ঢাকার ৩ ভবনে বিস্ফোরণ: ৪৪ মৃত্যুর পরও দায়ী হচ্ছে না কেউ
তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এসব ঘটনায় তিতাসের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের গাফিলতি রয়েছে, কিন্তু তাঁদের শনাক্ত করা যাচ্ছে না।
ঢাকার মগবাজার, সিদ্দিকবাজার ও সায়েন্স ল্যাবরেটরি এলাকার তিনটি ভবনে বিস্ফোরণে প্রাণ হারিয়েছিলেন ৪৪ জন। তদন্তকারীদের ভাষ্যমতে, সব কটি বিস্ফোরণই ঘটে পাইপলাইনের ছিদ্র দিয়ে বের হওয়া গ্যাস জমে।
আর এমনটি ঘটেছে তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের গাফিলতির কারণে। কিন্তু এ–সংক্রান্ত মামলায় কাউকেই দায়ী করতে পারছে না পুলিশ। তারা তিনটি মামলারই চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিতে যাচ্ছে বলে জানা গেছে।
যুক্তি হিসেবে তদন্ত–সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, কোন ঘটনায় কে দায়ী, তা শনাক্ত করতে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের কাছে তথ্য চাওয়া হয়েছিল; কিন্তু তারা তথ্য দিচ্ছে না। নথি গায়েব হওয়ার অজুহাত দেখাচ্ছে।
ব্যক্তির দায় নিরূপণ করতে না পারার কারণেই দুই মামলার অভিযোগপত্র জমা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। তিনি বলেন, সংস্থার বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়া যায় না। শেষ পর্যন্ত ব্যক্তির দায় নিরূপণ সম্ভব না হলে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হবে।সিটিটিসির বোমা নিষ্ক্রিয়কারী টিমের প্রধান অতিরিক্ত উপকমিশনার রহমত উল্লাহ চৌধুরী
পুলিশের এমন যুক্তি প্রসঙ্গে আইনজ্ঞরা বলছেন, অবহেলার কারণে এত বড় বড় দুর্ঘটনা এবং এত মানুষের মৃত্যুর ঘটনায় কাউকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো না গেলে এমন ঘটনা ঘটতেই থাকবে।
মগবাজার ও সিদ্দিকবাজারের বিস্ফোরণের ঘটনা দুটি তদন্ত করছে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট। আর সায়েন্স ল্যাবরেটরির ঘটনা তদন্ত করছে নিউমার্কেট থানা-পুলিশ।
মগবাজার ও সিদ্দিকবাজারের মামলার তদন্ত তদারক কর্মকর্তা সিটিটিসির বোমা নিষ্ক্রিয়কারী টিমের প্রধান অতিরিক্ত উপকমিশনার রহমত উল্লাহ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ব্যক্তির দায় নিরূপণ করতে না পারার কারণেই দুই মামলার অভিযোগপত্র জমা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। তিনি বলেন, সংস্থার বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়া যায় না। শেষ পর্যন্ত ব্যক্তির দায় নিরূপণ সম্ভব না হলে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হবে।
সিদ্দিকবাজারে বিস্ফোরণের দুই দিন আগে (৫ মার্চ, ২০২৩) সায়েন্স ল্যাবরেটরি এলাকার শিরিন ভবনের তৃতীয় তলায় বিস্ফোরণ ঘটে। এতে ছয়জনের মৃত্যু হয়। এই মামলার তদন্ত শুরুর পর থানা-পুলিশ ওই ভবনের তৃতীয় তলায় তিতাস গ্যাসের সংযোগ পাইপ পেয়েছে।
পরিত্যক্ত গ্যাস–সংযোগের ছিদ্রে কাঠের টুকরা
