ঢাকায় গাউছিয়ার মতো বিপণিবিতানসহ ২ হাজার ৬০০ ভবনে অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি
পরিদর্শন করে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকাটি তৈরি করা হয়েছে। সতর্ক করে চিঠি দিলেও দেখা যায়, ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।
ঢাকার গাউছিয়া মার্কেটটি নারীদের কাছে জনপ্রিয় বিপণিবিতান। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ সেখানে কেনাকাটা করতে যান। অথচ তাঁরা জানেন না বিপণিবিতানটি আগুনের অতি ঝুঁকিপূর্ণ তালিকায় রয়েছে।
গাউছিয়ার উল্টো দিকে ঢাকা নিউ সুপার মার্কেট (দক্ষিণ)। গাউছিয়া ও ঢাকা নিউ সুপার মার্কেটকে ২০১৯ সালে অগ্নিনিরাপত্তার দিক দিয়ে অতি ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করে একাধিকবার নোটিশ দিয়েছিল ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর। তবে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এর মধ্যে গত বছরের এপ্রিলে আগুন লাগে ঢাকা নিউ সুপার মার্কেটে।
ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা বলছেন, গাউছিয়ায় আগুন লাগলে ভেতর থেকে মানুষের বের হওয়া কঠিন হবে। ফলে হতাহতের বড় আশঙ্কা রয়েছে।
ফায়ার সার্ভিসের হালনাগাদ তথ্য বলছে, এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১ হাজার ১০৬টি বিপণিবিতান। তালিকায় রয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, আবাসিক ভবন ও গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের ভবন।
গাউছিয়ার মতো রাজধানীর ২ হাজার ৬০৩টি ভবন অগ্নিঝুঁকিতে রয়েছে। ফায়ার সার্ভিসের হালনাগাদ তথ্য বলছে, এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১ হাজার ১০৬টি বিপণিবিতান। তালিকায় রয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, আবাসিক ভবন ও গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের ভবন।
২০১৮ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত পরিদর্শন করে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের এই তালিকা তৈরি করা হয়। ফায়ার সার্ভিস ঢাকার সব ভবন পরিদর্শন করতে পারেনি। ফলে রাজধানীতে মোট কত ভবন ঝুঁকিপূর্ণ, তা জানা সম্ভব নয়। পরিদর্শনে ফায়ার সার্ভিস অগ্নিঝুঁকির দিক দিয়ে দুটি শ্রেণিতে ভবনগুলোকে ভাগ করে—ঝুঁকিপূর্ণ ও অতি ঝুঁকিপূর্ণ। সংস্থাটির হিসাবে, ২ হাজার ৬০৩টি ভবনের মধ্যে কটি অতি ঝুঁকিপূর্ণ, তা তাৎক্ষণিকভাবে হিসাব করে জানাতে পারেননি ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা।
ফায়ার সার্ভিস ২০২৩ সালে ৫৮টি বিপণিবিতান পরিদর্শন করে। সংস্থাটি বলছে, সবগুলোতেই কমবেশি ঝুঁকি পাওয়া গেছে। ঝুঁকিপূর্ণ পাওয়া গেছে ৩৫টি, মাঝারি ঝুঁকিপূর্ণ পাওয়া গেছে ১৪টি এবং অতি ঝুঁকিপূর্ণ পাওয়া গেছে ৯টি বিপণিবিতান। তার মধ্যে একটি গাউছিয়া।
