রাজধানীর মিরপুর ১৩ নম্বর সেকশনে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) কার্যালয়ের সামনের প্রধান সড়কে চলছে খোঁড়াখুঁড়ি। এখানে ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (ডিপিডিসি) বিদ্যুতের তার বসানোর কাজ করছে। বিআরটিএ কার্যালয়ের পেছনে সেনপাড়া পর্বতা এলাকার সড়কগুলোয়ও চলছে খোঁড়াখুঁড়ি। সেখানে ফুটপাত নির্মাণ ও নালা তৈরি করছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)। দুটি সংস্থাই কাজ করছে সড়ক খনন নীতিমালা না মেনে।
বর্তমানে সমন্বয়হীন এমন খোঁড়াখুঁড়ি চলছে রাজধানীজুড়ে বিভিন্ন এলাকায়। এলাকার অনেক স্থানেই কোন সংস্থা খোঁড়াখুঁড়ি করছে, সেটির কোনো বিজ্ঞপ্তি বা সাইনবোর্ড নেই। লাগানো হয়নি সতর্কতামূলক কোনো ফিতাও। সড়ক খুঁড়ে ওঠানো মাটি পড়ে আছে সড়কে। আবার কোনো জায়গায় সড়ক মেরামতের জন্য আনা ইট-পাথর রয়েছে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। অব্যবহৃত ও ভাঙা পাইপও পড়ে আছে সড়কে।
ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের তথ্য বলছে, গত ফেব্রুয়ারিতে ঢাকার শতাধিক স্থানে খোঁড়াখুঁড়ির অনুমতি দেওয়া হয়েছে। সরকারের অন্তত ১৩টি সংস্থা সড়ক খননের অনুমতি নিয়েছে। এসব কাজের অনেকগুলো এখনো চলমান। পাশাপাশি দুই সিটি করপোরেশনও বিভিন্ন এলাকার সড়কে উন্নয়নকাজ করছে। তবে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন জানিয়েছে, জনদুর্ভোগ কমাতে ঢাকা মহানগর পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ রোজায় নতুন করে সড়ক খননের অনুমতি না দেওয়ার অনুরোধ করেছিল। তাই মার্চে নতুন করে কাউকে অনুমতি দেওয়া হয়নি।
নীতিমালা মেনে কাজ করতে ঠিকাদারদের বারবার নির্দেশনা দেওয়া হয়। তারপরও সব ক্ষেত্রে নীতিমালা মানা সম্ভব হয় না। অনেক ক্ষেত্রে একটি সড়কের অর্ধেক খনন করার ছয় মাস বা বছরখানেক পর খোঁড়ার অনুমতি দেয় সিটি করপোরেশন। কিন্তু লোকজন ওয়াসাকে গালমন্দ করে।
সড়কে খনন করায় এবং পরে মেরামত কার্যক্রমে সমন্বয় ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার অভাবে ঢাকায় প্রতিবছরই দেখা দেয় জনদুর্ভোগ। সিটি করপোরেশনভুক্ত এলাকায় সড়কে খোঁড়াখুঁড়িতে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় ঘটাতে ‘ঢাকা মহানগরীর সড়ক খনন নীতিমালা-২০১৯’ প্রণীত হয়েছে। দুই সিটি করপোরেশন ছাড়া ঢাকা ওয়াসা, তিতাস গ্যাস, ডিপিডিসি, ডেসকো, বিটিসিএলের মতামত ও সুপারিশ নিয়ে চূড়ান্ত করা হয়েছিল এটি।
নীতিমালা অনুযায়ী কোনো সড়কের পুরোটা একসঙ্গে খোঁড়া যাবে না। মাসের পর মাস একটানা কোনো সড়ক খোঁড়া যাবে না। ১৫ দিনের কয়েকটি ভাগে ভাগ করে কাজ করতে হবে। ধুলাবালি উড়ে যাতে ভোগান্তি না হয়, সে জন্য নিয়মিত পানি ছিটাতে হবে। হলুদ বা লাল ফিতা দিয়ে খনন এলাকা ঘিরে রাখতে হবে। চলাচলে বিঘ্ন ঘটিয়ে মালামাল মজুত করে রাখা যাবে না।
জনগণের দুর্ভোগ
গতকাল সোমবার মোহাম্মদপুর, লালমাটিয়া, মিরপুর ও দক্ষিণখান ঘুরে দেখা যায়, এসব এলাকার বিভিন্ন সড়কে খোঁড়াখুঁড়ি চালাচ্ছে সরকারের বিভিন্ন সংস্থা। কোনো কোনো সড়ক এক মাসের বেশি সময় ধরে খুঁড়ে রাখা হয়েছে। পথচারীদের চলতে কষ্ট হচ্ছে। উত্তোলন করা মাটি না সরানোয় চারদিকে ধুলার ছড়াছড়ি। যেখানে–সেখানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে নির্মাণসামগ্রী।
