রাজধানীতেও হচ্ছে বাল্যবিবাহ, নজর নেই প্রশাসনের

রাজধানীর কড়াইলের কিশোরী মিষ্টি বাল্যবিবাহের শিকার হওয়ার পর (ছদ্মনাম) স্কুল থেকে ঝরে পড়েছেছবি: প্রথম আলো

রাজধানীর বনানী পেরিয়ে কড়াইল যাওয়া মানে যেন ‘দরজা খুলে ভিন্ন জগতে’ প্রবেশ করা, ঝকঝকে পাকা ভবন আর প্রশস্ত মসৃণ সড়ক থেকে একঝটকায় ভাঙা সরু রাস্তা আর ঘিঞ্জি টিনের সারিবদ্ধ ঘরের সামনে চলে যাওয়া। উচ্চ ও নিম্নবিত্তের মানুষের জীবনযাপনের বিভাজন রেখাটা সেখানে দাগ টেনে দেওয়ার মতোই স্পষ্ট।

‘দাগের’ ওপারে ঘিঞ্জি এলাকার বাসিন্দারা শোভন–সুরক্ষিত জীবনের সুযোগ পান না। তেমনই একজন ১৫ বছর বয়সী কিশোরী মিষ্টি (ছদ্মনাম)। গত ৮ মাস ধরে সে স্কুলে যায় না। বাল্যবিবাহের পর গর্ভধারণ, গর্ভপাত, নির্যাতনের মুখে সংসার ছেড়ে চলে আসা—এমন ঝড়-ঝাপটায় মিষ্টি স্কুল থেকে ঝরে পড়েছে।

খোদ রাজধানীতে মিষ্টির মতো পিছিয়ে পড়া পরিবারের মেয়েরা বাল্যবিবাহের শিকার হচ্ছে। শুধু দুটি এলাকা ঘুরে ৯টি বাল্যবিবাহ ও দুটি বাল্যবিবাহ প্রতিরোধের তথ্য পাওয়া গেছে। ঢাকার বাইরে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে প্রশাসনিক কিছু উদ্যোগ থাকলেও মেগাসিটি বিবেচনায় রাজধানীতে বাল্যবিবাহ একরকম প্রশাসনের অন্তরালে থেকে যাচ্ছে। এখানে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে ওয়ার্ডভিত্তিক কোনো কমিটি নেই। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনেও নজরের বাইরে থেকে যাচ্ছে বাল্যবিবাহ।

কড়াইলে জালের মতো ছড়িয়ে থাকা অলিগলি পেরিয়ে পৌঁছাতে হয় জামাই বাজারে মিষ্টিদের (ছদ্মনাম) বাসায়। একজন যেতে পারে এমন সরু রেলিংবিহীন সিঁড়ি বেয়ে উঠলে মিষ্টিদের এক কক্ষের টিনের ভাড়া বাসা। দুই বোন, এক ভাইয়ের মধ্যে মিষ্টি ছোট। মা–বাবা দুজনই বনানীর একটি বাসায় নিরাপত্তাকর্মী ও গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করেন।

রাজধানীতে বাল্যবিবাহের একটি চিত্র পাওয়া যায় বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ‘স্মল এরিয়া এস্টিমেশন’ প্রতিবেদন থেকে। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে বাল্যবিবাহের প্রবণতা নিয়ে এ বছরের এপ্রিল মাসে প্রকাশিত ওই প্রতিবেদন অনুসারে, ঢাকা জেলায় বাল্যবিবাহের হার ৪১ শতাংশ। ঢাকার বনানী থানার অধীন এলাকায় এটি ৫৪ শতাংশের বেশি। কড়াইল বনানী থানার অন্তর্গত।

ছেলেদের বাল্যবিবাহের সুনির্দিষ্ট হিসাব পাওয়া না গেলেও বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস ২০২৩–এর প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, শহরাঞ্চলে প্রতি হাজারে ৭৩টি মেয়ে ও ১৪টি ছেলে ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সের মধ্যে বিয়ে করছে।

বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টের (ব্লাস্ট) ‘জেন্ডার ন্যায়বিচার ও নারীর ক্ষমতায়ন’ বিভাগের কর্মসূচি–বিশেষজ্ঞ প্রমা ইসরাত প্রথম আলোকে বলেন, সেফ প্লাস নামে একটি প্রকল্পের অধীন ব্লাস্ট ঢাকার কড়াইল, গোপীবাগ, ভাষানটেক এবং দিনাজপুর, খুলনা ও পটুয়াখালীতে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে সচেতনতা সৃষ্টি, আইনি সহায়তা দেওয়া ও গবেষণার কাজ করছে। ঢাকায় ৭ হাজার ২০০ ঘর পরিদর্শন করা হয়েছে। সেখানে অনেক বাল্যবিবাহের কথা জানা গেছে। সংখ্যা সংকলনের কাজ চলছে।

বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে ঢাকায় প্রশাসনের উদ্যোগে কোনো সক্রিয় কমিটি পাওয়া যায়নি। দারিদ্র্য, মেয়েদের সুরক্ষা ও নিরাপত্তার অভাব থেকে বাল্যবিবাহের ঘটনা ঘটছে।
প্রমা ইসরাত, ব্লাস্টের কর্মসূচি–বিশেষজ্ঞ

প্রমা ইসরাত বলেন, বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে ঢাকায় প্রশাসনের উদ্যোগে কোনো সক্রিয় কমিটি তাঁরা পাননি। দারিদ্র্য, মেয়েদের সুরক্ষা ও নিরাপত্তার অভাব থেকে বাল্যবিবাহের ঘটনা ঘটছে। যে মেয়েরা নিজেরা বাল্যবিবাহ করছে, তারাও নিরাপত্তাহীনতার বোধ থেকেই করছে।

বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপ (বিডিএইচএস) ২০২২ প্রতিবেদন অনুসারে, দেশে ১৮ বছরের কম বয়সী মেয়েদের বাল্যবিবাহের হার ৫০ শতাংশ।

মিষ্টিদের বাল্যবিবাহ ও ঝরে পড়া

বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে প্রচার প্রতীকী ছবি

কড়াইলের ভেতর জালের মতো ছড়িয়ে থাকা অলিগলি পেরিয়ে পৌঁছাতে হয় জামাই বাজারে মিষ্টিদের বাসায়। একজন যেতে পারে এমন সরু রেলিংবিহীন সিঁড়ি বেয়ে উঠলে মিষ্টিদের এক কক্ষের টিনের ভাড়া বাসা। দুই বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে মিষ্টি ছোট। বাবা-মা দুজনই বনানীর একটি বাসায় নিরাপত্তাকর্মী ও গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করেন।

গত শনিবার (২৬ অক্টোবর) মিষ্টিদের বাসায় গিয়ে কথা হয় তার সঙ্গে। সে কমিউনিটি বিদ্যালয় বিদ্যাসাগর মডেল স্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্রী ছিল। বনানী সুপারমার্কেটের এক দোকানকর্মীর (১৯) সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল তার। এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে ছেলেটি তাকে গাজীপুরে নিয়ে বিয়ে করেছে। বিয়েতে ছেলের মা–বাবা উপস্থিত ছিলেন, মিষ্টির কেউ ছিলেন না।

বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন ২০১৭ অনুসারে, ১৮ বছরের নিচের বয়সী মেয়ে ও ২১ বছরের নিচের বয়সী ছেলের বিয়ে হলে তা বাল্যবিবাহ। আইন অনুসারে, বাল্যবিবাহ করা, সম্পাদন ও পরিচালনার জন্য সর্বোচ্চ দুই বছরের কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। ১৯ ধারায় বিশেষ বিধান অনুসারে, বিশেষ প্রেক্ষাপটে অপ্রাপ্তবয়স্কের সর্বোত্তম স্বার্থে, আদালতের নির্দেশ এবং মা-বাবা কিংবা প্রযোজ্য ক্ষেত্রে অভিভাবকের সম্মতিতে বাল্যবিবাহ হলে অপরাধ বলে গণ্য হবে না।

বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন, ২০১৭–এর ১৯ ধারার বিশেষ বিধান অনুযায়ী, বিশেষ প্রেক্ষাপটে অপ্রাপ্তবয়স্কের সর্বোত্তম স্বার্থে, আদালতের নির্দেশ এবং মা-বাবা কিংবা প্রযোজ্য ক্ষেত্রে অভিভাবকের সম্মতিতে বাল্যবিবাহ হলে অপরাধ বলে গণ্য হবে না।

কিশোরীর বাবার অভিযোগ, কাবিননামায় যে কাজীর নাম-ঠিকানা দেওয়া, সেখানে গিয়ে তিনি জানতে পারেন, কাজী মৃত। কাজীর ছেলে হৃদয় বাবার নামে বেআইনিভাবে বাল্যবিবাহ পড়িয়েছেন। কিশোরীর বাবা আরও বলেন, গত মাসে বনানী থানায় তিনি অভিযোগ করলে পুলিশ এসে মীমাংসা করার পরামর্শ দেয়।

মিষ্টি জানাল, বিয়ের দুই মাসের মধ্যে সে গর্ভধারণ করে। শাশুড়ি ট্যাবলেট খাইয়ে গর্ভপাত করান। স্বামীও তাকে মারধর করত। তাই চার মাস আগে সে বাবার বাসায় ফিরে এসেছে।

মিষ্টির সহপাঠী শিউলিরও (ছদ্মনাম) বাল্যবিবাহ হয়েছে। মা–বাবা বিয়ে দেওয়ার পর সেও স্কুলে যায় না। মিষ্টির বন্ধু-সহপাঠীর তালিকায় এমন আরও সাতজন রয়েছে।
গত মঙ্গলবার বিদ্যাসাগর মডেল স্কুলে গিয়ে দেখা যায়, টিনের তৈরি শ্রেণিকক্ষে শিশুরা পড়ছে। শারমীন সুলতানা নামে এক শিক্ষক জানান, কখন যে অভিভাবকেরা বিয়ে দিয়ে দেন, তা তাঁরা জানতেও পারেন না।

