রাজধানীর বনানীর এফ আর টাওয়ারে আগুনে ২৭ জনের প্রাণহানির ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলায় আট ব্যক্তির বিরুদ্ধে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) দেওয়া অভিযোগপত্র গ্রহণ করেছেন আদালত। পলাতক পাঁচ আসামির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। এ মামলার এক আসামিকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।
ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতের ম্যাজিস্ট্রেট রশিদুল আলম আজ রোববার এই আদেশ দেন। ঢাকা মহানগর পুলিশের অপরাধ ও তথ্য বিভাগের উপপরিদর্শক (এসআই) শাহ আলম এই তথ্য নিশ্চিত করেন।
অভিযোগপত্রভুক্ত আট আসামি হলেন এস এম এইচ আই ফারুক, তাজভীরুল ইসলাম, সেলিম উল্লাহ, এ এ মনিরুজ্জামান, সৈয়দ আমিনুর রহমান, ওয়ারদা ইকবাল, কাজী মাহমুদুন নবী ও রফিকুল ইসলাম। আসামিদের মধ্যে ফারুক, তাজভীরুল ও আমিনুর রহমান জামিনে আছেন। পলাতক বাকি পাঁচ আসামির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে।
২০১৯ সালের ২৮ মার্চ এফ আর টাওয়ারে আগুন লাগে। এ ঘটনায় ২৭ জন নিহত হন। আহত হন অন্তত ৭৫ জন। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় অবহেলাজনিত মৃত্যুর অভিযোগে বনানী থানায় মামলা হয়। মামলার বাদী বনানী থানা-পুলিশ। মামলায় এস এম এইচ আই ফারুক, তাজভীরুল ইসলাম ও লিয়াকত আলী খানকে আসামি করা হয়।
আদালতসংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, এই মামলা তদন্ত করে দুদিন আগে ভবনমালিক এস এম এইচ আই ফারুকসহ আটজনের বিরুদ্ধে আদালতে অধিকতর তদন্ত প্রতিবেদন (অভিযোগপত্র) জমা দেয় পিবিআই। আজ ওই অভিযোগপত্র আদালতের কাছে উপস্থাপন করা হয়। আদালত পিবিআইয়ের দেওয়া অভিযোগপত্র গ্রহণ করে পলাতক পাঁচ আসামির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন। এই আসামিদের গ্রেপ্তার করা গেল কি না, সে–সংক্রান্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার জন্য ১২ মার্চ দিন ঠিক করেছেন আদালত।
২০২২ সালের ২২ ডিসেম্বর এস এম এইচ আই ফারুকসহ আটজনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয় তদন্তকারী সংস্থা ডিএমপির গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি)। পরে মামলাটি অধিকতর তদন্তের জন্য পিবিআইকে নির্দেশ দেন আদালত।
মামলার কাগজপত্রের তথ্য বলছে, ফারুক জমির মূল মালিক। বিএনপি নেতা তাজভীরুল ভবন পরিচালনা কমিটির সভাপতি। বাকি ছয়জন ভবন পরিচালনা কমিটির সদস্য। জামিনে থাকা ফারুক ও তাজভীরুল আদালতের কাছে নিজেদের নির্দোষ দাবি করেছেন।
মামলার কাগজপত্রের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৮৯ সালে তৎকালীন ঢাকা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট (ডিআইটি) থেকে ৯৯ বছরের জন্য আট কাঠা জমির ইজারা পান ফারুক। ১৮ তলা ভবন তৈরির জন্য তিনি শেখ আজহার হোসেন নামের এক আবাসন ব্যবসায়ীর সঙ্গে চুক্তি করেন। আজহারের আর্থিক অক্ষমতার কারণে ১৯৯৯ সালে চুক্তিটি বাতিল হয়। পরে ভবন নির্মাণের জন্য রূপায়ণ গ্রুপের সঙ্গে চুক্তি করেন ফারুক। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) অনুমোদন নিয়ে ভবনটি ২৩ তলা পর্যন্ত করা হয়।
অভিযোগপত্রের তথ্য অনুযায়ী, রূপায়ণ গ্রুপ জমির মালিক ফারুককে তাঁর প্রাপ্য ফ্লোর-ফ্ল্যাট বুঝিয়ে দেয়। কাসেম ড্রাইসেলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাজভীরুল রূপায়ণের কাছ থেকে ২১, ২২ ও ২৩ তলা কিনে নেন। ভবন পরিচালনার জন্য ফারুককে সভাপতি করে ৯ সদস্যের একটি অ্যাডহক কমিটি করা হয়। অন্যদিকে তাজভীরুলকে সভাপতি করে সাত সদস্যের আরেকটি অ্যাডহক কমিটি হয়।
অভিযোগপত্রে বলা হয়, ভবন পরিচালনার ক্ষেত্রে ফারুক ও তাজভীরুল নিজ নিজ বলয় তৈরি করেন। উভয়ে নিজ নিজ কমিটি দিয়ে ভবন পরিচালনা করে আসছিলেন। দুজনের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে দ্বন্দ্ব চলছিল। দ্বন্দ্বের জেরে একাধিক মামলাও হয়।
দুজনের দ্বন্দ্বের কারণে ভবনে কোনো ধরনের পরিচর্যা ছিল না। এতে ভবনের সামগ্রিক নিরাপত্তায় গুরুতর ঘাটতি দেখা দেয়। ভবনে প্রশিক্ষিত জনবল রাখার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু তা রাখা হয়নি। ফ্ল্যাটের মালিকেরা ইচ্ছেমতো ভবনের ফাঁকা জায়গায় বিভিন্ন জিনিসপত্র রেখে দেন। তাঁরা ভবনের ‘ফায়ার এক্সিট’ বন্ধ করে দেন। ‘ফায়ার এক্সিট’ বন্ধ থাকায় জরুরি নির্গমনে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়। ভবনের প্রথম থেকে ২৩ তলা পর্যন্ত অগ্নিপ্রতিরোধক কোনো ব্যবস্থা ছিল না। ফারুক ও তাজভীরুলের দ্বন্দ্বের কারণে ভবনের নিরাপত্তার কোনো ধরনের পদক্ষেপ না নেওয়ায় অগ্নিকাণ্ডে হতাহতের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনার সঙ্গে ভবন পরিচালনা কমিটির সবাই জড়িত।
অভিযোগপত্রের তথ্য অনুযায়ী, ভবনের অষ্টম তলার মালিক সেলিম উল্লাহ। তিনি অধিক দাহ্য বস্তু দিয়ে অষ্টম তলার কক্ষগুলো সাজিয়েছিলেন। দীর্ঘদিন ধরে এই তলায় বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম এলোমেলোভাবে ব্যবহৃত হয়ে আসছিল।
সঠিক পরিচর্যা না থাকায় বৈদ্যুতিক গোলযোগ থেকে অষ্টম তলার শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্রে আগুন ধরে যায়। এই আগুন দ্রুত অষ্টম তলার বিভিন্ন কক্ষে ছড়িয়ে পড়ে। পরে আগুন ভবনে ছড়িয়ে পড়ে। ভবনে গ্লাস নল ব্যবহার করায় অগ্নিকাণ্ডে তাপমাত্রা অনেক বেড়ে যায়।