মেলায় ফুরাল ছুটির দিন
এবারের অমর একুশের বইমেলায় সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলো শেষ হলো গতকাল শনিবার। অধিবর্ষ বলে এবার ফেব্রুয়ারিতে বাড়তি এক দিন যোগ হবে, তবে তাতেও মেলা আর সাপ্তাহিক ছুটি দিন পাবে না। আগের দুই দিনের বৃষ্টির পর গতকাল আবহাওয়া ভালো ছিল। বেলা ১১টায় শিশু প্রহর থেকে সারা দিনই মেলায় লোকজনের ধারাবাহিক যাতায়াত অব্যাহত ছিল। দুপুরের পর থেকে ক্রেতাদের উপস্থিতি আর বিক্রিও বেড়েছে।
দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে
শেষ দিনগুলোতে সাধারণত মেলায় বিক্রি বেশি হয়। সময় প্রকাশনের প্রকাশক ফরিদ আহমদ বলেন, সার্বিকভাবে বিবেচনা করলে এবারের মেলা বেশ ভালো হয়েছে। করোনা অতিমারির পর যে বিপর্যস্ত অবস্থা সৃষ্টি হয়েছিল, সেখান থেকে মেলা প্রায় আগের অবস্থায় ফিরেছে। কিন্তু মেলার ব্যবস্থাপনা নিয়ে তিনি সন্তুষ্ট নন। মেলায় কর্তৃপক্ষের কোনো তদারকি দেখা যায়নি, এটা এবারের মেলার সবচেয়ে দুর্বলতার দিক। এই মেলার মান উন্নত করতে হলে যে নীতিমালা আছে, তা যথাযথভাবে অনুসরণ করতে হবে। নীতিমালা লঙ্ঘন করে যারা মেলায় অংশ নিচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক একটি পদক্ষেপও এখন পর্যন্ত নেওয়া হয়নি। আবার স্টল বরাদ্দের ক্ষেত্রে একাডেমি নিজেও নীতিমালা যথাযথভাবে অনুসরণ করতে পারে না। এই দুর্বলতা অবশ্যই কাটাতে হবে।
এ ছাড়া মেলা শেষ হলে সার্বিক বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে নিয়ে বস্তুনিষ্ঠভাবে পর্যালোচনা করে আগামী বছরে মেলার জন্য সুপারিশমালা করতে হবে। আর মেলা শুরুর অন্তত ছয় মাস আগে প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে। এটা না হলে ১৫ দিন আগে স্টল বরাদ্দ দিয়ে মেলার আয়োজন করলে পরিবেশ এর চেয়ে ভালো কিছু হবে না বলে মন্তব্য করলেন ফরিদ আহমদ।
ছোটকাগজের প্রতি অবহেলা
প্রতিবছরই সাহিত্যের ছোটকাগজের স্টলগুলোর প্রতি একাডেমির একরকমের অবহেলা দেখা যায়। জায়গা বরাদ্দ নিয়ে তারা আন্দোলনও করেছে। এবার যদিও সামনের দিকে লিটল ম্যাগাজিন কর্নার করা হয়েছে, কিন্তু তার চেহারা অনেকটা গ্রামীণ হাটের ছাপরার মতো। সেখানে যেতে লোকজনের কোনো আগ্রহই জাগে না। মেলার লিটল ম্যাগাজিনের স্টলের পরিবেশ নিয়ে এই মন্তব্য করলেন কথাশিল্পী মোস্তফা কামাল।
গতকাল সন্ধ্যায় সময় প্রকাশনের স্টলে কথা হচ্ছিল মোস্তফা কামালের সঙ্গে। এখান থেকে এবার এসেছে কারবালার ঘটনা নিয়ে তাঁর নতুন ঐতিহাসিক উপন্যাস কারবালা উপাখ্যান। তিনি বলেন, সাহিত্যের ছোটকাগজের গুরুত্ব অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এখান থেকেই নতুন লেখকেরা মূলধারায় উঠে আসেন। মেলায় সাহিত্যের ছোটকাগজগুলোর প্রতি এই অবহেলা দেখানোটা ঠিক নয়। মেলার সার্বিক অবস্থা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘বাংলা একাডেমি চত্বর থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সরে আসার পর পরিসর বেড়েছে, ক্রেতার উপস্থিতি প্রতিবছরই বাড়ছে, কিন্তু তাদের হাতে মানসম্মত পর্যাপ্ত সৃজন ও মননশীল বই আমরা তুলে দিতে পারছি না, এটা বাস্তবতা।’