গুলিস্তানে বিআরটিসির বাস কাউন্টারের কাছে সিদ্দিকবাজারে কুইন স্যানিটারি মার্কেট হিসেবে পরিচিত সাততলা ভবনে গত ৭ মার্চ বিস্ফোরণ ঘটে। এতে ভবনের বেজমেন্ট, প্রথম ও দ্বিতীয় তলা অনেকটা ধসে যায়। বিস্ফোরণে মারা যান ২৬ জন। ভবনটি পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়েছে।
সিটিটিসি তদন্তকালে ভবনের বেজমেন্টে তিতাসের একটি পরিত্যক্ত বাণিজ্যিক সংযোগের লাইন খুঁজে পায়। দুই যুগের বেশি সময় আগে বেজমেন্টে রান্নাঘর ছিল আর নিচতলায় ছিল রেস্তোঁরা। ২০০১ সালে গ্যাসের ওই লাইনটি রাইজার (গ্যাস সরবরাহের সংযোগস্থল) থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়।তবে লাইন অপসারণ করা হয়নি। সিটিটিসি জানায়, পরিত্যক্ত ওই লাইনের ছিদ্র থেকে বেজমেন্টের শীতাতপনিয়ন্ত্রিত কোনো একটি কক্ষের বদ্ধ জায়গায় গ্যাস জমে বিস্ফোরণ ঘটে। মাটি খুঁড়ে পরিত্যক্ত লাইনটি পরীক্ষা করে দেখা যায়, লাইনে একটি বড় ছিদ্র রয়েছে। কাঠের টুকরা ঢুকিয়ে সেটি বন্ধ করা হয়েছিল, সেখানে মরিচা পড়ে ক্ষয় হয়ে গেছে।
এসব ঘটনার ক্ষেত্রে তিতাসের কোনো দায় নেই। তিতাসের তদন্তে বেরিয়ে এসেছে, গ্রাহকের অবহেলা ও গাফিলতির কারণে দুর্ঘটনাগুলো ঘটেছে।তিতাসের জনসংযোগ কর্মকর্তা আল আমিন
সিটিটিসির একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, কুইন ক্যাফে রেস্তোরাঁর নামে ১৯৮৯ সালে ওই বাণিজ্যিক গ্যাস–সংযোগ নেওয়া হয়েছিল। ২০০০ সালের পর ক্যাফেটি বন্ধ হয়ে যায়। ২০০৪ সালে ওই ভবনে আবাসিক গ্যাস–সংযোগ নেওয়া হয়। মাটি খুঁড়ে দেখা গেছে, পরিত্যক্ত বাণিজ্যিক লাইন থেকেই আবাসিক সংযোগগুলো নেওয়া হয়েছে। বাণিজ্যিক সংযোগে দেড় ইঞ্চি ব্যাসের পাইপ ব্যবহার করা হয়। আর আবাসিক সংযোগে থাকে দশমিক ৭৫ ইঞ্চি ব্যাসের পাইপ। তাই বাণিজ্যিক সংযোগে গ্যাসের চাপ আবাসিক সংযোগের দ্বিগুণ থাকে। এর সঙ্গে দুই দশকের বেশি সময় ধরে গ্যাসের লাইনের ছিদ্র কাঠের টুকরা দিয়ে বন্ধ করে রাখায় ভবনে ঝুঁকির মাত্রা বহুগুণ বেড়ে যায়।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, এক্ষেত্রে তিতাসের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা দায়িত্বে অবহেলার পাশাপাশি অন্যায় করেছেন। প্রথমত, বাণিজ্যিক সংযোগ অপসারণ না করে সেখান থেকেই আবাসিক সংযোগ দিয়েছেন। দ্বিতীয়ত, কাঠের টুকরা দিয়ে গ্যাসের লাইনের ছিদ্র বন্ধ করেছেন। কিন্তু তিতাস কর্তৃপক্ষের অসহযোগিতার কারণে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের চিহ্নিত ও দায়দায়িত্ব নিরূপণ করা সম্ভব হচ্ছে না। তিতাস কর্তৃপক্ষের দাবি, তারা এ–সংক্রান্ত নথি খুঁজে পাচ্ছে না। পরে আদালতের অনুমতি নিয়ে তিতাসের মেট্রো ঢাকা বিপণন বিভাগের (দক্ষিণ) রাজস্ব ও বিক্রয় প্রকৌশল শাখাকে তিন মাস আগে চিঠি দেওয়া হয়েছে। এখন পর্যন্ত তাঁরা জবাব দেয়নি।
কার দায় আছে, সেটি নিরূপণ করা পুলিশের দায়িত্ব। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা তথ্য দিতে না চাইলে তিতাসের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে পুলিশ যোগাযোগ করবে। এখানে দায় নিরূপণ না করে তদন্ত শেষ করা উচিত হবে না। তাহলে ভবিষ্যতেও এ ধরনের ঘটনায় পার পাওয়ার সুযোগ তৈরি হবে।ঢাকা মহানগরের সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) আবদুল্লাহ আবু