ফায়ার সার্ভিস গত বছরের যে সময়ে গাউছিয়া মার্কেট পরিদর্শন করেছে, তখন বিপণিবিতানটির দোকান মালিক সমিতির সভাপতি ছিলেন রফিকুল ইসলাম। জানতে চাইলে তিনি এ বিষয়ে কোনো কথা বলতে চাননি।
২০২৩ সালের এপ্রিলে বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স ও ঢাকা নিউ সুপার মার্কেটে অগ্নিকাণ্ডের পর ফায়ার সার্ভিস রাজধানীর বিপণিবিতানগুলো নতুন করে পরিদর্শন শুরু করে। কর্মকর্তারা বলছেন, তাঁরা গাউছিয়া গিয়ে দেখেন অতি ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণার চার বছর পরও কোনো ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। পরে তাঁরা আবারও চিঠি দেন, সতর্ক করেন। কিন্তু এক বছরে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
গাউছিয়া মার্কেট পরিদর্শনে যাওয়া ফায়ার সার্ভিসের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, সেখানে আগুন লাগলে তা নেভানোর জন্য পানি পাওয়া কঠিন হবে। কারণ, আশপাশে পানির উৎস নেই। ভবনের সামনের দিক ছাড়া অন্য তিন দিক দিয়ে আগুন নেভানোর চেষ্টা করার মতো জায়গা নেই। ভবনটিতে প্রতিটি দোকানের সামনে মালামাল রাখা হয়। সিঁড়িতেও বসানো হয়েছে দোকান। বৈদ্যুতিক তার ও মিটারগুলো অরক্ষিত।
ফায়ার সার্ভিস গত বছরের যে সময়ে গাউছিয়া মার্কেট পরিদর্শন করেছে, তখন বিপণিবিতানটির দোকান মালিক সমিতির সভাপতি ছিলেন রফিকুল ইসলাম। জানতে চাইলে তিনি এ বিষয়ে কোনো কথা বলতে চাননি।
সেখানে আগুন লাগলে তা নেভানোর জন্য পানি পাওয়া কঠিন হবে। কারণ, আশপাশে পানির উৎস নেই। ভবনের সামনের দিক ছাড়া অন্য তিন দিক দিয়ে আগুন নেভানোর চেষ্টা করার মতো জায়গা নেই। ভবনটিতে প্রতিটি দোকানের সামনে মালামাল রাখা হয়। সিঁড়িতেও বসানো হয়েছে দোকান। বৈদ্যুতিক তার ও মিটারগুলো অরক্ষিত।ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তা
বিপণিবিতানটির দোকানমালিক সমিতির বর্তমান সভাপতি ফরিদ উদ্দিন আহমেদও বিষয়টি নিয়ে কোনো মন্তব্য করেননি। তিনি বলেন, কমিটি বিষয়টি বলতে পারবে। তিনি কিছু জানেন না।
গাউছিয়ায় তুলনামূলক কম দামে মেয়েদের পোশাক ও পোশাক তৈরির উপকরণ পাওয়া যায়। সেখানে নিয়মিত কেনাকাটা করতে যান পোশাক বিপণনকারী একটি প্রতিষ্ঠানের নারী কর্মী তাকিয়া সুলতানা। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বিপণিবিতানটির সামনে বা কোথাও তিনি অগ্নিদুর্ঘটনার ঝুঁকির বিষয়ে সতর্কবার্তা দেখেননি। দেখলে অন্য কোথাও গিয়ে কেনাকাটার চিন্তা করতেন।
ফায়ার সার্ভিস বলছে, ভবন নির্মাণের পর অধিকাংশ মালিক বা কর্তৃপক্ষ ফায়ার লাইসেন্সের জন্য আবেদন করেন না। ভবন নির্মাণের আগে অগ্নিনিরাপত্তার জন্য যে পরিকল্পনা করা হয়, পরে সেটি বাস্তবায়ন করা হয় না বলেই লাইসেন্সের জন্য আবেদন করেন না।
ফায়ার সার্ভিস কী করে