অষ্টম ও নবম শ্রেণির আটটি মেয়ের নাম ধরে বাল্যবিবাহ ও স্কুল থেকে ঝরে পড়ার বিষয়ে জানতে চাইলে স্কুলটির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও শিক্ষক মো.শাহীন মৃধা পাঁচটি মেয়ের বিষয়ে এ ঘটনা নিশ্চিত করেন। অপর তিন মেয়ের মধ্যে দুজনের ব্যাপারে তিনি বলেন, মা-বাবা আর পড়াবেন না বলে তাদের স্কুল থেকে নিয়ে গেছেন। তাদের বাল্যবিবাহ হয়েছে কি না, তাঁর জানা নেই। আর আরেকটি মেয়ে এ স্কুলের নয়।

রাজধানীর কড়াইলের বিদ্যাসাগর মডেল স্কুল। স্কুলের শিক্ষকেরা বলছেন, কখন অভিভাবকেরা বাল্যবিবাহ দিচ্ছেন তা তারা জানতেও পারছেন না
ছবি: প্রথম আলো

শাহীন মৃধা বলেন, শিক্ষা ও সচেতনতার অভাবে বাল্যবিবাহের ক্ষতিকর দিক নিয়ে কড়াইলের বাসিন্দাদের কোনো চিন্তা-ভাবনা নেই। কড়াইলে মোট ১৪টি স্কুল আছে। সব স্কুলেই কম-বেশি বাল্যবিবাহের ঘটনা ঘটছে। অষ্টম ও নবম শ্রেণির কিশোরী আর শ্রমজীবী কিশোরদের মধ্যে এ হার বেশি।

কড়াইলের সাততলা এলাকায় ব্লাস্টের কিশোর-কিশোরী দলের সদস্য ছিল সাথি (ছদ্মনাম)। মহাখালী মডেল স্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্রী সাথির আগস্ট মাসে বাল্যবিবাহ হয়েছে।

বিয়ের জন্য উৎপাতের অভিযোগ

ব্লাস্টের প্যারালিগ্যাল সদস্য কড়াইলের বাসিন্দা হালিমা খাতুন প্রথম আলোকে বলেন, অনেক মেয়েকে গ্রামে নিয়ে বিয়ে দেওয়া হচ্ছে। সেপ্টেম্বরে সাততলা এলাকার ষষ্ঠ শ্রেণির এক ছাত্রীকে (১৩) ‘ফুসলিয়ে’ বাল্যবিবাহ দেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল। পরে তাঁদের প্রচেষ্টায় তা প্রতিরোধ হয়।

মেয়েটির বড় বোন প্রথম আলোকে বলেন, সে গ্রামের কলেজে ভর্তি হয়েছে। বাবার সেলুনের দোকান, মা পোশাককর্মী। বাসায় কেউ না থাকার সুযোগে তাঁর বোনকে এলাকার এক ছেলে পরিবারের সহায়তায় বিয়ে করার চেষ্টা করে। তিনি বলেন, ‘আমার বোন এত ছোট! ও এখনো মাসিকই ভালোভাবে বোঝে না। ওকে কীভাবে বিয়ে দিই আমরা? ছেলেটিও ছোট। ওষুধের দোকানে কাজ করে।’

মেয়েটির বোন আরও বলেন, ছেলের পরিবারের উৎপাতে তাঁর বোনকে এক আত্মীয়ের বাসায় রাখা হয়েছে। বনানী থানায় ছেলের বিরুদ্ধে জিডি করা হয়েছে।

আরও পড়ুন

এদিকে ছেলের পরিবারের অভিযোগ, মেয়ের পরিবার তাঁদের হুমকি দিচ্ছে। তাঁরাও পাল্টা জিডি করেছেন।  

মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ‘নারী নির্যাতন প্রতিরোধকল্পে মাল্টি সেক্টোরাল প্রোগ্রাম’ এর প্রকল্প পরিচালক যুগ্ম সচিব প্রকাশ কান্তি চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ঢাকায় বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে ওয়ার্ডভিত্তিক কোনো কমিটি না থাকায় মেয়েরা বেশি ঝুঁকিতে পড়েছে। এ বিষয়কে আমলে নিয়ে ওয়ার্ডভিত্তিক কমিটি চালুর বিষয়ে এ মাসের শেষে আলোচনা করতে যাচ্ছে মন্ত্রণালয়।

এদিকে, মিষ্টি বুঝতে পেরেছে, বাল্যবিবাহ তার জীবন এলোমেলো করে দিয়েছে। নতুন বছরে আবার স্কুলে ফিরতে চায় সে।

আরও পড়ুন