‘মা কথাটি ছোট্ট অতি কিন্তু যেন ভাই, ইহার চেয়ে নাম যে মধুর ত্রিভুবনে নাই।’ কবি কাজী কাদের নেওয়াজের এই কথাই অনুরণিত হলো অনুষ্ঠানে উপস্থিত বক্তাদের কথায়। সমাজে নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত সন্তানদের মায়েদের দেওয়া ‘গরবিনী মা সম্মাননা’ প্রদান অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়েছিলেন তাঁরা। বিভিন্ন ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলা এই সন্তানদের সাফল্যের পেছনে মায়ের শ্রম, ঘাম, প্রেরণা ও ভালোবাসা কীভাবে পথ দেখিয়েছে, সেই বিবরণ তুলে ধরলেন তাঁরা।
আজ রোববার রাজধানীর একটি মিলনায়তনে ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল আয়োজিত গরবিনী মা-২০২৪ সম্মাননা অনুষ্ঠানে ১১ জন মাকে সম্মাননা জানানো হয়। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক জানান, প্রায় ৭৫ বছর আগে তিনি মাকে হারিয়েছেন। সে সময় ছবি তোলার কোনো সুযোগ ছিল না। তাই মা কেমন ছিলেন, তা তিনি জানেন না। শুধু বাবার কাছে শুনেছেন, তবে তাঁর সঙ্গে মায়ের দোয়া আছে। মায়ের প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন মন্ত্রী মোজাম্মেল হক। আফসোস করে তিনি বলেন, পরিবারগুলোতে এখন আর আগের মতো পারিবারিক বন্ধন দেখেন না। সবার প্রতি মা ও দেশকে ভালোবাসার আহ্বান জানান তিনি।
সম্মাননা পেলেন যে মায়েরা
ঢাকার বিশেষ জজ (সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ) শেখ হাফিজুর রহমানের মা সাহারা রহমান, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস লিমিটেডের পরিচালক (যুগ্ম সচিব) হায়াত-উদ-দৌলা খানের মা সাজেদা খাতুন, যশোরের পুলিশ সুপার (অতিরিক্ত ডিআইজি পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত) প্রলয় কুমার জোয়ারদারের মা সুরুচি জোয়ারদার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক সামসাদ মর্তুজার মা সৈয়দা নাসরিন মর্তুজা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) মেডিসিন বিভাগের ডিন অধ্যাপক আবু নাসার রিজভীর মা নাফিজা বেগম, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) প্রধান নগর-পরিকল্পনাবিদ মো. আশরাফুল ইসলামের মা হোসনে আরা, প্রথম আলোর চিফ ডিজিটাল বিজনেস অফিসার জাবেদ সুলতানের মা জেবুননেছা, সংগীতশিল্পী তাহসান রহমান খানের মা অধ্যাপক জেড এন তাহমিদা বেগম, অভিনেতা শতাব্দী ওয়াদুদের মা আফরোজা নাছরীন, অভিনেত্রী মেহজাবীন চৌধুরীর মা গাজালা চৌধুরী এবং ব্র্যাক ব্যাংক-প্রথম আলো ট্রাস্ট অদম্য মেধাবী তহবিল থেকে শিক্ষাবৃত্তিপ্রাপ্ত ও নার্স লাবণী আক্তারের মা বেবি বেগম। অনুষ্ঠানে উপস্থিত মায়েদের হাতে সম্মাননা তুলে দেন অতিথিরা।
সম্মাননা পাওয়া মায়েদের সন্তানেরা মা সম্পর্কে তাঁদের অনুভূতি তুলে ধরেন। ঢাকার বিশেষ জজ (সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ) শেখ হাফিজুর রহমান জানান, তাঁর মায়ের ইচ্ছা ছিল, তিনি ব্যাংকের ম্যানেজার হবেন। কিন্তু সংসারের চাপে নিজের ইচ্ছে পূরণ হয়নি। কিন্তু সন্তানদের তিনি সফল হিসেবে গড়ে তুলেছেন। মায়েদের প্রতি আরও সদয় হওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক সামসাদ মর্তুজা বলেন, প্রত্যেক মা-ই বাস্তব জীবনের নায়ক। দেশের নামকরা চিকিৎসক অধ্যাপক আবু নাসার রিজভী জানান, চিকিৎসক হওয়ার কোনো ইচ্ছাই ছিল না তাঁর। কিন্তু মা তাঁর পেছনে লেগেছিলেন। তিনি বলেন, এখনকার প্রজন্মের অনেকের হয়তো বাবা-মায়েদের সিদ্ধান্ত পছন্দ হবে না। কিন্তু জীবনের কোনো একপর্যায়ে গিয়ে মনে হবে, তাঁদের প্রতিটি সিদ্ধান্তই সঠিক ছিল। রাজউকের প্রধান নগর-পরিকল্পনাবিদ মো. আশরাফুল ইসলাম বলেন, মায়েদের প্রতি কৃতজ্ঞতা কখনোই শেষ হওয়ার নয়।
চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় এসে লাক্স-চ্যানেল আই সুপারস্টার প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার সময় মা গাজালা চৌধুরীর সংগ্রামের কথা বলতে গিয়ে কেঁদে ফেলেন অভিনেত্রী মেহজাবীন চৌধুরী। তিনি বলেন, আসলে সন্তানেরা নয়, মায়েরাই সফল।
সংগীতশিল্পী তাহসান রহমান খানের মা অসুস্থ থাকায় অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে পারেননি। তাহসান মায়ের বক্তব্য পড়ে শোনান। মাকে নিয়ে এই শিল্পী বলেন, মা যখন অসুস্থ হন, তখন অর্থ, বিত্ত, যশ, খ্যাতি নগণ্য হয়ে যায়। মাকে জড়িয়ে ধরে ভালোবাসি বলতে পারা অমূল্য।
সম্মাননা পাওয়া অন্য সন্তানেরাও সমাজে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পেছনে মায়েদের সংগ্রাম ও অবদানের কথা তুলে ধরেন। তাঁরা বলেন, মা শব্দটি ছোট হলেও এর অনুভূতি সাগরের সমান। মানুষ হয়তো তাঁর জীবনে সবচেয়ে বেশি মা শব্দটি উচ্চারণ করে থাকেন। কেউ জানান, মা হচ্ছেন ঝগড়া করার বড় সঙ্গী। কেউ কেউ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে প্রথমবারের মতো মাকে ভালোবাসি বলেন।
সভাপতির বক্তব্যে ইউনিভার্সেল মেডিকেলের চেয়ারম্যান প্রীতি চক্রবর্তী বলেন, সন্তানেরা যেন মায়েদের মানসিক অবস্থা বুঝতে পারেন। মাকে ছাড়া সংসার চিন্তা কার যায় না।
অনুষ্ঠানের শুরুতে স্বাগত বক্তব্য দেন হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও গরবিনী মা সম্মাননা আয়োজনের প্রধান উদ্যোক্তা আশীষ কুমার চক্রবর্তী। এ ছাড়া আরও বক্তব্য দেন সংসদ সদস্য আরমা দত্ত ও ফেরদৌস আহমেদ।