মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার মৃত্যুবার্ষিকীতে রাজধানীতে স্মরণসভা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের বকুলতলায় পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির প্রতিষ্ঠাতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার (জেএএসএস) স্মরণসভায় তাঁর ছবিতে শ্রদ্ধা জানানো হয়ছবি: মাওরুমের সৌজন্যে

পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (জেএএসএস) প্রতিষ্ঠাতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার (এম এন লারমা) ৪১তম মৃত্যুবার্ষিকীতে স্মরণসভা হলো রাজধানীতে। গতকাল রোববার এ উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের বকুলতলায় অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়। মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার ৪১তম মৃত্যুবার্ষিকী পালন জাতীয় কমিটি এ আয়োজন করে। অনুষ্ঠানে শ্রদ্ধা নিবেদন, স্মরণসভা, প্রতিবাদী গান ও প্রদীপ প্রজ্বালন করা হয়।

মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার ৪১তম মৃত্যুবার্ষিকী পালন জাতীয় কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার ৪১তম মৃত্যুবার্ষিকী পালন জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক এবং এলআরডির নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা।

স্মরণসভার শুরুতে প্রয়াত নেতার প্রতিকৃতিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। শ্রদ্ধা নিবেদন করেন মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার ৪১তম মৃত্যুবার্ষিকী পালন জাতীয় কমিটি, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, বাংলাদেশ জাসদ, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়িন, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলন, পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ, বাংলাদেশ মারমা স্টুডেন্টস কাউন্সিল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জুম সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সংসদ, বাংলাদেশ গারো ছাত্র সংগঠন, এএলআরডি, কাপেং ফাউন্ডেশন, বনফুল আদিবাসী গ্রিনহার্ট কলেজসহ বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতারা।

স্মরণসভায় মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার স্মরণে শোকপ্রস্তাব পাঠ করেন মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার ৪১তম মৃত্যুবার্ষিকী পালন জাতীয় কমিটির সদস্য হেলেনা তালাং হিরামণ। তিনি মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমাসহ তাঁর সঙ্গে প্রয়াত বাকি আট সহযোদ্ধার প্রতিও বিনম্র শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন।

স্মরণসভায় স্বাগত বক্তব্য দেন মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার ৪১তম মৃত্যুবার্ষিকী পালন জাতীয় কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক অজয় প্রকাশ চাকমা। তিনি বলেন, মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা ছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের একজন সাহসী সংসদ সদস্য। তিনি সংসদে দাঁড়িয়ে শোষিত ও নিপীড়িত মানুষের কথা বলেছিলেন। বলেছিলেন, মানুষের জন্যই রাষ্ট্র। মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা মৃত্যুহীন প্রাণ নিয়ে এসেছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রামের শোষিত মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য।

স্মরণসভায় বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের সম্পাদক বজলুর রশীদ ফিরোজ বলেন, মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা ছাত্রজীবন থেকেই বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এবং পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর অধিকার আদায়ে সচেষ্ট ছিলেন। তিনি শুধু পাহাড়ি জনগণের নেতা ছিলেন না, তিনি সারা বাংলাদেশের শোষিত ও নিপীড়িত মানুষের কথা বলে গোটা বাংলাদেশের নেতা হিসেবে অধিষ্ঠিত হন।

স্মরণসভায় বাংলাদেশ জাসদের সভাপতি শরীফ নূরুল আম্বিয়া বলেন, মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা সমগ্র বাংলাদেশের একজন অন্যতম নেতা। তাঁর সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনের চিন্তাচেতনা আলোচনা না করে বাংলাদেশ গঠনের চিন্তা করা উচিত হবে না।

পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির কেন্দ্রীয় সদস্য কে এস মং বলেন, ‘সমতল অঞ্চলের বাস্তবতার সঙ্গে পাহাড়ের বাস্তবতার মধ্যে এখনো যথেষ্ট ফারাক রয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে দীর্ঘ সময় ধরে লড়াই করে চলেছে। খন্দকার মোশতাক ব্যতীত দেশের সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে দীর্ঘ ২৬ বার বৈঠকের মাধ্যমেই পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসীদের পক্ষে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলেও সত্য, অনেক রাজনৈতিক দলও সব বিষয় বিবেচনা না করে পার্বত্য চুক্তিকে আওয়ামী লীগের সঙ্গে চুক্তি বলে অপপ্রচার শুরু করেছে। এ অপপ্রচারের বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই করতে হবে।’

বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার স্মরণ শুধু ব্যক্তি লারমাকে স্মরণ করার জন্য নয়, এটি তাঁর চিন্তা ও আদর্শকে তুলে ধরার জন্য।

মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার (জেএএসএস) স্মরণসভায় তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানান অনুষ্ঠানের অতিথিরা
ছবি: মাওরুমের সৌজন্যে

বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার সারা হোসেন বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার কমিশনগুলোয় মুসলমান ভিন্ন অন্য কোনো ধর্মের প্রতিনিধি নেই, ক্ষুদ্র জাতিসত্তার প্রতিনিধি নেই। সংস্কার কমিটিতে বিভিন্নজনের নাম শোনা গেলেও কোনো এক কারণে তাঁদের অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে না। কেন, কীভাবে সংস্কার কমিটিগুলো হচ্ছে, এ ব্যাপারে আমাদের প্রশ্ন করতে হবে।’

সারা হোসেন আরও বলেন, দেশের সংবাদপত্র ও মিডিয়ায় পার্বত্য চট্টগ্রামের বিষয়গুলো উঠে আসে না। বিশেষ করে, সেখানকার মানুষদের ওপর নিপীড়ন ও বৈষম্যের চিত্রগুলো উঠে আসে না। ক্ষুদ্র জাতিসত্তার অধিবাসীদের ওপর ঐতিহাসিকভাবে চলে আসা শোষণ-নিপীড়নগুলো আরও বেশি মিডিয়ায় আসা উচিত।

অনুষ্ঠানের সভাপতি ও এএলআরডির নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা বলেন, ‘আমরা এক ক্রান্তিকালের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। জুলাই–আগস্টের গণ–অভ্যুত্থানের মাধ্যমে নতুন বাংলাদেশের তরুণসমাজ যে বৈষম্যহীন সমাজ বিনির্মাণের স্বপ্ন দেখছে, তা অবশ্যই আশাব্যঞ্জক। পাশাপাশি মহান মুক্তিযুদ্ধের যে চেতনা, তাকেও ভুলে গেলে চলবে না।’

সভাপতির বক্তব্য শেষে প্রয়াত নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার স্মরণে প্রদীপ প্রজ্বালন করা হয়। প্রদীপ প্রজ্বালন শেষে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার স্মরণে বিপ্লবী গানের আয়োজন করা হয়। অংশগ্রহণ করে স্বপ্নবাজ ও সমগীত।

মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা ১৯৩৯ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর রাঙামাটির নান্যেচরের মাওরুম গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।