ইজারার পুরো টাকা না দিয়েই গাবতলী পশুর হাট দখল, হাসিল আদায় ডিপজলের
রাজধানীর ‘গাবতলী গবাদিপশুর হাট’ ইজারার দরপ্রক্রিয়ায় অংশ নিয়ে সর্বোচ্চ দরদাতা নির্বাচিত হয়েছিলেন চলচ্চিত্র প্রযোজক ও অভিনেতা মনোয়ার হোসেন ওরফে ডিপজল। কিন্তু নির্ধারিত সময়ে ইজারামূল্যের পুরো টাকা পরিশোধ করেননি। এরই মধ্যে হাট দখলে নিয়ে তাঁর কর্মীদের দিয়ে হাসিল আদায় করছেন তিনি।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) কর্মকর্তারা বলছেন, পুরো টাকা পরিশোধ না করায় ডিপজলকে এখনো কার্যাদেশ প্রদান ও হাট হস্তান্তর করা হয়নি। তাঁদের দাবি, হাটে করপোরেশনের নিজস্ব কর্মীরা হাসিল আদায় করছেন।
গাবতলী পশুর হাটের ইজারা দিতে (বাংলা ১৪৩১ সনের জন্য) গত ২ ফেব্রুয়ারি বিজ্ঞপ্তি দেয় ডিএনসিসির সম্পত্তি বিভাগ। দরপত্রে অংশ নেওয়া দুই ব্যক্তির মধ্যে ডিপজলের প্রস্তাবিত ইজারামূল্য ছিল সর্বোচ্চ, ১৭ কোটি ১২ লাখ ১৫ হাজার টাকা। আর আগের ইজারাদার লুৎফর রহমান দর দিয়েছিলেন ১৬ কোটি ২০ লাখ টাকা।
হাটের ইজারাসংক্রান্ত কিংবা ডিপজলের টাকা পরিশোধ না করেই হাট দখলে নেওয়ার মতো অনিয়মগুলো লুকাতে সম্পত্তি বিভাগের কর্মকর্তা ও অন্য কর্মীদের রাখঢাক করার বিষয়টি ছিল স্পষ্ট। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক উত্তর সিটির ঊর্ধ্বতন দুই কর্মকর্তা জানান, বিভাগীয় প্রধান হিসেবে মাহে আলমের সুযোগ ছিল ডিপজলের জামানত বাজেয়াপ্ত করে তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার।
দরপত্র যাচাই শেষে সর্বোচ্চ দরদাতা ডিপজলকে ইজারামূল্যের সঙ্গে অন্যান্য ফি পরিশোধ করতে গত ২১ মার্চ চিঠি দেয় ডিএনসিসির সম্পত্তি বিভাগ। চিঠিতে দরপত্রের সঙ্গে জমা দেওয়া জামানতের ৫ কোটি ১৪ লাখ টাকা বাদে আরও ১৭ কোটি ২৬ লাখ ৭৯ হাজার টাকা সাত কার্যদিবসের মধ্যে পরিশোধ করতে বলা হয়।
কিন্তু ডিপজল নির্ধারিত সময়ে পুরো টাকা পরিশোধ না করে গত ৩১ মার্চ উত্তরের মেয়র বরাবর টাকা জমা দেওয়ার সময় বাড়ানোর আবেদন করেন। সময় চান হাট হস্তান্তরের আগের দিন, অর্থাৎ গত ১৩ এপ্রিল পর্যন্ত (চৈত্র মাসের ৩০ তারিখ)। কিন্তু ওই সময়ের মধ্যেও পুরো টাকা পরিশোধে ব্যর্থ হন ডিপজল।
টাকা পরিশোধে ব্যর্থ হলে দরদাতার জামানত বাজেয়াপ্ত করার বিষয় দরপত্র বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ ছিল। বিজ্ঞপ্তির ১২ নম্বরে উল্লেখ আছে, দরপত্র গৃহীত হওয়ার ৭ দিনের মধ্যে দরমূল্য (জামানত বাদে বাকি টাকা), অনুমোদিত দরের ওপর ১৫ শতাংশ মূল্য সংযোজন কর, ১০ শতাংশ আয়কর, ইজারামূল্যের ওপর ৫ শতাংশ জামানত (ফেরতযোগ্য) পে-অর্ডার করে জমা দিতে হবে। ব্যর্থ হলে দরপত্রের সঙ্গে দেওয়া দরমূল্যের ৩০ শতাংশ জামানতের টাকা বাজেয়াপ্ত করা হবে।
করি নাই (টাকা পরিশোধ), করব। এটা আমি সিটি করপোরেশনকে বলব। আপনি কে? আমি টাকা পরিশোধ করি বা করি না, এটা আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার।ডিপজল, চলচ্চিত্র প্রযোজক ও অভিনেতা