রাজধানীতে অগ্নিদুর্ঘটনার ঝুঁকির বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় এসেছে বেইলি রোডে গ্রিন কোজি কটেজ নামের একটি ভবনে আগুনে ৪৬ জনের মৃত্যুর পর। গত বৃহস্পতিবার রাতের এই আগুনে আটতলা ভবনটির একাংশ পুড়ে গেছে। মারা যাওয়া নারী, শিশু ও পুরুষেরা বেশির ভাগই ওই ভবনে থাকা রেস্তোরাঁয় খেতে গিয়েছিলেন।
অগ্নিঝুঁকি কমাতে অগ্নিপ্রতিরোধ ও নির্বাপণ নামে ২০০৩ সালে একটি আইন করা হয়। ওই আইন বলা হয়েছে, ঢাকা মহানগরে বহুতল ভবন নির্মাণে ফায়ার সার্ভিস থেকে অনাপত্তির ছাড়পত্র নিতে হয়। ভবনের সামনে সড়কের প্রশস্ততা, নকশা অনুসারে ভবনের অগ্নিনিরাপত্তা পরিকল্পনা, ভবন থেকে বের হওয়ার বিকল্প পথ, কাছাকাছি পানির সংস্থান, গাড়ি ঢুকতে পারবে কি না—এসব বিষয় পর্যবেক্ষণ করে ছাড়পত্রটি দেয় ফায়ার সার্ভিস। তারপর এই ছাড়পত্র দেখিয়ে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) থেকে ভবনের নকশার অনুমোদন নিয়ে নির্মাণকাজ শুরু করতে হয়।
অবশ্য ফায়ার সার্ভিস বলছে, ভবন নির্মাণের পর অধিকাংশ মালিক বা কর্তৃপক্ষ ফায়ার লাইসেন্সের জন্য আবেদন করেন না। ভবন নির্মাণের আগে অগ্নিনিরাপত্তার জন্য যে পরিকল্পনা করা হয়, পরে সেটি বাস্তবায়ন করা হয় না বলেই লাইসেন্সের জন্য আবেদন করেন না।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের পরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, কোন কোন কারণে ভবনটি অগ্নিঝুঁকিতে আছে, সেটি পরিদর্শনের পর ভবনমালিককে জানানো হয়। সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য লিখিত আকারে মালিককে বলা হয়। তারপরও কেউ অগ্নিঝুঁকি মোকাবিলায় ব্যবস্থা না নিলে চিঠি দিয়ে সতর্ক করা হয়। চিঠি দেওয়া ছাড়া কার্যত কোনো কার্যকর কোনো ব্যবস্থা তাঁরা নিতে পারেন না।
আইন অনুযায়ী, প্রতিবছর ফায়ার লাইসেন্স নবায়ন করতে হয়। গত বছর ফায়ার লাইসেন্স নবায়ন করেছে ১৭ হাজার ৮৬১টি ভবন কর্তৃপক্ষ। আর নতুন করে লাইসেন্স নিয়েছে ৭ হাজার ১৪১টি প্রতিষ্ঠান।
ঢাকায় মোট কত ভবন রয়েছে, তার কোনো হিসাব নেই। তবে রাজউকের বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনার (ড্যাপ) আওতায় পরিচালিত এক জরিপ অনুযায়ী, ২০১৬ সালে মোট স্থাপনার সংখ্যা দাঁড়ায় ২১ লাখ ৪৭ হাজার ১৭৪টিতে। তখন ছয়তলার ওপরে ভবনের সংখ্যা ছিল ১৬ হাজার ৯৩০; যা মোট স্থাপনার শূন্য দশমিক ৭৯ শতাংশ।
কেউ অগ্নিঝুঁকি মোকাবিলায় ব্যবস্থা না নিলে চিঠি দিয়ে সতর্ক করা হয়। চিঠি দেওয়া ছাড়া কার্যত কোনো কার্যকর কোনো ব্যবস্থা তাঁরা নিতে পারেন না।ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের পরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী
সতর্কতা আমলে নেওয়া হয় না
