ঢাকার যে ১২ জায়গায় কৃষক বেচে সবজি, দুধ, মুরগি

কৃষকদের বাজারে চলছে কেনাকাটা
ছবি: শুভ্র কান্তি দাশ

ফুটপাতে কাপড় বিছানো, মাথার ওপরে বড় ছাতা। সেখানে প্লাস্টিকের তৈরি একধরনের খাঁচায় (ক্যারেট) সবজির পসরা সাজিয়ে বসেছে দোকান। কিছু দোকানে রয়েছে দুধ, ডিম কিংবা দেশি মুরগি। কোনো কোনো দোকানে আছে টমেটো, ফুলকপি, বাঁধাকপি, শিমসহ বিভিন্ন ধরনের সবজি। বিক্রি হচ্ছে লালশাক, পালংশাক, লাউশাক ও বউতাশাকও। আছে বরই, কামরাঙা, পাকা পেঁপের মতো দেশি কিছু ফলমূল।

সকালের হাঁটাহাঁটি কিংবা শরীরচর্চা শেষে বাসায় ফেরার পথে অনেকেই কেনাকাটা করছেন ওই বাজার থেকে। কেউ আবার এসেছেন এখান থেকেই বাজার করতেই।

রাজধানীর লালমাটিয়ার ই-ব্লক এলাকায় গেলেই দেখা মিলবে এ বাজারের। সেখানে লালমাটিয়া মহিলা কলেজের পেছনে ঢাকা ওয়াসার গভীর নলকূপসংলগ্ন ফুটপাতে এভাবে বিভিন্ন রকমের সবজি ও অন্যান্য খাদ্যপণ্য বিক্রি করতে দেখা গেছে।
এ বাজারের বিক্রেতারা কৃষক। তাঁরা নিজেদের খেতে সবজি চাষ করেন। খামারে পালেন গাভি কিংবা হাঁস-মুরগি।

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) ঢাকা ফুড সিস্টেম প্রকল্পের আওতায় ঢাকা মহানগরে ‘এলাকাভিত্তিক কৃষকের বাজার স্থাপন’ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় এ বাজার বসেছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে বেসরকারি সংস্থা ওয়ার্ক ফর আ বেটার বাংলাদেশ ট্রাস্ট।

ক্রেতা-বিক্রেতারা যা বলছেন

বাজার থেকে লাউ, পালংশাক, হাঁসের ডিম কিনেছেন আশরাফুল আমিন ও তাহমিনা আমিন দম্পতি। বেসরকারি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তা আশরাফুল আমিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘একদিন বাজারটিতে এসে দেখলাম, টাটকা শাকসবজি পাওয়া যায়। এখন প্রতি সপ্তাহে এখান থেকেই বাজার করি।’ তবে দাম কিছুটা বেশি বলে জানালেন তিনি।

প্রতি সপ্তাহের শুক্রবার সকাল সাতটা থেকে এ বাজার শুরু হয়। কৃষকদের আনা পণ্য শেষ না হওয়া পর্যন্ত চলে বাজার। তবে প্রায় সময়ই দুপুরের মধ্যেই সব বিক্রি হয়ে যায় বলে জানান কৃষকেরা।

বাজারটিতে ৯০ কেজি দুধ এনেছিলেন সাভারের তেঁতুলঝাড়া ইউনিয়নের খতরাপাড়া গ্রামের চাষি মো. মহিউদ্দীন। সকাল ১০টার মধ্যে তাঁর ৪০ কেজি দুধ বিক্রি হয়েছে।
মহিউদ্দীন প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রায়ই সকাল ৯টা থেকে ১০টার মধ্যেই সব দুধ বিক্রি হয়ে যায়। এ এলাকার অনেকে এখন আমার নিয়মিত ক্রেতা। তাঁর বাড়িতে সাতটি গাভি রয়েছে। দুদিনের দুধ জমিয়ে ৯০ থেকে ১০০ কেজি দুধ নিয়ে আসেন। গ্রামে পাইকারদের কাছে ৮০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করতেন। এ বাজারে তিনি ১০০ টাকা কেজিতে দুধ বেচেন।

দুধ ছাড়াও মহিউদ্দীনের আনা করলা, শিম ও বেগুন সকাল ১০টার মধ্যেই সব বিক্রি হয়ে যায়। শুধু টমেটো ছিল সাত কেজির মতো।

বিক্রেতারা বলছেন, বাজারে পণ্য নিয়ে আসা কৃষকেরা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকে যাচাইকৃত। প্রতিটি ওয়ার্ডের বাজারের জন্য ৩০ জন করে কৃষক নির্বাচন করা হয়েছে। প্রতি সপ্তাহে ১০ জন করে কৃষক বাজারে আসেন। কেউ আসতে না পারলে পরিবর্তে অন্য একজন আসেন।

সবজি, ফল, ডিম, দুধ—সবই পাওয়া যায় এ বাজারে
ছবি: শুভ্র কান্তি দাশ

এ ছাড়া বাজারে সবজি নিয়ে আসা ১০ কৃষক বাকি ২০ কৃষক বা খামারির কাছ থেকে সবজি, অন্য খাদ্যপণ্য বা ফলমূল আনতে পারেন।

লালমাটিয়ার বাজারটি তদারক করেন ওয়ার্ক ফর আ বেটার বাংলাদেশ ট্রাস্টের ফার্মা স্পেশালিস্ট ইমরান মিয়া। তিনি বলেন, কৃষকের আনা সবজিগুলো স্বাস্থ্যগত বিবেচনায় নিরাপদ। কারণ, এসব সবজি চাষে নিরাপদ মাত্রায় ওষুধ প্রয়োগ করা হয়। ওষুধ প্রয়োগের পর নির্ধারিত সময় পার হলে বিক্রির জন্য সবজি সংগ্রহ করা হয়।