সালেহ উদ্দিন সেনপাড়া পর্বতার আমতলা কাঁচাবাজার এলাকার বাসিন্দা। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘এক মাসের বেশি সময় এলাকার সড়কে খোঁড়াখুঁড়ি চলছে। কারা খুঁড়েছে, কী কাজ হচ্ছে, কত দিন চলবে, এমন কোনো নোটিশ দেখিনি। শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, সিটি করপোরেশন পানির নালা বসাচ্ছে।’
মোহাম্মদপুর, লালমাটিয়া, মিরপুর ও দক্ষিণখান ঘুরে দেখা যায়, এসব এলাকার বিভিন্ন সড়কে খোঁড়াখুঁড়ি চালাচ্ছে সরকারের বিভিন্ন সংস্থা। কোনো কোনো সড়ক এক মাসের বেশি খুঁড়ে রাখা হয়েছে। পথচারীদের চলতে কষ্ট হচ্ছে। উত্তোলন করা মাটি না সরানোয় চারদিকে ধুলার ছড়াছড়ি। যেখানে–সেখানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে নির্মাণসামগ্রী।
উত্তরার দক্ষিণখানের প্রধান সড়কটি কার্যত তিন মাস বন্ধ। ঢাকা বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশন–সংলগ্ন কসাইবাড়ি রেলগেট থেকে দক্ষিণখান হয়ে কাঁচকুড়া পর্যন্ত সাত কিলোমিটার সড়কে যানবাহন চলছে না। দেখা গেছে, নতুন সড়ক নির্মাণ ও সংস্কারের জন্য দক্ষিণখানের প্রধান সড়কটির অন্তত পাঁচ জায়গায় খনন করা হয়েছে। কিন্তু নির্মাণকাজ সেভাবে এগোচ্ছে না। দেড় মাস আগে এ সড়কের প্রেমবাগান থেকে গাওয়াইর পর্যন্ত যতটুকু সংস্কারকাজ হয়, গতকালও তা একই অবস্থায় থাকতে দেখা গেছে।
জাতীয় সংসদের ঢাকা-১৮ আসনের মধ্যে পড়েছে এ এলাকা। স্থানীয় সংসদ সদস্য মো. খসরু চৌধুরী গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, রাস্তাঘাটের উন্নয়নকাজ একেবারেই ধীর। মূল সড়ক খোঁড়া, অলিগলির সড়ক দিয়েও গাড়ি চলতে পারছে না। সামনে বর্ষা, এটি বিবেচনায় নিয়ে কাজের গতি কয়েক গুণ বাড়াতে হবে। না হয় আরও দুর্ভোগ বাড়বে।
কারা, কেন খুঁড়ছে জানাই কষ্টের
নীতিমালায় বলা আছে, জনগণের সুবিধার্থে খননকাজ শুরুর অন্তত তিন দিন আগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি দিতে হবে। এলাকায় মাইকিং ও প্রচারপত্র বিলি করতে হবে। তাতে খননকারী সংস্থার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার নাম, মুঠোফোন নম্বর ও যোগাযোগের ঠিকানা উল্লেখ থাকবে। কাজের উদ্দেশ্য, খনন শুরু ও শেষ করার তারিখসহ সাইনবোর্ড টানাতে হবে।
সড়কে কাজ চলছে এমন এলাকার ১০ জন বাসিন্দার সঙ্গে কথা হয়। তাঁরা সবাই বলেন, সরকারের কোন সংস্থা খোঁড়াখুঁড়ি চালায়, তা জানার সুযোগ তাঁদের থাকে না। কোনো নোটিশ বা বিজ্ঞপ্তি দেয় না সংস্থাগুলো। খনন এলাকা ঘিরেও রাখা হয় না। অনেক সময় খনন বিষয়ে কোনো কথা বলার থাকলেও সংশ্লিষ্ট কাউকে খুঁজে পাওয়া যায় না।
বর্তমানে রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে যেসব সংস্থার খোঁড়াখুঁড়ি চলছে সেসবের একটি ঢাকা ওয়াসা। অন্তত ১৪টি এলাকায় সংস্থাটির ‘ঢাকা পানি সরবরাহ নেটওয়ার্ক উন্নয়ন প্রকল্প’–এর কাজ চলছে। এলাকাগুলোর মধ্যে রয়েছে শ্যামপুর, জুরাইন, মিরপুরের বড়বাগ, রূপনগর, মানিকনগর, পল্লবী, পীরেরবাগ ও আগারগাঁও। একাধিকবার সময় ও ব্যয় বাড়লেও এখন পর্যন্ত এ প্রকল্পের অগ্রগতি ৭৮ শতাংশ। ৩ হাজার ৯৮০ কোটি টাকার প্রকল্পটি শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০২১ সালের ডিসেম্বরে।
