ঢাকায় গ্রেপ্তার ৮৭ শতাংশের রাজনৈতিক পরিচয় নেই

ডিএমপির তথ্য (সোমবার পর্যন্ত)

  • ২৪৩ মামলায় গ্রেপ্তার ২,৬৩০।

  • ২,২৮৪ জনের রাজনৈতিক পরিচয় নেই।

  • বিএনপির নেতা-কর্মী ২৬৯ জন।

  • জামায়াত ও শিবিরের ৭৩ জন।

গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিদের প্রিজন ভ্যানে করে ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত থেকে কারাগারে নেওয়া হচ্ছে। ঢাকা, ২৭ জুলাইছবি: দীপু মালাকার

রাজধানীর ফার্মগেট এলাকায় পিকআপ ট্রাক চালান নাসির উদ্দিন। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে রাজধানীর মিন্টো রোডের ডিবি কার্যালয়ের সামনে তাঁর স্ত্রী বাবলী ছোট ছোট চার কন্যাসন্তান নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। পাশেই অঝোরে কাঁদছিলেন নাসিরের মা রুমেলা আক্তার। তাঁরা জানান, ডিবি পরিচয়ে কয়েকজন গিয়ে বাসা থেকে নাসিরকে তুলে এনেছেন। তাঁরা নাসিরের খোঁজে এসেছেন।

শুধু নাসির নন, রাজধানীতে এখন প্রতিদিনই এমন অসংখ্য স্বজন ভিড় করছেন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) কার্যালয়, বিভিন্ন থানা ও আদালতের সামনে। গতকাল দুপুর ১২টা থেকে বেলা ৩টা পর্যন্ত ডিবি অফিসের সামনে এমন ৯টি পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা হয় প্রথম আলোর। আগের দিনও এমন আরও চারটি পরিবারকে পাওয়া যায় ডিবি কার্যালয়ের ফটকের সামনে। তাঁদের বেশির ভাগই দিনমজুর, শিক্ষার্থী ও ব্যবসায়ীদের স্বজন।

আরও পড়ুন
শ্রমজীবী মানুষ ও শিক্ষার্থীদের খোঁজে প্রতিদিন অসংখ্য স্বজন ভিড় করছেন ডিবি কার্যালয়, থানা ও আদালতের সামনে।

তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেছেন, তাঁরা কোনো নিরপরাধ ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করছেন না। তিনি সচিবালয়ে গতকাল সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, গোয়েন্দা তথ্য ও ভিডিও ফুটেজ এবং সাক্ষীসাবুদ নিয়ে যাদের শনাক্ত করা গেছে, তাদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। ভুলক্রমে যদি কেউ নিয়ে আসে তাহলে থানায় যাচাই করে যাঁদের নিরপরাধ মনে হচ্ছে, তাঁদের ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। কাজেই গণগ্রেপ্তার হচ্ছে না।

ঢাকার আদালত সূত্রে জানা গেছে, কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত ঢাকায় ২৭০টি মামলায় ২ হাজার ৮৯১ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) এক হিসাব বলছে, গত সোমবার পর্যন্ত রাজধানীতে কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে ২৪৩টি মামলায় মোট ২ হাজার ৬৩০ জনকে গ্রেপ্তার করে আদালতে পাঠানো হয়েছে। এর মধ্যে ২ হাজার ২৮৪ জনেরই কোনো রাজনৈতিক পরিচয় পাওয়া যায়নি, যা মোট গ্রেপ্তারের ৮৬ দশমিক ৮৪ শতাংশ। অর্থাৎ কোনো দলের সঙ্গে তাঁদের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তাঁদের বেশির ভাগই শিক্ষার্থী, শ্রমজীবী ও সাধারণ মানুষ।

গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে বিএনপির নেতা-কর্মী আছেন ২৬৯ জন, জামায়াতের ৬৩ এবং শিবিরের আছেন ১০ জন। এ ছাড়া গণ অধিকার পরিষদের ৩ এবং জেপির আছেন ১ জন, যা মোট গ্রেপ্তারের ১৩ দশমিক ১৬ শতাংশ।

বিভিন্ন সংকটের সময় গ্রেপ্তার বাণিজ্যের কথা শুনে এসেছি। আর এখন তো মহাসংকট। এ সময় কে, কখন, কাকে গ্রেপ্তার করল, সেটার যদি তদারকি না থাকে, তাহলে আসলেই সমস্যা।
নূর মোহাম্মদ, সাবেক আইজিপি