ছুটির দিনে মেয়ে মাইরিনকে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ওই বাজারে যান লালমাটিয়ার বাসিন্দা মোবারক হোসেন। তিনি একটি টেলিযোগাযোগ প্রতিষ্ঠানের (টেলিকম ভেন্ডার) প্রকৌশলী। বাজার থেকে বাবা-মেয়ে মিলে টমেটো, শসা, গাজর ও কলা কেনেন। মোবারক বলেন, এই বাজারে সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে টাটকা সবজি কেনা যায়।

বাজারটি থেকে ধনেপাতা, পালংশাক ও কাঁচা মরিচ কেনেন লালমাটিয়া সি ব্লকের বাসিন্দা গৃহিণী জোবায়দা বেগম। তিনি বলেন, ‘আমার প্রয়োজনীয় সবজি এখন নিয়মিত এখান থেকে কিনি। এ বাজারের সবজির স্বাদ অন্য বাজার থেকে ভিন্ন।’ ক্রেতাদের চাহিদা ও মৌসুম অনুযায়ী বিভিন্ন ধরনের সবজি ও অন্যান্য পণ্য রাখা গেলে ভালো হবে বলেও জানান তিনি।

সিঙ্গাইর থানা থেকে বাজারে দেশি মুরগি বিক্রির জন্য এনেছিলেন খামারি শহিদুল ইসলাম। সাড়ে ১০টার মধ্যেই তাঁর ২০টি দেশি মুরগির সব কটি বিক্রি হয়ে যায়। প্রতি কেজি তিনি ৫৫০ টাকায় বিক্রি করেছেন।

শহিদুল ইসলাম বলেন, বিক্রি ভালোই হচ্ছে। এখন অনেকে এ বাজারের নিয়মিত ক্রেতা হয়ে গেছেন। সরাসরি ক্রেতার কাছে বিক্রি করতে পারায় তাঁর লাভও বেশি হচ্ছে বলে জানান তিনি।

এলাকাভিত্তিক কৃষকের বাজার স্থাপন প্রকল্পের দলনেতা জিয়াউর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, মানুষের জন্য নিরাপদ সবজি নিশ্চিত করা, মধ্যস্বত্বভোগীদের বাদ দিয়ে কৃষক বা চাষি যেন পণ্য বিক্রি করে ন্যায্যমূল্য পায় এবং স্থানীয় সরকার বা সিটি করপোরেশন যাতে এমন উদ্যোগ নিতে পারে, এসব উদ্দেশ্যে বাজারটি চালু করা হয়েছে। এতে স্থানীয় বাসিন্দাদের খুবই ভালো সাড়া পাওয়া যাচ্ছে। অন্যদিকে কৃষকেরা উপকৃত হচ্ছেন এবং বাজারকে কেন্দ্র করে তাঁরা বিভিন্ন ধরনের সবজি চাষ করছেন।

১২টি জায়গায় কৃষকের বাজার

ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ৬টি করে মোট ১২টি ওয়ার্ডে এই কৃষকের বাজার বসে। এর মধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটির ১ নম্বর ওয়ার্ডে খিলগাঁও সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের পাশে, ১৯ নম্বর ওয়ার্ডে ইস্কাটন গার্ডেন সরকারি কোয়ার্টারের সামনে, ২৬ নম্বর ওয়ার্ডে সলিমুল্লাহ এতিমখানার বিপরীতে, ৩৯ নম্বর ওয়ার্ডে টিকাটুলীর অভয় দাস লেনে, ৫৫ নম্বর ওয়ার্ডে ঝাউচরে তিতাস গ্যাস কন্ট্রোল স্টেশনের সামনে এবং ৫৬ নম্বর ওয়ার্ডে শেখ জামাল বিদ্যালয়ের সামনে বাজার বসে।

ঢাকার ১২ জায়গায় বসে এ বাজার
ছবি: শুভ্র কান্তি দাশ

ঢাকা উত্তর সিটির ২ নম্বর ওয়ার্ডে পল্লবীতে কমিউনিটি সেন্টারের সামনে, ৬ নম্বর ওয়ার্ডের ট ব্লকে ইসলামিয়া হাই স্কুলের সামনে, ৭ নম্বর ওয়ার্ডে রূপনগর আবাসিক এলাকার ২৩ নম্বর সড়কে, ৩০ নম্বর ওয়ার্ডে আদাবর ১০ নম্বর সড়কে, ৩২ নম্বর ওয়ার্ডে লালমাটিয়া বি ব্লকে লালমাটিয়া মহিলা কলেজের পেছনে এবং ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডে মোহাম্মাদী হাউজিং সোসাইটির খালপাড় এলাকায়।

এ ছাড়া প্রকল্পের আওতায় নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুর সিটি করপোরেশনেও দুটি করে চারটি কৃষকের বাজার বসে। এর মধ্যে নারায়ণগঞ্জ সিটিতে ১২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর কার্যালয়ের সামনে ডন চেম্বার এলাকায়, ১৫ নম্বর ওয়ার্ডের নিমতলা লেক সাইড এবং গাজীপুর সিটিতে ২৮ নম্বর ওয়ার্ডে রাজদিঘীর পশ্চিম পাড় এলাকায় ও ৫৪ নম্বর ওয়ার্ডে শফিউদ্দিন সরকার একাডেমি অ্যান্ড কলেজের পাশের সড়কে।