দাবদাহের বিপদে রাজধানীর ৯০% এলাকা
রাজধানীর শাহবাগ, রমনা পার্ক, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বসবাসকারীরা এই গ্রীষ্মে তুলনামূলক কম বিপদে আছেন। কারণ, ঢাকার মধ্যে এসব এলাকায় উষ্ণতার মাত্রা সবচেয়ে কম। রাজধানীর মধ্যে সবচেয়ে উষ্ণ এখন কামরাঙ্গীরচর ও আদাবর এলাকা। এ ছাড়া ধানমন্ডি এলাকায়ও উষ্ণতার মাত্রা তীব্র হয়ে উঠেছে। সব মিলিয়ে উত্তর ও দক্ষিণ ঢাকা সিটি করপোরেশনের ৯০ শতাংশ এলাকা তীব্র তাপপ্রবাহের বিপদে রয়েছে।
বাংলাদেশ রেডক্রিসেন্ট সোসাইটি থেকে ২৪ এপ্রিল প্রকাশ করা ‘তাপপ্রবাহ: বাংলাদেশ, আগাম সতর্কতা ব্যবস্থা’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। প্রচণ্ড দাবদাহের এ পরিস্থিতিতে দরিদ্র মানুষের বিপদগুলো চিহ্নিত করতে এই সমীক্ষা প্রতিবেদন ও কর্মপরিকল্পনা তৈরি করেছে সংস্থাটি।
সাধারণ মানুষের জন্য প্রতিটি রাস্তার মোড়ে খাওয়ার পানির ব্যবস্থা করা; মানুষ যাতে টানা আধা ঘণ্টার বেশি তপ্ত রোদের নিচে না থাকেন, সেই পরামর্শ দেওয়া; রিকশাচালক বা শ্রমজীবী মানুষের জন্য ছায়ার ব্যবস্থা করা দরকার।আইনুন নিশাত, ইমেরিটাস অধ্যাপক, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়
কোন এলাকায় তাপমাত্রা কেমন, তা চিহ্নিত করার পাশাপাশি মূলত চারটি সূচক আমলে নিয়ে একটি মানচিত্র তৈরি করেছে সংস্থাটি। উষ্ণতার মানচিত্রটি গতকাল রোববার হালনাগাদ করা হয়েছে। তাপমাত্রা, জনসংখ্যার ঘনত্ব, দরিদ্র মানুষের উপস্থিতি এবং ঘনবসতির পরিমাণ ও বস্তির সংখ্যা বিবেচনায় নিয়ে সমীক্ষাটি করা হয়েছে।
বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির মহাসচিব কাজী শফিকুল আজম প্রথম আলোকে বলেন, গ্রীষ্মকালে প্রাকৃতিক কারণেই বেশি গরম থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু কয়েক বছর ধরে রাজধানীসহ সারা দেশে তীব্র উষ্ণতা মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাপনকে বাধাগ্রস্ত করছে। নাগরিকদের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে, কমছে কর্মক্ষমতা। তিনি বলেন, ‘সাধারণ নাগরিকেরা বিশেষ করে দরিদ্র মানুষ কী ধরনের গরমের ঝুঁকির মধ্যে আছেন, তা চিহ্নিত করতে আমরা সমীক্ষাটি করেছি।’
নগরবিদ ও পরিবেশবিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজধানীর ৯০ শতাংশ এলাকা গ্রীষ্মকালের প্রায় পুরোটা সময় উষ্ণ বা তাপীয় দ্বীপে পরিণত হচ্ছে। ঢাকার পরিকল্পিত আবাসিক এলাকা উত্তরা, মিরপুর ও ধানমন্ডিতেও একই ধরনের উষ্ণতার বিপদ তৈরি হয়েছে। অল্প জায়গায় বিপুলসংখ্যক মানুষের বসতি, অতিমাত্রায় শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের ব্যবহার, গাছপালা ও জলাভূমি না থাকা এবং রাজধানী শহরের বেশির বাভ জায়গা কংক্রিটের স্থাপনা দিয়ে আচ্ছাদিত হয়ে যাওয়ার কারণে অতি উষ্ণতার ঝুঁকি বছর বছর বাড়ছে।
সাধারণ নাগরিকেরা বিশেষ করে দরিদ্র মানুষ কী ধরনের গরমের ঝুঁকির মধ্যে আছেন, তা চিহ্নিত করতে আমরা সমীক্ষাটি করেছিবাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির মহাসচিব কাজী শফিকুল আজম
