ক্যাম্পাসের দক্ষিণ পাশে বকশীবাজার এলাকায় মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের সামনের সড়কে গতকাল বিকেলেও হাঁটুসমান পানি ছিল। যে কারণে এই সড়কে যানবাহন চলাচলে সমস্যা হচ্ছিল। কয়েকটি লেগুনা (যাত্রীবাহী ছোট গাড়ি) সড়কে বিকল হয়ে পড়ে থাকতে দেখা যায়। বকশীবাজারের পাশের চকবাজার ও চানখাঁরপুল এলাকার দুটি সড়কেও ছিল থই থই পানি। একই অবস্থা ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের সামনের সড়কেও। সেখানে দক্ষিণ সিটি করপোরেশন ‘সাকার মেশিন’ দিয়ে সড়ক থেকে পানি সরানোর কাজ করছিল। নালায় জমাট বাঁধা বালু, মাটি, প্লাস্টিকসহ আবর্জনা যান্ত্রিক পদ্ধতিতে অপসারণ করতে সাকার মেশিন ব্যবহার করা হয়।
বকশীবাজার, চকবাজার ও সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের সামনে দীর্ঘ সময় পানি জমে থাকার কারণ হিসেবে ঢাকা দক্ষিণ সিটির প্রকৌশল বিভাগ বলছে, এসব এলাকার পানি যথাযথভাবে অপসারণ করতে ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে কোনো কাজ হয়নি। এসব এলাকার পানি সরানোর পথও ত্রুটিপূর্ণ। এসব এলাকার পানি আজিমপুর হয়ে বুড়িগঙ্গায় যায়। তাই পানি সরতে অনেক সময় লাগছে। এসব এলাকা থেকে বৃষ্টির পানি যাতে চকবাজার হয়ে বুড়িগঙ্গা নদীতে যায়, সে জন্য নতুন পথ (পানিনিষ্কাশণের ব্যবস্থা) তৈরি করা হচ্ছে।
ডুবে থাকা সড়কের পানি সরাতে সায়েদাবাদের পাশে স্বামীবাগ এলাকার মিতালী বিদ্যাপীঠের (উচ্চবিদ্যালয়) সামনেও গতকাল বিকেলে সাকার মেশিন বসায় সিটি করপোরেশন। তবে দীর্ঘ সময়েও পানি না সরায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন স্থানীয় বাসিন্দারা।
গত শুক্রবারের বৃষ্টিতে মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেট, ফকিরাপুল ও নিউমার্কেট এলাকার ব্যবসায়ীরা ক্ষতির মুখে পড়েছেন। ভারী বৃষ্টি ও জলাবদ্ধতার কারণে শুক্রবার নিউমার্কেটে বেচাকেনা বন্ধ ছিল। গতকাল সকালে সেখানে গিয়ে দেখা যায়, নিচতলার প্রায় সব দোকানের মালামাল ভিজে গেছে। ভেজা কাপড়, পর্দা, শিশুদের খেলনাসামগ্রী, ব্যাগ, ট্রলিসহ নানা ধরনের পণ্য রোদে শুকাতে দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
জলাবদ্ধতা নিরসনে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন কী করেছে, তা জানাতে গতকাল বিকেলে সংবাদ সম্মেলন করেন সংস্থাটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মিজানুর রহমান। তিনি বলেন, অল্প সময়ে বেশি বৃষ্টি হওয়ার কারণে পানি সরতে সময় লেগেছে। জলাবদ্ধতার কারণে ঢাকাবাসীর কাছে দুঃখ প্রকাশ করে তিনি বলেন, সামনে পরিস্থিতির আরও উন্নতি হবে। এ জন্য যত্রতত্র প্লাস্টিক বর্জ্য না ফেলতে নগরবাসীকে অনুরোধ করেন তিনি।
শুক্রবারের বৃষ্টিতে পরিস্থিতি কেন এমন হলো তা পর্যালোচনা করে সমাধানের পথ খুঁজবেন বলেও জানান ঢাকা দক্ষিণ সিটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মিজানুর রহমান।
ঢাকা উত্তর সিটি সিটি করপোরেশনের আওতাধীন উত্তরখান ও দক্ষিণখান এলাকার বেশ কয়েকটি সড়কে গতকাল বিকেল চারটা পর্যন্ত পানি জমে ছিল।
ভারী বৃষ্টি হলেও জলাবদ্ধতা যাতে না হয় সে জন্য ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন গত চার বছরে কমপক্ষে ৭৩০ কোটি টাকা খরচ করেছে; কিন্তু জলাবদ্ধতার সমস্যা কমেনি। গত শুক্রবার ছাড়াও চলতি বছরের ১১ ও ২৭ মে ভারী বৃষ্টির পর রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছিল।
নগর-পরিকল্পনাবিদেরা বলছেন, ঢাকার ড্রেনেজ ব্যবস্থাপনা নিয়ে করা মহাপরিকল্পনাকে গুরুত্ব না দিয়ে দুই সিটি কর্তৃপক্ষ শুধু টাকা খরচ করছে। দীর্ঘমেয়াদি উদ্যোগ ছাড়া ঢাকার জলাবদ্ধতার স্থায়ী সমাধান হবে না।
নাগরিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত স্থপতি ইকবাল হাবিব প্রথম আলোকে বলেন, জলাবদ্ধতার সমস্যা দূর করতে বিক্ষিপ্তভাবে শত শত কোটি টাকা খরচ করছে ঢাকার দুই সিটি কর্তৃপক্ষ। যে কারণে সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। পুরো বিষয়টি নিয়ে এখন পর্যন্ত সামগ্রিক কোনো পরিকল্পনা নেই তাদের। জলাবদ্ধতার সমস্যা স্থায়ীভাবে সমাধান করার জন্য ড্রেনেজ ব্যবস্থাপনা, খাল–নর্দমা সচল রাখা, মানুষকে সচেতন করা—সব মিলিয়ে কাজ করতে হবে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনকে।