বিদ্যুৎ বন্ধের অধিকার কারও নেই, বিশৃঙ্খলা করলে ব্যবস্থা: উপদেষ্টা
দাবিদাওয়া নিয়ে আলোচনার দরজা খোলা আছে বলে জানিয়েছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান। তিনি বলেছেন, বিদ্যুৎ বন্ধের অধিকার কারও নেই। তাঁরা যে কাজটা করেছেন, তা বেআইনি ও গুরুতর অন্যায়। দাবিদাওয়া জানানোর নামে নাশকতামূলক কিছু করা হলে, বিশৃঙ্খলা করলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (আরইবি) বিরুদ্ধে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আন্দোলন ও সৃষ্ট পরিস্থিতি নিয়ে এসব কথা বলেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা। আজ রোববার রাজধানীর একটি হোটেলে আয়োজিত এক সেমিনার শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আন্দোলনে গোটা দেশ বিদ্যুৎহীন হওয়ার ঝুঁকি দেখেন না। এটা যাতে না হয়, তার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করা হবে।
তবে আরইবির বিরুদ্ধে যেসব দুর্নীতির অভিযোগ আছে, সেগুলোর তথ্য-প্রমাণ পেলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন উপদেষ্টা ফাওজুল কবির। তিনি বলেন, ধান কাটার মৌসুমের মতো অনেকেই এখন অনেক দাবি নিয়ে আসছে। দাবি করলেই মেনে নেওয়া হবে, এটা মনে করার কোনো কারণ নেই। আরইবি ও সমিতি আগে থেকেই আলাদা। আর চুক্তিভিত্তিক কর্মী সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে আছে। তবে দাবি বিবেচনায় নেওয়া হবে না, এটাও বলা হয়নি। দাবি জানাতে কোনো বাধা নেই।
বিদ্যুৎ উপদেষ্টা বলেন, তাঁরা (সমিতির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা) উপকেন্দ্র বন্ধ করে দিলেন। এটা তো বাসাবাড়ির সুইচ না যে ইচ্ছা হলেই বন্ধ করে দেবে। আরইবির আইনে এটা জরুরি সেবা হিসেবে স্বীকৃত। তাঁরা বলেছেন, তাঁরা চলে যাবেন। গেলে তো তাঁদের শেষ যাওয়া হবে। সরকারকে অনেকে দুর্বল ভাবে। মনে করে একটা চাপ দেবে, আর সরকার দাবি মেনে নেবে। সরকারকে দুর্বল ভাবার কোনো কারণ নেই। অন্য যেকোনো সরকারের চেয়ে এ সরকার অনেক বেশি শক্তিশালী, জনসমর্থনও বেশি।
আন্দোলনকারীরা নতুন করে কর্মসূচি দিলে কী করবেন, এমন প্রশ্নের জবাবে উপদেষ্টা বলেন, পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির কর্মকর্তারা মনে করেছেন, এটা তাঁদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি। না, এটা সরকারের সম্পত্তি। বিদ্যুৎ সরবরাহ করার দায়িত্ব সরকারের এবং এটা জনগণের সাংবিধানিক অধিকার। এটা নিশ্চিত করতে যা যা করা দরকার, তা–ই করা হবে। উপকেন্দ্রে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে জেলা প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সমিতির কর্মকর্তাদের মধ্যে যাঁরা দায়িত্ব পালন করবেন না, অন্য লোক দেওয়া হবে সেখানে। যাঁরা শৃঙ্খলাবিরোধী কাজ করবেন, তাঁদের শাস্তি দেওয়া হবে।
দুই দফা দাবিতে টানা কয়েক মাস ধরে আন্দোলন করছেন পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এর মধ্যে গত বৃহস্পতিবার তাঁদের ২৪ জন কর্মকর্তাকে চাকরিচ্যুত করেছে আরইবি। প্রতিবাদে দেশের বেশ কিছু জেলায় গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেন আন্দোলনকারীরা। একই সঙ্গে দুজনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। আন্দোলনে যুক্ত কয়েকজনকে আটক করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। পরে ওই দিন সন্ধ্যায় প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মাহফুজ আলমের আশ্বাসে কর্মসূচি স্থগিত করে বিদ্যুৎ সরবরাহ চালু করেন আন্দোলনকারীরা।