সব মিলিয়ে হাটের ইজারা পেতে ডিপজলের পরিশোধ করার প্রয়োজন ছিল ২২ কোটি ৪০ লাখ ৭৯ হাজার টাকা। কিন্তু সিটি করপোরেশন ডিপজলের জামানত বাজেয়াপ্ত করেনি।
হাট দখল করে হাসিল আদায়
গত ২৯ এপ্রিল দুপুরে গাবতলী হাটে গিয়ে দেখা যায়, ডিপজলের নিয়োজিত কর্মীরা হাট পরিচালনা করছেন। পশু কিনতে আসা ব্যবসায়ী, কসাই ও সাধারণ মানুষের কাছ থেকে আদায় করছেন হাসিলের টাকাও। সেখানে করপোরেশনের কর্মীদের কাউকে দায়িত্ব পালন করতে দেখা যায়নি।
হাটের প্রবেশপথে হাসিল আদায় করার নির্মাণাধীন কক্ষের দেয়ালে ছিল একটি ব্যানার টানানো। তাতে লেখা, ইজারাসূত্রে মালিক ‘আলহাজ মনোয়ার হোসেন ডিপজল’। পাশের আরেকটি কক্ষে হাসিল আদায় করছিলেন এক ব্যক্তি।
দেওয়ান মোহাম্মদ ইকরাম হোসেন নামের ওই ব্যক্তি নিজেকে ডিপজলের ভাতিজা বলে পরিচয় দেন। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, হাটের বর্তমান ইজারাদার তাঁর চাচা ডিপজল। সিটি করপোরেশন গত ১৫ এপ্রিল তাঁদের কাছে হাট বুঝিয়ে দিয়েছে। ওই দিন থেকেই তাঁরা হাসিল আদায় করেছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সম্পত্তি বিভাগের একজন কর্মী প্রথম আলোকে জানান, ডিপজলের লোকেরাই হাট চালাচ্ছেন। হাটে হাসিল আদায়ের বিষয়ে তাঁদের কাউকে কোনো নির্দেশ দেওয়া হয়নি।
তথ্য প্রদানে অসহযোগিতা
ইজারার তথ্য জানতে গত বুধবার এই প্রতিবেদক যান উত্তর সিটির প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা মাহে আলমের কাছে। তিনি কোনো তথ্য দিতে রাজি হননি। পরে জনসংযোগ কর্মকর্তা মকবুল হোসাইনের মাধ্যমে লিখিত প্রশ্ন পাঠানো হয়। জনসংযোগ কর্মকর্তাকেও তিনি কোনো তথ্য দেননি।
হাট ইজারা নিতে ডিপজল মোট কত টাকা পরিশোধ করেছেন, কত টাকা এখনো বকেয়া আছে, কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে কি না, কবে হাট বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে, বকেয়া টাকা পরিশোধে কত দিনের সময় দেওয়া হয়েছে—এসব তথ্য জানতে চাওয়া হয়েছিল।
হাটের ইজারাসংক্রান্ত কিংবা ডিপজলের টাকা পরিশোধ না করেই হাট দখলে নেওয়ার মতো অনিয়মগুলো লুকাতে সম্পত্তি বিভাগের কর্মকর্তা ও অন্য কর্মীদের রাখঢাক করার বিষয়টি ছিল স্পষ্ট। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক উত্তর সিটির ঊর্ধ্বতন দুই কর্মকর্তা জানান, বিভাগীয় প্রধান হিসেবে মাহে আলমের সুযোগ ছিল ডিপজলের জামানত বাজেয়াপ্ত করে তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার।
হাট হস্তান্তরে আদালতের নির্দেশ
নির্ধারিত সময়ে ডিপজল পুরো টাকা পরিশোধে ব্যর্থ হলে গত ৪ এপ্রিল ডিএনসিসির মেয়র আতিকুল ইসলাম ও প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা মাহে আলমের কাছে হাট ইজারা নিতে আবেদন করেন দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দরদাতা লুৎফর রহমান। আবেদনে তিনি ডিপজলের দেওয়া সর্বোচ্চ দরটাই পরিশোধ করে ইজারা নেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেন। কিন্তু করপোরেশন থেকে কোনো সাড়া পাননি তিনি।