প্রকল্পটির পরিচালক মো. ওয়াজ উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, নীতিমালা মেনে কাজ করতে ঠিকাদারদের বারবার নির্দেশনা দেওয়া হয়। তারপরও সব ক্ষেত্রে নীতিমালা মানা সম্ভব হয় না। অনেক ক্ষেত্রে একটি সড়কের অর্ধেক খনন করার ছয় মাস বা বছরখানেক পর খোঁড়ার অনুমতি দেয় সিটি করপোরেশন। কিন্তু লোকজন ওয়াসাকে গালমন্দ করে।
পাঁচ বছর পেরোলেও নেই অগ্রগতি
নীতিমালা অনুযায়ী, সড়ক খোঁড়াখুঁড়ির অনুমতি দেওয়া থেকে শুরু করে প্রতিটি বিষয় তদারক ও বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে সমন্বয় করবে ‘ওয়ানস্টপ সমন্বয় সেল’। সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর প্রতিনিধিদের নিয়ে ১৩ সদস্যের এই সেল হবে। সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এর সভাপতি আর প্রধান প্রকৌশলী হবেন সদস্যসচিব।
সিটি করপোরেশন এলাকায় কোনো সংস্থা বা ব্যক্তি সড়ক খুঁড়তে চাইলে তা আগে করপোরেশনের আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তাকে জানাতে হয়। ওয়ানস্টপ সমন্বয় সেলের অনুমোদন ছাড়া কোনো প্রধান সড়কে খোঁড়াখুঁড়ি করা যায় না। কোনো সংস্থা বা ব্যক্তি বিনা অনুমতিতে সড়ক খুঁড়লে মূল ক্ষতির পাঁচ গুণ জরিমানা আদায় করতে পারে সিটি করপোরেশন। তবে সড়ক খননের জন্য কাউকে জরিমানা করা হয়েছে, এমন ঘটনা জানা যায় না।
এ ব্যাপারে ঢাকা উত্তর সিটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মীর খায়রুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, নীতিমালা না মেনে খনন করলে সংশ্লিষ্ট সংস্থার মাধ্যমে ঠিকাদারকে সতর্ক করা হয়। জরুরি প্রয়োজনে সিটি করপোরেশন নিজেও মাটি অপসারণের মতো কাজ করতে পারে। সে ক্ষেত্রে ওই সংস্থার জামানতের টাকা থেকে তা সমন্বয় করা হয়।
নীতিমালায় আরও বলা হয়েছে, সড়ক খননের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব সংস্থাকে দীর্ঘমেয়াদি মহাপরিকল্পনা তৈরি করতে হবে এবং তা সিটি করপোরেশনকে দিতে হবে। আর বছরের খনন পরিকল্পনা এপ্রিল মাসের মধ্যে দিতে হবে। আধুনিক জরিপ পদ্ধতিতে সড়কের নিচে পানি, গ্যাস, বিদ্যুৎ ও অপটিক্যাল কেব্লের মতো পরিষেবার নকশা প্রণয়ন করতে হবে। তবে নীতিমালা প্রণয়নের পাঁচ বছর পেরোলেও এসব ক্ষেত্রে অগ্রগতি নেই।
সড়ক খনন নীতিমালাটি কাগজে-কলমে থাকলেও এর বাস্তবায়ন নেই বলে মনে করেন নগরবিদদের সংগঠন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি আদিল মুহাম্মদ খান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটির প্রতিপালন হলে সড়ক খোঁড়াখুঁড়িতে জনগণের যে ভোগান্তি, তা কমত। আজ পর্যন্ত শুনিনি যে সড়ক খননে নৈরাজ্য বন্ধে কোনো প্রকল্প পরিচালক বা ঠিকাদারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। ঠিকাদারেরা রাজনৈতিক মদদপুষ্ট হওয়ায় তাঁদের প্রশ্ন করতেও ভয় পায় (কর্তৃপক্ষ)।’
এই নগরবিদ বলেন, একটি শহরে আদর্শ খননকাজের মোটামুটি সবকিছুই নীতিমালায় রয়েছে। জনগণের দুর্ভোগ কমাতে এটির দ্রুত বাস্তবায়ন জরুরি।