এ বিষয়ে তিতাসের মেট্রো ঢাকা বিপণন বিভাগের (দক্ষিণ) মহাব্যবস্থাক ফয়জুল বারী সম্প্রতি প্রথম আলোকে বলেন, সিটিটিসি এমন চিঠি দিয়েছে কি না, তা তিনি জানেন না। তবে তাঁদের কর্মকর্তাদের সঙ্গে তদন্তকারীরা কথা বলেছেন, তথ্য নিয়েছেন।
সিদ্দিকবাজারে বিস্ফোরণের দুই দিন আগে (৫ মার্চ, ২০২৩) সায়েন্স ল্যাবরেটরি এলাকার শিরিন ভবনের তৃতীয় তলায় বিস্ফোরণ ঘটে। এতে ছয়জনের মৃত্যু হয়। এই মামলার তদন্ত শুরুর পর থানা-পুলিশ ওই ভবনের তৃতীয় তলায় তিতাস গ্যাসের সংযোগ পাইপ পেয়েছে।
সেই সংযোগ পাইপের ছিদ্র দিয়ে তৃতীয় তলার কোনো একটি স্থানে গ্যাস জমে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটে বলে মনে করছেন তদন্তকারীরা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা বলেন, মগবাজার ও সিদ্দিকবাজারের ঘটনায় সিটিটিসি যা করবে এই মামলার ক্ষেত্রেও সেটা করবে পুলিশ।
৬ বছরেও লাইন অপসারিত হয়নি
২০২১ সালের ২৭ জুন সন্ধ্যার পর মগবাজারের ‘রাখি নীড়’ নামের ভবনের নিচতলায় বিস্ফোরণে ১২ জনের মৃত্যু হয়। সিটিটিসি সূত্র বলছে, ওই ভবনে আবাসিক সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয় ২০১৪ সালে। এক বছরের মধ্যে ওই সংযোগ অপসারণ করার কথা। কিন্তু সেটি তিতাস করেনি। ওই লাইনে গ্যাসের সরবরাহ ছিল। লাইনে ছিদ্র থেকে ভবনের নিচতলায় থাকা শীতাতপনিয়ন্ত্রিত একটি কক্ষে গ্যাস জমে, সেখান থেকেই বিস্ফোরণ ঘটে।
তদন্তসংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা বলেছেন, এ ঘটনায় তিতাসের অন্তত ২৫ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন। কিন্তু ওই লাইন কেন অপসারণ করা হয়নি, কারা দায়িত্বে ছিলেন—এসব তথ্য বের করা যায়নি। পরিত্যক্ত সংযোগ অপসারণ না করার পেছনে তিতাসের ঢাকা মেট্রো বিপণন বিভাগের অভ্যন্তরীণ এক শাখা অন্য শাখার ওপর দায় চাপাচ্ছে।
এ বিষয়ে বক্তব্যের তিতাস কর্তৃপক্ষের বক্তব্য জানতে চাইলে সংস্থাটির জনসংযোগ কর্মকর্তা আল আমিন প্রথম আলোকে বলেন, এসব ঘটনার ক্ষেত্রে তিতাসের কোনো দায় নেই। তিতাসের তদন্তে বেরিয়ে এসেছে, গ্রাহকের অবহেলা ও গাফিলতির কারণে দুর্ঘটনাগুলো ঘটেছে।
তবে তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, তিতাসের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের দায়িত্বে অবহেলা ও গাফিলতির কারণেই বিস্ফোরণের ঘটনাগুলো ঘটেছে। কিন্তু তাঁদের অসহযোগিতার কারণে দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করা যাচ্ছে না।
এসব ঘটনায় কার কতটুকু দায়, তা খুঁজে বের করা জরুরি বলে মনে করেন ঢাকা মহানগরের সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) আবদুল্লাহ আবু। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, কার দায় আছে, সেটি নিরূপণ করা পুলিশের দায়িত্ব। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা তথ্য দিতে না চাইলে তিতাসের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে পুলিশ যোগাযোগ করবে। এখানে দায় নিরূপণ না করে তদন্ত শেষ করা উচিত হবে না। তাহলে ভবিষ্যতেও এ ধরনের ঘটনায় পার পাওয়ার সুযোগ তৈরি হবে।