পরে উচ্চ আদালতে হাটের ইজারা নিয়ে একটি রিট করেন লুৎফর রহমান। গত ২৩ এপ্রিল রিটের নিষ্পত্তি করেন আদালত। আদেশে লুৎফর রহমানকে সর্বোচ্চ দর ১৭ কোটি ১২ লাখ ১৫ হাজার টাকা জমা দেওয়ার অনুমতি দিতে এবং ১৪৩১ সনের জন্য তাঁর কাছে হাটটি হস্তান্তর করতে বলা হয়। রিটের বিবাদী উত্তর সিটির মেয়র, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তাকে এ নির্দেশ দেন আদালত।
লুৎফর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, আদালতের রায়ের অনুলিপি ও হাটের জন্য ব্যাংক পে-অর্ডারের সঙ্গে একটি আবেদন নিয়ে গত ৩০ এপ্রিল তিনি সিটি করপোরেশনে গিয়েছিলেন। মেয়র, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা—কোনো দপ্তরেই তাঁর আবেদন গ্রহণ করা হয়নি।
দেওয়া হয়নি কার্যাদেশ
উত্তর সিটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মীর খায়রুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, ইজারাদারকে এখনো কার্যাদেশ দেওয়া হয়নি। কারণ, কিছু টাকা বাকি আছে। ওই টাকা যত দ্রুত সম্ভব পরিশোধ করতে বলা হয়েছে। অবিলম্বে টাকা জমা না দিলে তাঁকে হাট ইজারা দেওয়ার সিদ্ধান্ত বাতিল করা হবে। হাটটি বর্তমানে খাস আদায় পদ্ধতিতে পরিচালনা করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।
ডিপজলের হাট দখল ও তাঁর কর্মীদের মাধ্যমে পরিচালনা করার বিষয়টি জানানো হলে মীর খায়রুল আলম বলেন, ‘আমাদের লোক হাসিল আদায় করছে। দৈনিক ভিত্তিতে টাকা জমা হচ্ছে। যদি ওই রকম কিছু হয়ে থাকে, তাহলে অবশ্যই বিষয়টি দেখা হবে।’ আদালতের রায়সংক্রান্ত কোনো কাগজ তাঁরা পাননি বলেও জানান তিনি।
এদিকে কার্যাদেশ ছাড়াই হাট দখল ও পরিচালনার বিষয়ে বক্তব্য জানতে গত বৃহস্পতিবার বিকেলে ও সন্ধ্যায় একাধিকবার ডিপজলের মুঠোফোন নম্বরে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। পরিচয় দিয়ে খুদে বার্তাও পাঠানো হয়। পরে প্রতিবেদককে ফোন করে তিনি গতকাল শনিবার এফডিসিতে সরাসরি দেখা করে কথা বলবেন বলে জানান।
গত শুক্রবার সন্ধ্যায় ডিপজলের মুঠোফোনে আবারও বার্তা পাঠিয়ে গতকাল দেখা করার সময় জানতে চাওয়া হয়। তবে কোনো জবাব পাওয়া যায়নি। তাই গতকাল সকাল ১০টার কিছু পর তাঁর মুঠোফোনে কল করে সময় জানতে চান এই প্রতিবেদক। তখন তিনি জানান, এফডিসির সভা স্থগিত করা হয়েছে। তাই তিনি সেখানে যাবেন না।
পরে হাটের বিষয়ে বক্তব্য জানতে চাইলে উত্তেজিত হয়ে ডিপজল বলেন, ‘গাবতলী হাট নিয়ে আপনার কিসের দরকার? সিটি করপোরেশন জানে, আমি দিছি (ইজারার টাকা) কি দেই নাই। আমার টাকা ক্লিয়ার।’ এ সময় উত্তেজিত হয়ে ‘রাখেন টেলিফোন’ বলে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন তিনি।
পুরো বক্তব্য জানতে ডিপজলকে আবার ফোন করা হয়। তখন তিনি বলেন, ‘করি নাই (টাকা পরিশোধ), করব। এটা আমি সিটি করপোরেশনকে বলব। আপনি কে? আমি টাকা পরিশোধ করি বা করি না, এটা আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার।’