ঢাকার শ্যামলীর একটি বহুতল (২১ তলা) ভবনে গত বছর আগুন লাগে। ওই আগুনে একজনের মৃত্যু হয়। ভবনটির নাম না জানিয়ে ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা বলেন, এই ঘটনার দুদিন পর ভবনটি পরিদর্শন করে মতামত দেন যে সেখানে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা কার্যকর ছিল না। ভবন কর্তৃপক্ষকে একটি অগ্নিনিরাপত্তা পরিকল্পনা তৈরি করে বাস্তবায়ন করতে বলা হয়। এখন পর্যন্ত ওই ভবনে অগ্নিনিরাপত্তা পরিকল্পনা তৈরি এবং বাস্তবায়নে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। ভবনটিতে একাধিক হাসপাতাল ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে।
ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক তাজুল ইসলাম চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ভবন পরিদর্শনের পর অতি ঝুঁকিতে থাকা স্থাপনার সামনে সতর্কবার্তা টানিয়ে দেওয়া হয়। তবে তা খুলে ফেলা হয়।
বিপণিবিতানটি নতুন করে তৈরি করা হয়েছে। তৈরি করার সময়ই অগ্নিনিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিষয়ে তেমন ব্যবস্থা রাখা হয়নি। এ কারণে অগ্নিঝুঁকি মোকাবিলায় ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয়নি।বিপণিবিতানের দোকানমালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আব্বাস উদ্দিন
অতি ঝুঁকিপূর্ণ বিপণিবিতান
২০২৩ সালে যে ৫৮টি বিপণিবিতান ফায়ার সার্ভিস পরিদর্শন করেছিল, তার মধ্যে গাউছিয়া ছাড়াও ঢাকায় আটটি বিপণিবিতান রয়েছে অতি ঝুঁকিপূর্ণ তালিকায়। সেগুলো হলো ফুলবাড়িয়ার বরিশাল প্লাজা, পুরান ঢাকার টিকাটুলীর রাজধানী–নিউ রাজধানী সুপারমার্কেট, লালবাগের আলাউদ্দিন মার্কেট, চকবাজারের শহীদুল্লাহ মার্কেট ও শাকিল আনোয়ার টাওয়ার, সদরঘাটের শরীফ মার্কেট ও মায়াকাটারা (২২ মার্কেট) এবং সিদ্দিক বাজারের রোজলীন ভিসতা।
ঢাকার সিদ্দিক বাজারের রোজলীন ভিসতা নামে বিপণিবিতানটি ফায়ার সার্ভিস গত বছরের এপ্রিলে পরিদর্শন করে। তখন ভবনটিকে অতি ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করা হয়। তখন ওই বিপণিবিতানের দোকানমালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন আব্বাস উদ্দিন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বিপণিবিতানটি নতুন করে তৈরি করা হয়েছে। তৈরি করার সময়ই অগ্নিনিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিষয়ে তেমন ব্যবস্থা রাখা হয়নি। এ কারণে অগ্নিঝুঁকি মোকাবিলায় ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয়নি।
ফায়ার সার্ভিস বলছে, এর বাইরে ঢাকায় আরও অতিঝুঁকিপূর্ণ বিপণিবিতান রয়েছে।
‘মানুষের জীবন আগে’
ঢাকায় অগ্নিকাণ্ড ও বিস্ফোরণে মৃত্যুর ঘটনা বাড়ছে। প্রতিটি ঘটনার পরই বেরিয়ে আসছে গাফিলতি ও তদারকির অভাবের চিত্র। ঝুঁকি সম্পর্ক না জেনে মানুষ খেতে গিয়ে, কেনাকাটা করতে গিয়ে, ভবনে ভাড়া থাকতে গিয়ে মৃত্যুঝুঁকিতে পড়ছেন, মারা যাচ্ছেন।
বেইলি রোডের আগুনে মেয়ে, মেয়ের জামাই ও চার বছর বয়সী নাতনিকে হারিয়েছেন মুক্তার হোসেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, মানুষের জীবন আগে। ঝুঁকি দূর করতে মালিকপক্ষকে পদক্ষেপ নিতে হবে। নইলে সরকারের উচিত ভবনগুলো গুঁড়িয়ে দেওয়া।