সমীক্ষায় বলা হয়েছে, কামরাঙ্গীরচর ও আদাবরের তাপমাত্রা এতটাই বেশি যে সেখানে ঘরের বাইরে বের হয়ে অল্প সময় অবস্থান করলেই নানা ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। এসব এলাকার রিকশাচালক, ভ্যানচালক, হকার, নির্মাণশ্রমিক ও নিম্নআয়ের মানুষের আয় কমে যাচ্ছে। তাঁরা স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে কম কাজ করতে পারছেন। দাবদাহের কারণে রোগবালাই বেড়ে দরিদ্র মানুষের চিকিৎসা ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে।
রাজধানীর বাণিজ্যিক এলাকার মধ্যে মতিঝিল, ফার্মগেট, মহাখালী, কারওয়ান বাজার ও গুলশান এলাকায় উষ্ণতা মাত্রাতিরিক্ত অবস্থায় পৌঁছেছে। কিন্তু এসব এলাকার বাণিজ্যিক ভবনগুলোতে শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের ব্যবহারের কারণে ভেতরে অবস্থান করা মানুষ কম ঝুঁকিতে আছেন। তবে ভবনগুলোর বাইরে বা সড়ক এবং উন্মুক্ত স্থানে উষ্ণতা আরও বেড়ে যাচ্ছে এসব ভবনের শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের কারণে।
উষ্ণতার বিপদে থাকা এলাকাগুলো হচ্ছে কামরাঙ্গীরচর, মিরপুর, গাবতলী, গোড়ান, বাসাবো, টঙ্গী, শহীদনগর, বাবুবাজার, জুরাইন, হাজারীবাগ, পোস্তগোলা, যাত্রাবাড়ী, তেজকুনীপাড়া, নাখালপাড়া, সায়েদাবাদ, কুর্মিটোলা, আজমপুর, কামারপাড়া, মোহাম্মদপুর, আদাবর ও মহাখালী।
কোন কোন এলাকায় বিপদ বেশি
গত বছরের অতি উষ্ণ পরিস্থিতির পর রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি, বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর এবং ক্লাইমেট সেন্টার যৌথভাবে ঢাকা শহরের উষ্ণতার বিপদ নিয়ে এই সমীক্ষা করে।
সমীক্ষা অনুযায়ী, উষ্ণতার বিপদে থাকা এলাকাগুলো হচ্ছে কামরাঙ্গীরচর, মিরপুর, গাবতলী, গোড়ান, বাসাবো, টঙ্গী, শহীদনগর, বাবুবাজার, জুরাইন, হাজারীবাগ, পোস্তগোলা, যাত্রাবাড়ী, তেজকুনীপাড়া, নাখালপাড়া, সায়েদাবাদ, কুর্মিটোলা, আজমপুর, কামারপাড়া, মোহাম্মদপুর, আদাবর ও মহাখালী। গ্রীষ্মের পুরো সময়জুড়ে এসব এলাকা তাপপ্রবাহের বিপদে থাকছে।
তবে শাহবাগ, রমনা পার্ক, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও আশপাশের এলাকায় উষ্ণতার বিপদ কম। এমন কম ঝুঁকির অন্য এলাকাগুলোর মধ্যে রয়েছে উত্তরখান, খিলক্ষেত ও ডেমরা। এসব এলাকার অনেক জায়গায় এখনো ঘনবসতি তৈরি হয়নি। এ ছাড়া এসব এলাকায় এখনো কিছু গাছপালা ও জলাভূমি রয়েছে।
সমীক্ষা দলের অন্যতম প্রধান ও বাংলাদেশ রেডক্রিসেন্ট সোসাইটির সহকারী পরিচালক মো. শাহজাহান প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশে অন্যান্য দুর্যোগের মতো তাপপ্রবাহ বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি তৈরি শুরু করেছে। এমনি মানুষের মৃত্যুও ঘটছে। ফলে এই বিপদকে দুর্যোগ হিসেবে ঘোষণা দিয়ে সব সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার উচিত গরমে কষ্টে ভোগা মানুষের পাশে দাঁড়ানো।
আমরা উষ্ণ এলাকাগুলোতে পানি ছিটিয়ে কিছুটা স্বস্তি আনার চেষ্টা করছি। একই সঙ্গে দরিদ্র মানুষদের ছাতা ও পানির বোতল দেওয়ার কাজ শুরু করেছি। আর দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ হিসেবে গাছ লাগানো শুরু করেছিঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম
উষ্ণতার বিপদে কারা
ঢাকার উষ্ণতা নিয়ে গত বছর একই গবেষক দল আরেকটি সমীক্ষা প্রতিবেদন তৈরি করে। এতে বলা হয়েছে, শহরে জমে থাকা ২ দশমিক ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা প্রাকৃতিক তাপমাত্রার সঙ্গে যোগ হয়। সবচেয়ে বেশি উষ্ণ সময় থাকছে দুপুর ১২টা থেকে বেলা ৩টা পর্যন্ত। এই সময়টাতে শ্রমজীবী মানুষেরা কাজ কমিয়ে দিতে বাধ্য হন। বিশেষ করে ভ্যান ও রিকশাচালকেরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন।
সমীক্ষায় দেখা যায়, ওই সময়ে খাওয়ার স্যালাইনের বিক্রি সাধারণ সময়ের চেয়ে তিন গুণ বেড়ে যায়। শিক্ষার্থীদের মধ্যে গরমে মাথা ঘোরা, বমি ও ঠান্ডা-কাশির সমস্যা বেড়ে যায়। ডায়রিয়া ও কলেরার প্রাদুর্ভাবও বেড়ে যায়। ২০২৩ সালের মার্চ থেকে জুনের মধ্যে করা ওই জরিপে প্রায় ৮৭ শতাংশ উত্তরদাতা এর আগের বছরের চেয়ে বেশি গরম অনুভব করছেন বলে জানিয়েছেন। একজন রিকশাচালক স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় এই সময়ে দুই থেকে তিন ঘণ্টা রিকশা কম চালান। এর ফলে তাঁর আয়ও কমে যায়।
এ পরিস্থিতিতে মানুষের কষ্ট লাঘবে করণীয় জানতে চাইলে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা উষ্ণ এলাকাগুলোতে পানি ছিটিয়ে কিছুটা স্বস্তি আনার চেষ্টা করছি। একই সঙ্গে দরিদ্র মানুষদের ছাতা ও পানির বোতল দেওয়ার কাজ শুরু করেছি। আর দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ হিসেবে গাছ লাগানো শুরু করেছি।’
বাংলাদেশ রেডক্রিসেন্ট সোসাইটির সমীক্ষায় আরও বলা হয়, গ্রীষ্মকালে গরম ও অসুস্থতার কারণে রিকশাচালকেরা মাসে গড়ে ছয় দিনের বেশি সময় কাজে যেতে পারেন না। এ ছাড়া প্রতিদিন গড়ে স্বাভাবিকের চেয়ে প্রায় তিন ঘণ্টা কম কাজ করতে পারেন। ৮৩ শতাংশ রিকশাচালক জানিয়েছেন, গরমের সময়ে তাঁদের স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় অন্য সময়ের তুলনায় মাসে ৫৩৫ টাকা বেড়ে যায়। একইভাবে হকার, নির্মাণশ্রমিক, দিনমজুর ও নিম্নআয়ের মানুষেরা কম কাজ করতে পারছেন। এতে তাঁদের আয় কমে যাচ্ছে।
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক আইনুন নিশাত প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঢাকাসহ বড় শহরগুলোতে গ্রামের তুলনায় গরম অনেক বেশি। এ পরিস্থিতিতে শিশুদের স্কুল বন্ধ রাখা উচিত ছিল। ছোটবেলায় আমরা এই গরমে গ্রীষ্মকালীন ছুটি পেতাম। আর এখন এই গরমের ঝুঁকির মধ্যে শিশুদের ঠেলে দেওয়া অন্যায় হচ্ছে।’
সিটি করপোরেশনের রাস্তায় পানি ছিটানো ও গাছ লাগানোর প্রসঙ্গে এই পরিবেশ ও জলবায়ুবিশেষজ্ঞ বলেন, এগুলো না করে উচিত ছিল সাধারণ মানুষের জন্য প্রতিটি রাস্তার মোড়ে খাওয়ার পানির ব্যবস্থা করা; মানুষ যাতে টানা আধা ঘণ্টার বেশি তপ্ত রোদের নিচে না থাকেন, সেই পরামর্শ দেওয়া; রিকশাচালক বা শ্রমজীবী মানুষের জন্য ছায়ার ব্যবস্থা করা। তা না করে যেসব করা হচ্ছে, তা লোকদেখানো। এতে সাধারণ মানুষের কষ্ট কমছে না।