জ্বালানি আমদানি অর্থনীতির বড় বোঝা
দেশে ব্যবহৃত প্রাথমিক জ্বালানির প্রায় পুরোটাই গ্যাস, জ্বালানি তেল, কয়লার মতো জীবাশ্ম জ্বালানি। দেশে সম্ভাবনা থাকলেও গ্যাস অনুসন্ধানে ও উৎপাদনে জোর দেওয়া হয়নি। আমদানির দিকে ঝুঁকেছে গত আওয়ামী লীগ সরকার। চড়া দামে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি করা হয়েছে। জ্বালানি খাতে প্রাথমিক জ্বালানি আমদানি অর্থনীতির বড় বোঝা।
‘বাংলাদেশের জন্য টেকসই জ্বালানি’ শীর্ষক সভায় এসব কথা বলেন বক্তারা। ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফআইসিসিআই) এটির আয়োজন করে। এতে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানির খরচ কমানোই সরকারের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার, যাতে এ খাতের ভর্তুকি কমানো যায়। এর জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। নিজস্ব গ্যাস উৎপাদন বাড়াতে চায় সরকার। স্থলভাগে ও সমুদ্রে গ্যাস অনুসন্ধানে জোর দেওয়া হয়েছে।
ভূতত্ত্ববিদ বদরুল ইমাম বলেন, কার্বন নিঃসরণ বিবেচনায় জ্বালানি তেল ও কয়লার চেয়ে গ্যাস ভালো। প্রাকৃতিক গ্যাসের জন্য ভূতাত্ত্বিকভাবে বাংলাদেশ খুবই সম্ভাবনাময়। কিন্তু অনুসন্ধান ও কূপ খননে অনেক পিছিয়ে দেশ। অথচ যথাযথ গ্যাস অনুসন্ধান করা হলে জ্বালানি আমদানির কথা না, বরং গ্যাস রপ্তানিকারক দেশ হওয়ার কথা বাংলাদেশের।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি পরিস্থিতি নিয়ে একটি নিবন্ধ তুলে ধরা হয় সভার শুরুতে। এতে বলা হয়, দিনে এখন গ্যাস উৎপাদন হচ্ছে ২০০ কোটি ঘনফুট। এটি ধরে রাখতে হলে বছরে অন্তত ১০টি নতুন কূপ খনন করতে হবে। তা না হলে প্রতিবছর উৎপাদন কমতে থাকবে। এখন গ্যাসের ২০ শতাংশ আমদানি করা হয়। ২০৩০ সালে আমদানি হবে ৫০ শতাংশ।
নিবন্ধে কিছু সুপারিশ তুলে ধরা হয়। এতে বলা হয়, বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাসের ব্যবহার কমানো উচিত। তারা দামও কম দেয় শিল্পের চেয়ে। বিদেশে বিনিয়োগ করে সার উৎপাদন করা উচিত, সেখানে গ্যাসের দাম কম। শিল্প খাতেও বিকল্প জ্বালানি কয়লা, এলপিজি, তেল, কাঠ ব্যবহার করা যেতে পারে। বাসা ও বাণিজ্যিক খাতে এলপিজি হতে পারে ভালো বিকল্প। গ্যাসের অপব্যবহার কমাতে হবে।
নিবন্ধ উপস্থাপন করেন বুয়েটের সাবেক অধ্যাপক ইজাজ হোসেন। তিনি বলেন, খাদ্যনিরাপত্তা ও জ্বালানিনিরাপত্তা—দুটিই গুরুত্বপূর্ণ। কৃষিজমি ব্যবহার করে সৌরবিদ্যুৎ করা উচিত। দেশে ৫০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব দেশের মোট জমির ১ শতাংশ ব্যবহার করে। পারমাণবিক বিদ্যুৎ আরও করা উচিত। হাইড্রোজেন, অ্যামোনিয়া আমদানি করা যেতে পারে।
নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে জোর দেন ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ইমেরিটাস অধ্যাপক রিজওয়ান খান। তিনি বলেন, এলএনজি আমদানির খরচ হিসাব করা হলে গ্যাস থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ প্রতি ইউনিটে ১০ টাকা ৫০ পয়সা। ফার্নেস তেলে সাড়ে ১৫ টাকা, ডিজেলে ৩৩ টাকা, নিজস্ব কয়লায় সাড়ে ৮ টাকা, জমির খরচ ছাড়া সৌরবিদ্যুৎ সাড়ে ৯ টাকা। জমির খরচসহ ধরলে ১৬ টাকা।
আলোচনা সভায় সূচনা বক্তব্য দেন ফরেন চেম্বারের সভাপতি জাভেদ আখতার। সঞ্চালনা করেন নির্বাহী পরিচালক টি জে এম নূরুল কবির। আর আলোচনা পর্ব সঞ্চালনা করেন জিই ভারনোভা বাংলাদেশের কান্ট্রি ম্যানেজার নওশাদ আলী। এতে আরও বক্তব্য দেন পাক্ষিক এনার্জি অ্যান্ড পাওয়ার পত্রিকার সম্পাদক মোল্লাহ আমজাদ হোসেন।