নতুন বই
মেলায় গতকাল তথ্যকেন্দ্রে ১৩৮টি নতুন বইয়ের নাম এসেছে। ছুটির দিনের সারা দিনই প্রথমার প্যাভিলিয়নে ক্রেতাদের উপস্থিতি দেখা গেছে। ব্যবস্থাপক জাকির হোসেন জানান, বিক্রি প্রত্যাশামাফিকই হয়েছে। গতকাল গণিত বিষয়ে নতুন বই এসেছে ফারসীম মান্নান মোহাম্মদীর অঙ্ক ও মেজো কাকুর হেঁয়ালি। এ ছাড়া আবুল বাশার অনূদিত মিচিও কাকুর বিজ্ঞানবিষয়ক বই দ্য গড ইকুয়েশন, আনোয়ারা সৈয়দ হকের উপন্যাস বাসিত জীবন, মশিউল আলমের উপন্যাস দ্বিতীয় খুনের কাহিনি, আনিসুর রহমানের গল্প সিসিফাস শ্রম, বদিউল আলম মজুমদারের প্রবন্ধ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের রাজনীতি বইগুলোর বিক্রি ভালো ছিল।
মেলায় অন্য প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সময় এনেছে মুনতাসীর মামুনের প্রবন্ধ কী চেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু, রান্না নিয়ে সাঈদা কামাল সংগৃহীত ও সম্পাদিত বই কবি সুফিয়া কামালের হাতের রান্না, চন্দ্রাবতী একাডেমি এনেছে মুহাম্মদ তওফিকের কাব্য দ্রোহ ও প্রেমের কবিতা, পাঠক সমাবেশ এনেছে পারভেজ হোসেনের গল্পসংগ্রহ, ভাষাচিত্র এনেছে নাহিদ পারভেজের গল্প কী কথা তাহার সাথে, শিশু প্রকাশ এনেছে ডেঙ্গুতে অকালপ্রয়াত শিশু রাইদা গালিবার গল্প আন্ডোরে রাজ্যের কাহিনি, জার্নিম্যান এনেছে মুস্তফা মজিদের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী নিয়ে গবেষণামূলক তিনটি বই গারো, চাকমা এবং রাজবংশী, বেহুলা বাংলা এনেছে সুলতানা কামালের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক বাংলাদেশের প্রথম হাসপাতাল এবং মতিন রায়হানের কাব্য মুহূর্তসংহিতা। জনপ্রিয় এনেছে দিলারা হাফিজের প্রবন্ধ বাংলা কবিতায় উপায় ও উপকরণ।
আজ রোববার মেলা শুরু হবে বেলা তিনটায়। চলবে রাত নয়টা পর্যন্ত।
মাইগ্রেশন অব মেটাফরস্
গ্রাম থেকে শহরে আসা জনগোষ্ঠীর জীবনের গল্প তাদের গানের চর্চার মধ্যে খোঁজার চেষ্টা করেছেন সুমন রহমান তাঁর মাইগ্রেশন অব মেটাফরস্ বইতে। ইউপিএল থেকে প্রকাশিত এই গবেষণামূলক বইতে তিনি দেখিয়েছেন, ভাগ্যবিড়ম্বিত জনগোষ্ঠীর এই শহরে আসার বেদনাত্মক আখ্যান কীভাবে বাংলা গানে ‘আরবান ফোক’ নামের এক রোমাঞ্চকর ধারার জন্ম দিয়েছে। গান এবং গরিবির এই নাগরিক যোগাযোগ সমাজবিজ্ঞান, নৃতত্ত্ব, গণমাধ্যম অধ্যয়ন, নগরায়ণ, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ে আগ্রহী যেকোনো পাঠককে চিন্তার খোরাক জোগাবে। পরিচিত শহুরে বস্তি এবং চেনাশোনা নানান গানের এই যুগলবন্দী নতুন তাৎপর্য নিয়ে হাজির হবে পাঠকের সামনে।
সুমন রহমান বাংলাদেশে ও সিঙ্গাপুরের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০ বছরের বেশি সময় অধ্যাপনা করছেন। এখন অধ্যাপনায় যুক্ত ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশে (ইউল্যাব)। কথাসাহিত্যসহ বিভিন্ন বিষয়ে লেখায় মগ্ন। নিরপরাধ ঘুম গল্পগ্রন্থের জন্য ২০১৮ সালে প্রথম আলোর বর্ষসেরা বইয়ের পুরস্কারসহ বিভিন্ন পুরস্কার পেয়েছেন।