কোটা আন্দোলনকালে সহিংসতায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সংশ্লিষ্টতার কথা সরকার ও পুলিশের পক্ষ থেকে বারবার বলা হলেও এত বেশি সংখ্যায় সাধারণ মানুষ গ্রেপ্তার হচ্ছেন কেন? এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (অপরাধ) লিটন কুমার সাহা প্রথম আলোকে বলেন, ‘পুলিশের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে নির্দেশনা রয়েছে সহিংসতা বা অপরাধে জড়ানোর প্রমাণ নেই, এমন একজন নিরীহ মানুষকে যেন হয়রানি করা না হয়। এ বিষয়গুলো আমরা কঠোরভাবে তদারকি করছি। এ জন্য তথ্যপ্রমাণ ছাড়া কাউকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না।’

গ্রেপ্তার হচ্ছেন শ্রমজীবী মানুষ ও পথচারী

উবারে মোটরসাইকেল চালান মোহাম্মদ হাসান। গত শুক্রবার সকালে মোটরসাইকেল নিয়ে ইব্রাহিমপুরের বাসা থেকে বের হওয়ার পর তিনি নিখোঁজ হন। তাঁর খোঁজে গত সোমবার বিকেলে ডিবি কার্যালয়ে এসেছিলেন স্ত্রী নাজমা আক্তার ও শাশুড়ি মার্জিয়া বেগম। কান্নাজড়িত কণ্ঠে মার্জিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘ছেলেটার বাবা-মা জীবিত নাই। অসহায়, এতিম। তাকে আমরা খুঁজে পাচ্ছি না। সে কিছু করেনি। তাকে আন্দাজে পুলিশ ধরে নিয়ে এসেছে।’

আরও পড়ুন

গতকাল ডিবি ফটকে কুলসুমা বেগম নামের এক নারী জানান, তাঁর ছেলে আল-আমিন ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড টেকনোলজিতে (আইইউবিএটি) পড়াশোনা করতেন। বিদেশে যাওয়ার জন্য পাসপোর্ট করার উদ্দেশ্যে গত রোববার বাসা থেকে বের হন। উত্তরার আজমপুর এলাকায় রাজউক কলেজের সামনে পুলিশ তাঁকে আটকে মুঠোফোন তল্লাশি করে কোটা আন্দোলনের কিছু ছবি পায়। পুলিশ তাঁকে উত্তরা পূর্ব থানায় নিয়ে মারধর করে। রাতে তাঁর মা খবর পেয়ে থানায় গেলে বলা হয়, তাঁর ছেলেকে ডিবিতে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু ডিবি ছেলের কোনো তথ্য দিচ্ছে না।

সন্তানকে খুঁজে না পেয়ে গত সোমবার বিকেলে ডিবি কার্যালয়ের সামনে বিলাপ করছিলেন আল আমিন নামের ১৮ বছরের এক তরুণের বাবা-মা। বাবা চান মিয়া বলেন, তাঁর ছেলে এসির দোকানের কাজ করেন। পুলিশ গত সোমবার তাঁকে ধরে নিয়ে গেছে। একনজর দেখার আকুতি জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমার ছেলে প্রশাসনের হেফাজতে আছে নাকি তাকে কেউ গুম করেছে, এটা জানতে চাই।’

আরও পড়ুন

আটকের কারণ জানেন না তাঁরা

মোবাশ্বের আহমেদ নামের এক ব্যক্তিকে খুঁজতে গত সোমবার বিকেলে ডিবি ফটকে এসেছিলেন তাঁর স্ত্রী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার স্বামী কাঁটাবন মসজিদের এতিমখানা ও মাদ্রাসার শিক্ষক। তাঁর সঙ্গে এতিমখানার আরেক শিক্ষক শফিক আহমেদকেও পুলিশ তুলে নিয়ে এসেছে। শুনেছি তাঁরা ডিবি কার্যালয়ে আছেন। কিন্তু পুলিশ স্বীকার করছে না।’

মোবাশ্বের আহমেদ কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জড়িত নন জানিয়ে তাঁর স্ত্রী বলেন, বিনা কারণে তাঁর স্বামীকে ধরে নিয়ে এসেছে।

আরও পড়ুন

এইচএসসি পরীক্ষার্থীকে খুঁজছিলেন মা

এইচএসসি পরীক্ষা চলছে রাজধানীর উদয়ন স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থী সিয়ামুজ্জামান লামের। গত সোমবার বিকেলে ডিবি কার্যালয়ের সামনে কাঁদছিলেন তাঁর মা সালমা বেগম। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘ছেলের এইচএসসি পরীক্ষা চলছিল। বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে সে ঘর থেকে বেরিয়েছিল। এ সময় পুলিশ তাকে ধরে নিয়ে যায়।’ ছেলের খোঁজে তিনি নিউমার্কেট ও ধানমন্ডি থানায় গিয়েছিলেন। পরে ডিবি অফিসে এসেছেন। কিন্তু কোনো খোঁজ পাননি।

আরও পড়ুন

বাসা থেকে নিয়ে আসা হয় বাবা-ছেলেকে

গতকাল উত্তরা পশ্চিম থানাধীন উত্তরা ১৩ নম্বর সেক্টর এলাকা থেকে ডিবি কার্যালয়ের সামনে এসেছিলেন নাসরিন সুলতানা ও তাঁর মেয়ে সুরাইয়া তাসনীম। অপেক্ষার কারণ জানতে চাইলে নাসরিন সুলতানা বলেন, ২৮ জুলাই সন্ধ্যা ছয়টার দিকে তাঁদের বাসায় ৮-১০ জন পুলিশ সদস্য যান। এ সময় তাঁরা জানান, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তাঁর স্বামী খালিদ সাইফুল্লাহ ও ছেলে আহমেদ সামরানের সঙ্গে কথা বলবেন। এ জন্য তাঁদের থানায় যেতে হবে। কথা শেষ হলেই তাঁদের ছেড়ে দেওয়া হবে। এ কথা বলে নিয়ে যাওয়ার পর তাঁদের আর খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না।

পরে খালিদ সাইফুল্লাহকে আদালতে পাঠানো হলেও গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত ছেলের সন্ধান পাওয়া যায়নি। স্বজনেরা জানান, আহমেদ সামরান নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবিএতে পড়েন। সামরানের বাবা ৬৫ বছর বয়সী খালিদ সাইফুল্লাহর সৌদি আরবে ব্যবসা আছে। তিনি বেশির ভাগ সময় সেখানেই থাকেন।

আরও পড়ুন

এসেছেন বিএনপি নেতার স্বজনও

মেডিকেল টেকনোলজিস্ট অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের যুগ্ম মহাসচিব দবির উদ্দিন তুষার ছয় দিন ধরে নিখোঁজ। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে ডিবির ফটকে তাঁর স্ত্রী রেশমা করিম প্রথম আলোকে বলেন, গত বৃহস্পতিবার মিরপুরের রাকিন সিটির বাসা থেকে পুলিশ তাঁকে তুলে নিয়ে যায়। শুরুতে ডিবি পুলিশ বাসায় ঢুকেছিল। পরে কাফরুল থানা থেকে দুজন পুলিশ সদস্য গিয়ে তাঁকে মোটরসাইকেলে তুলে নেন। এরপর থেকে তাঁর আর কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না।

রেশমা বলেন, তাঁর স্বামী বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে তাঁর সমর্থন ছিল। ফেসবুকেও তিনি আন্দোলনের সমর্থনে পোস্ট দিয়েছিলেন। এ জন্য কি তাঁকে এভাবে নিখোঁজ করে রাখা হবে? থানা বলে ডিবি নিয়ে গেছে, আবার ডিবিতে এলে বলে তাদের কাছেও কোনো তথ্য নেই। আদালতেও গিয়েও তাঁর কোনো খোঁজ পাইনি। তাহলে আমার স্বামী কোথায়?’

আরও পড়ুন

রাজনীতির সঙ্গে কোনো ধরনের সংশ্লিষ্টতা নেই, এমন ব্যক্তিদের এত বেশি সংখ্যায় গ্রেপ্তারের কারণ কী হতে পারে, জানতে চাইলে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) নূর মোহাম্মদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিভিন্ন সংকটের সময় গ্রেপ্তার-বাণিজ্যের কথা শুনে এসেছি। আর এখন তো মহাসংকট। এ সময় কে, কখন, কাকে গ্রেপ্তার করল, সেটার যদি তদারকি না থাকে, তাহলে আসলেই সমস্যা।’ তাঁর মতে, যখন গ্রেপ্তারের জন্য পুলিশকে টার্গেট দেওয়া হয়, তখনই এ ধরনের ঘটনা বেশি ঘটে। গ্রেপ্তারগুলো বাণিজ্যে রূপান্তরিত হয়। এ জন্য রাজনৈতিক নেতাদের মতো কথা না বলে পুলিশকে তার কাজের সীমারেখার মধ্যে থেকে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের প্রতিটি বিষয় গুরুত্বসহকারে তদারকি করতে হবে।